সুনামগঞ্জকে দুর্গত ঘোষণা করতে বাঁধা কোথায়?

0
107

পক্ষকাল ব্যাপী টানা বর্ষণে নদীতে অত্যাধিক পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরিকল্পিত বাধঁ ভেঙ্গে সুনামগঞ্জের প্রায় সবকটি হাওরই এখন অথৈ জলের দখলে। শুধু হাওর বললে ভুল হবে। হাওর পাড়ের প্রতিটি কৃষকের স্বপ্ন, রি্যিক, শিক্ষা, চিকিৎসা সবই এখন অথৈ জলে নিমজ্জিত। একজন কৃষক স্বপ্ন দেখে তার সোনার ফসলটা ঘরে উঠলে তার পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত আয় দিয়ে ছেলে-মেয়ের শিক্ষার ব্যায় নির্বাহ করবে, নিজের এবং আত্মীয় স্বজনের রোগ-শোক আপদ-বিপদ দেখবে। বলার অপেক্ষা রাখেনা অনেক কৃষকের স্বপ্ন ফসলটা নির্বিঘ্নে তুলতে পারলে তার উপযুক্ত মেয়েটি যোগ্য দেখে পাত্রস্থ করবে। আর সেই স্বপ্নের আঁকর সোনার ফসলটি যখন তলিয়ে যায় অকাল বন্যায়, তখন আর কি স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকবে ওরা? ইতোমধ্যেই হাওর পাড়ের কিছু সংখ্যক সচেতন তরুণ সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত ঘোষণার দাবিতে বংশীকুন্ডা, মধ্যনগর, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ সদরে মানববন্ধন করেছে। অসহায় দিশেহারা মানুষগুলো পেটের ক্ষুধায় ব্যানার দেখেই কিছু পাওয়ার আশায় সামিল হয়েছে মানববন্ধনে। এতে কি ফল হবে সেটা সম্পর্কেও তারা তেমন অবগত নয়। তাদের বিশ্বাস মানববন্ধন যখন হয়েছে এবার খাদ্য, বস্ত্র সবকিছু সরকার আমাদের দেবেই। আর দিশেহারা মানুষগুলোর বিশ্বাসের ফল গতকাল পাওয়া গেল দেশের অন্যতম প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সামাদ-সুরঞ্জিত পরবর্তী ডাক সাইটে নেতা আমাদের মুহিবুবুর রহমান মানিক সাহেবের বক্তব্যে। খবরে প্রকাশ, তিনি বলেছেন”দেশে প্রচুর খাদ্য মজুদ আছে। কোন জেলাকে দুর্গত ঘোষণার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া লঙ্গর খানা খুললে ওখানে কেউ আসবে না।” কথাটা শুনে আমার একটি কথা মনে পড়ে গেল।এক গরীব কৃষকের নয়টি মেয়ে ও একটি ছেলে ছিল। একে একে আটটি মেয়ের বিয়ে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দিলেন কোন সমস্যা হয়নি। নয় নম্বর মেয়েটির বিয়ে দেবার বেলায় একমাত্র ছেলেটি উপযুক্ত হয়ে যাওয়ায় কেউ আর সহযোগিতা না করে উল্টো উপযুক্ত ছেলে রেখে সাহায্য চাওয়ায় কৃষককে ভর্ৎসনা করতে লাগল। অপরদিকে অকর্মণ্য ছেলে সংসারে কোন ভূমিকা না রাখায় মেয়েটির বিয়ে দিতে অধিক বয়স হয়ে যাচ্ছিল। তখন মনের কষ্টেই একদিন কৃষক তার স্ত্রীকে বললেন যখন ছেলে ছোট ছিল তখন আটটি মেয়ে বিয়ে দিতে সমস্যা হয়নি। আর এখন ছেলে বড় হওয়ায় কেউ সাহায্য দিচ্ছেনা। এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো ছিল। তখন আর সাহায্য দিতে কেউ না করতোনা। অবস্থা দৃষ্টে আমারো তাই মনে হচ্ছে হাওর পাড়ের লালিত মানিক-রতন, হীরাদের জন্যই আমাদের আজকের দুর্দশা। বর্তমান সরকার উন্নয়নের সরকার। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাও তো হাওরাঞ্চল নিয়ে কোন বিরক্তি প্রকাশ করেননি। তাহলে হাওরাঞ্চল নিয়ে আপনাদের এত এলার্জি কেন? আপনারাও তো এই হাওরেরই সন্তান! আপনারা তো এটাও জানেন খুবই স্বল্প শিক্ষিত ঐ কৃষকগুলো আসলে দুর্গত বলতে কি বুঝায় বা দুর্গত ঘোষণা দিলেই কি ধরণের সুবিধা পাবে সেটা সম্পর্কেও তারা ওয়াকিবহাল নয়। হাওর পাড়ের কিছু তরুণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মুখ থেকেই তারা এই শব্দটি
সম্পর্কে অনেকাংশে পরিচিত হয়েছে। বলা যায় কেবল দুর্গত ঘোষণা দিয়ে কোনপ্রকার সুবিধা না দিলেও ঐ কৃষকগুলো আপনাদের ধন্যবাদ আর ফুলেল শুভেচ্ছায় দেবতাকেও হার মানিয়ে দেবে। তার পরেও তিন অক্ষরের “দুর্গত” শব্দটি যেন এখন তিনশ অক্ষরের প্রবন্ধে রুপ নিয়েছে।এটা পাঠ করতে যোগ্য সাহেব-বাবু পাওয়া যাচ্ছেনা! ভয়টা আসলে কোথায়? ভয়ের জায়গাটা মূলত অন্যত্র। হাওর পাড়ের হতদরিদ্র মানুষগুলো যদি স্বাবলম্বী হয়ে যায়, তাদের ছেলে মেয়ে যদি শিক্ষিত হয়ে যায়, সচেতন হয়ে যায়, তাহলে আর তথাকথিত ভোটব্যাংকের মালিকরা আর নির্বাচনের সময় নিজেদের অপকর্ম ঢেকে ভোটব্যাংকের অধিপতি বনতে পারবেনা। আজ এই ক্ষণে বড় সাহেবদের বলতে চাই এভাবে হাওরবাসীদের দমিয়ে রাখতে পারবেননা। আসমানে চাঁদ উঠলে মেঘে ঢেকে রাখতে পারেনা। মনে রাখা উচিৎ এত দুর্দিনের মাঝেও সদ্য বিসিএসে এই জেলা থেকেই ২০ জন ক্যাডার কাজে যোগ দিচ্ছে । তাই হাওরবাসী ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখবেই। তাই তাদেরকে নিয়ে চিনিমিনি খেলার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো যখন লিখছি তখন আমার সামনে কেবল পানি আর পানি। নিজের শেষ চিলতেটুকুও যখন গতকাল মনাই নদীতে পানি প্রবেশের সাথে সাথে তলিয়ে যাচ্ছিল তখন আমার মায়ের কদিন আগে বলা সেই কথাটি বার বার মনে হচ্ছিল “আবু(ছেলে) তর আর এক বস্থা চাউল কিনলেই(ক্রয় করা) অইব(হবে)।তেই(তাহলেই) নয়া(নতুন) ধানের লাগাল(ধরতে পারা) পাইয়াম (পাব)।” সেই কথাটি এখন শুধুই স্বপ্ন।শুধু আমার মায়ের নয়, হাওর পাড়ের প্রতিটি মায়ের শত কথাই এখন কেবল স্বপ্ন। এমন সময়ে হাজারো মায়ের কান্না দেখে আর নিজেকে ধরে রাখা যায়না। আমি কলাম লিখতে বসিনি,বসেছি মনের কষ্টগুলো লিখতে, হাওর পাড়ের হা-হুতাশ আর আক্ষেপগুলো লিখতে। সরকার জেলায় ১৫ টাকা কেজি চাল,১৮ টাকা কেজি আঁটা নির্ধারণ করেছে শুনে কিছুটা স্বস্থি বোধ করেছি। সরকারকে ধন্যবাদও দিয়েছি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় ১৫ টাকা, ১৮ টাকাই বা নিঃস্ব হাওরবাসী পাবে কোথায়? আবেগ থেকে নয় বিবেক থেকে বলছি সরকারের কাছে, প্লিজ আপনারা হাওরবাসীদের নিয়ে মরণ খেলা খেলবেন না। একজন মানুষ কখন বলে আমার ঘরে খাবার নেই, আমার বাচ্চা উপোষ, আমার পেটে ভাত নেই সেটা সময় থাকতে বুঝার চেষ্টা করুন এবং অনতি বিলম্বে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে সহায় সম্বলহীন হাওর বাসীকে অন্য বস্ত্রের ব্যবস্থা করুণ এবং সেই সাথে নিজেরা ভালোবাসায় সিক্ত হোন।
লেখকঃসহকারী শিক্ষক
লায়েছ ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়
দাতিয়াপাড়া,ধর্মপাশা সুনামগঞ্জ।
প্রথম প্রকাশঃ 10.04.17 dpnewsbd.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে