সজল কান্তি সরকার,হাওর গবেষকের গল্প

0
305

হাওর উৎসব ও একজন হাওর গবেষকের গল্প
জীবন কৃষ্ণ সরকার

জীবন চলার পথে এমন কিছু মানুষের সাথে দেখা হয় যাদের ধর্মে,কর্মে সর্ব ক্ষেত্রেই কেবল অন্যের উপকারার্থই প্রকাশ পায়, কেবল দেশের জন্য, দশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জনতাই প্রকাশ পায়।তেমনই এক জন মহাত্মা সুনামগঞ্জ তথা সমগ্র হাওরাঞ্চলের জন্য নিবেদিত প্রাণ,আমাদের গর্ব , হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার।
সদ্য সমাপ্ত হাওরপারের কৃষক জেলেদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হাওরবৈঠকটিও মূলত তাঁর সূক্ষ স্বপ্নেরই বাস্তবায়নমাত্র।ছোট বেলা থেকেই হাওরপাড়ে বেঁড়ে ওঠা সময়ের এই লড়াকু সৈনিক শৈশবেই হাওরের দুঃখ,কষ্টকে বুকে ধারণ করেছিলেন মনে প্রাণে।তাইতো তিনি যখন কলেজে পড়াশুনা করতেন তখন থেকেই তিনি তাঁর শহুরে বন্ধুদের মাঝে হাওরের কবিতা শুনিয়ে নিজেকে তৃপ্ত করতেন,নিজের সত্ত্বাকে অন্যের মাঝে তুলে ধরতেন অকপটে।হাওরের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে, হাওর পাড়ের সুখ, দুঃখের স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে হাওর পাড়ের এক ঝাঁক তরুন নিয়ে তিনি ১৯৯০ সালে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেন হাওর পাড়ের ধামাইল (হাপাধা) বাংলাদেশ নামে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন।এ পর্যন্ত দেশের চারটি জেলায় সংগঠনটি সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।ইতোমধ্যেই সংগঠনটি জেলা,বিভাগ ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে ধামাইল গান তথা হাওরের বিলুপ্তপ্রায় লোকস্মৃতি নিয়ে সাংস্কৃতিক উৎসব সম্পন্ন করেছে যা স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।আজ তার সম্পর্কে দু একটি কথা না বললেই নয়।

তিন.
লিখাটা এমন একসময় লিখছি যখন একজন শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন করা হয় এ+ প্রাপ্তির ভিত্তিতে,আর একজন পর্যাপ্ত বয়স্ক মানুষকে মূল্যায়ন করা হয় চাকরি নামক জটিল নিক্তিতে।তাই তথাকথিত নিক্তির বাইরে কোন একজন কে মূল্যায়ন করতে আমরা প্রায় অনভ্যস্থই হয়ে গেছি।যাহোক,তারপরও সামান্য কিছু স্মৃতিচারন করার চেষ্টা করছিমাত্র। গেল বছর আমরা তাহিরপুরে একটি সফল হাওর উৎসব দেখেছিলাম। সে উৎসবটি যার তত্ত্বাবধানে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল তিনি হলেন আমাদের মধ্যনগর তথা ভাটি বাংলার গর্ব, হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার। এছাড়াও ঢাকাতে বিভিন্ন সময়ে ঝাঁকজমক পূর্ণ ধামাইল উৎসব তথা সাংস্কৃতিক উৎসব সফলভাবে সম্পন্ন করে চলেছে হাপাধা বাংলাদেশ।জানা যায় ১৯৯৬ সাল থেকে বিগত প্রায় ২১ বছর ধরেই তিনি তাঁর নিরলস হাওর গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন।অতি সম্প্রতি তিনি হাওরপারের ধামাইল গান গুলোকে সংগ্রহ করে,বিভিন্ন অনুষ্ঠাণের মাধ্যমে গ্রামবাংলায় তা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।তাঁর ভাষ্য মতে “আমি অন্তত দু -মাসে একবার গ্রামে তথা হাওরে না গিয়ে থাকতে পারিনা।”হে, শতভাগ সত্যি কথা।যার প্রমান হাওর নিয়ে এ যাবৎ কালে ক্ষেও,হাওরের কথকতা,ঢেউ পবনের সুর,ঢেউ ভাঙ্গা ঢেউ সহ মোট ৯ টি বই প্রকাশ করেছেন।এগুলোতে তিনি হাওর পাড়ের দুঃখ,দুর্দশা,আনন্দ, বেদনার চিত্র তুলে ধরেছেন।তাঁর বিস্তারিত বর্ণনা হয়তো আজ দিতে পারবোনা তবে দু-একটি স্মৃতিচারণ করছি। তাঁর ঢেউ পবনের সুর গানের বইয়ে লিখেছেন-
“হাওর পারে বাড়ি আমার
শাইলের ভাত খাই
মিঠাপানির স্বাদুমাছ
নিত্যি নিত্যি পাই।” পৃষ্ঠা ১৯

“হাওর জীবন হাওর মরণ
হাওরে করি মুর্শিদ ভজন
মুর্শিদ নামের বাদাম দিয়া
হাওরে করি বসবাস।।” পৃষ্ঠা ২০

এখানে তিনি হাওরকে নিয়ে,হাওরের ভাতকে নিয়ে গর্ব করেছেন। পাশাপাশি পরের প্যারাটিতে হাওরের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।

আরো লিখেছেন-

” দুঃখ বলি কারে সখি
দুঃখ বলি কারে
যার কাছে বলিব দুঃখ
সেই তো গেল দূরে সখি
সেইতো গেল দূরে।।”
ঢেউপবনের সুর /পৃষ্ঠা ৮২

ভাটির কইন্যা যায়গো জলে
মাটির কলসি লইয়া
ও-এ গো চিকন কালা বাজায় বাঁশি
রাধা-রাধা কইয়া।।”
ঢেউ পবনের সুর/পৃষ্ঠা ৮৭

উপরের গান দুটিতে আবহমান হাওর পাড়ের ধামাইল গানে নারী সমাজের দুখ, সুখের চিত্র ফুটে উঠেছে।
একই ভাবে ঢেউ ভাঙ্গা ঢেউ উপন্যাসে আরশ আলী, কৈভানুরের মায়ের উদৃতি দিয়ে বলেন-
“আমার ময়নারে বিয়া দিয়াম গিরস্থ দেখিয়া,
আষাঢ় মাসে অইব বিয়া পানসি নাও দৌঁড়াইয়া।” পৃষ্ঠা ৫২

এখানে হাজার বছরের গ্রাম বাংলার চিরায়ত চিত্র ফুটে উঠেছে।
নিজ জন্মস্থানের প্রতি অগাধ আস্থা থেকে তিনি আহব্বান করেন-
” তোমরা যারা কষ্টে আছ
আইস সবাই হাওরপারে
ইচ্ছেমত সোহাগ পাবে
হাওরপারের দ্বারে দ্বারে।”
বাউন্ডুলে কবি/পৃষ্ঠা ১৩
এরকম শত শত পংক্তিমালা আজ গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে মুখে।

জীবনে কোন কিছু পাওয়ার চাইতে দেয়াকেই তিনি বেশি প্রয়োজন মনে করেন হালের এই গবেষক। তাইতো তিনি হাওরবাসীর দুর্দিনে,সুদিনে ছুটে আসেন হাওরে।
তাঁর সাথে একান্ত আলাপকালে জানা যায়,তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই তিনি হাওর নিয়ে লেখা -লেখি, গবেষনা চালিয়ে যেতে চান।তাইতো তিনি লিখে যাচ্ছেন একের পর এক গবেষনাধর্মী বই।তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থসমূহের সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো আমি আপনাদের দিতে পারবোনা।তবে যতদূর জানতে পেরেছি তা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মাঝে কবিতার বই ১০ টি,ছড়ার বই ৫টি,গল্পের বই ২টি, গানের(লোকগীতি) বই ২ টি গবেষনাধর্মী ১৫ টি,উপন্যাস ৪ টি ও নাটক ৭ টি।এছাড়াও দুটি টিভি নাটকের স্ক্রিপট ও জাঙ্গালের গল্প নামে একটি ডকুমেন্টারিও রয়েছে তাঁর।আর স্থানীয়,জাতীয় পত্রিকা সহ অনলাইন পোর্টালগুলোতেও নিয়মিত হাওর বিষয়ক কলাম প্রকাশিত হচ্ছে নিয়ত।
লেখালেখির পাশাপাশি যুক্ত আছেন বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে।তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠিত হাওরপারের ধামাইল (হাপাধা) ছাড়াও বর্তমান সভাপতি, মধ্যনগর উন্নয়ন পরিষদ,বর্তমান সভাপতি, বাউলা অন্তর।এছাড়াও ছাত্রাবস্থায় মধ্যনগর ছাত্রলীগের সভাপতি (১৯৯৬-৯৭) ছিলেন তিনি।

১৯৭০ সালে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানাধীন নগদাপাড়া গ্রামে এক সাধারন পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তিনি।পিতাঃ প্রবোধ চন্দ্র সরকার,মাতাঃ দয়া রানী সরকার এর তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মাঝে তিনি সবার বড়।আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করা এই মানুষটি জীবনের শুরুতেই শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।মধ্যনগর বি.পি. স্কুল এন্ড কলেজে প্রথমে এবং পরে জালালাবাদ প্রি ক্যাডেট একাডেমীতে কিছুদিন অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন।জীবন ও জীবিকার তাগিদে জীবনের একটা অংশ কোম্পানিতেও কাজ করেছেন তিনি।কিন্তু কোম্পানিতে কঠোর পরিশ্রমের মাঝেও সাহিত্য সাধনা তথা হাওর গবেষণা থেকে এক মুহুর্তও বিরত থাকেননি সময়ের অন্যতম হাওর গবেষক এই সৈনিক। বরং সাহিত্য,সংস্কৃতির প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে ধীরে ধীরে তিনি লেখালেখি জগতে পুরুপুরি জড়িয়ে পড়েন।লিখে যেতে থাকেন একের পর এক গবেষণাধর্মী বই।জানা যায়,হাওরের উপর লেখা তাঁর দুটি গবেষনাধর্মী বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওর বিষয়ক গবেষনা কোর্সে রেফারেন্স বই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

প্রাথমিক ভাবে নাটক (যুদ্ধের কথা) দিয়ে লেখালেখি জগতে পদচারনা হলেও এখন বর্তমানে কেবল হাওর নিয়ে লিখতে চান, ভাবতে চান বলে গত ২০ মে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকারে আমাকে জানিয়েছেন তিনি।এসময় লেখালেখির পাশাপাশি তাঁর একটি শখ, ছবি আঁকা বলেও জানান।দুটি অপ্রকাশিত ছবি আঁকার বইয়ের কথাও এসময় তিনি উল্যেখ করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি দুই ছেলে সানভী সরকার ও জয়দীপ সরকার অভিক এবং একমাত্র মেয়ে মৌমিতা সরকার এর জনক।ছেলেমেয়ে সহ স্ত্রী রেখা রানীকে নিয়ে বর্তমানে তিনি সিলেটে সুখ শান্তিতেই বসবাস করছেন।আজকের দিনে এই মহান মানুষটিকে দেবার মত আমাদের কিছুই নেই।তাই সকলের পক্ষ থেকে পরম করুনাময়ের কাছে প্রার্থনা,যতদিন বেঁচে থাকেন তিনি যেনো সুস্থ্য ও সুন্দর ভাবে জীবন যাপন করতে পারেন এবং নিরলস হাওর গবেষনা চালিয়ে যেতে পারেন।

লেখকঃ কবি ও কলামিস্ট।
সভাপতি,হাসুস বাংলাদেশ
সম্পাদক,হাওরপিডিয়া

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে