ধামাইল গানের বরপুত্র রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ

0
115

ধামাইল শব্দটি শোনার সাথে সাথে যে নামটি আমাদের মনন মগজে ভেসে ওঠে তিনি আর কেহ নন। তিনি আমাদের হাওর তথা সারা বাংলাদেশের গর্ব ধামাইল গানের বরপুত্র,ধামাইল গানের জনক রাধারমন দত্ত পুরকায়স্থ।তাহলে চলুন বন্ধুরা আজ বিস্তর জেনে নেই এই মহান গীতিকার সম্পর্কে।

কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া,অন্তরে তুষেরই অনল জ্বলে গইয়া গইয়া ।। ভ্রমর কইয়ো গিয়া,
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে,
ভ্রমর কইয়ো গিয়া ।।শ্যাম কালিয়া সোনা বন্ধুরে…
মা তুই জলে না যাইও, ওহে কলঙ্কিনী রাধা”
এই গান গুলো শোনেননি দেশে এমন মানুষ বিরল।হ্যাঁ,তিনিই আমাদের রাধারমণ দত্ত।এমন অসংখ্য গান লিখে যিনি লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন তিনিই আমাদের রাধারমণ দত্ত। বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত জন্মসূত্রে একজন বাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈষ্ণব বাউল, ধামালি নৃত্য-এর প্রবর্তক।সংগীতানুরাগীদের কাছে তিনি রাধারমণ বলেই সমধিক পরিচিত। বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমণ দত্ত।রাজবৈদ্য চক্ৰপাণি দত্তের অধস্তন পুরুষেরা শ্ৰীহট্টের প্রাচীন সভ্রান্ত বংশ। এই বংশের জনৈক প্রভাকর দত্ত ও কেশব দত্তের নামে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার অন্তৰ্গত দুটি গ্রাম নামাঙ্কিত আছে। প্রভাকর দত্তের থেকে দ্বাদশ পুরুষে রাধারমণ দত্তের জন্ম। ১৮৩৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানার কেশবপুর গ্রামের রাধামাধব দত্তের ঘরে, ১২৪০ বঙ্গাব্দে ধামাইল গানের জনক রাধা রমণ দত্তের জন্ম। মাতা সুবৰ্ণ দেবী। শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চলের পঞ্চখণ্ডে ত্রিপুরাধিপতি ‘ধর্ম ফাঁ’ কর্তৃক সপ্তম শতকে মিথিলা হতে আনিত প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্রাহ্মণের মধ্যে আনন্দ শাস্ত্রী নামক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রাধারমণ দত্তের পুর্ব পুরুষ ছিলেন বলে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ঐতিহাসিক গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে পাওয়া যায়। সাবিত্রী, সূর্যব্রত পাঁচালি, পদ্ম-পুরাণ ও কৃষ্ণলীলা গীতিকাব্য উল্লেখযোগ্য। এই প্রসিদ্ধ কবি রাধামাধব দত্তই ছিলেন রাধারমণ দত্তের পিতা।বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের প্রতিও তার অনুরাগ ও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।রাধারমণের কৈশোরেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়।বাবার সংগীত ও সাহিত্যসাধনা রাধারমণকে প্রভাবিত করে। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও ব্যতিক্রমী সৃষ্টি হচ্ছে ধামাইল গান। তাররচিত ধামাইলগান সিলেট ও ভারতের বাঙ্গালীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। রাধারমণ নিজের মেধা ও দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। দেহতত্ত্ব,ভক্তিমূলক,অনুরাগ, প্রেম,ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরনের গান রচনা করেছেন তিনি।

তিনি বাল্যাবধি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। শাস্ত্রীয় পুস্তকাদির চর্চা ও সাধু সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে তিনি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি নানা মত ও পথের সঙ্গেপরিচিত হন। কবির সংসার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। শুধু জানা যায়, রাধারমণ-গুণময় দেবীর ৪ ছেলে ছিল। তাঁদের নাম- রাজ বিহারী দত্ত, নদীয়া বিহারী দত্ত, রসিক বিহারী দত্তও বিপিন বিহারীদত্ত। কিন্ত দুঃখের বিষয় একমাত্র পুত্র বিপিন বিহারী দত্ত ছাড়া বাকি ৩ পুত্র এবং স্ত্রী গুণময় দেবী অকালে মারা যান। স্ত্রী ও পুত্রদের পরলোক গমনে কবি রাধারমণ দত্ত সংসার জীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন।১২৯০ বঙ্গাব্দে ৫০ বছর বয়সে কবি চলে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তাঁর কাছে শিষ্যত্ব লাভ করেন। শুরু হয় কবির বৈরাগ্য জীবন। আরম্ভ করেন সাধনা। গৃহত্যাগ করে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এখানে চলে তাঁর সাধন কর্ম। নলুয়ার হাওরের আশ্রমে দিবা রাত্রি সাধনা ও ইষ্টনামে মগ্ন এবং অসংখ্য ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। ধ্যান মগ্নঅবস্থায় তিনি গান রচনা করে গেয়ে যেতেন। ভক্তরা শুনে শুনে তা স্মৃতিতে ধরে রাখত এবং পরে তা লিখে নিত।বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণে গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে। সাধক রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কলিকাতা থেকে বাউল কবি রাধারমণ নামে ৮৯৮ টি গান নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মোহাম্মদ মনসুর উদ্দীন তার হারামনি গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে রাধারমণের ৫১ টি গান অন্তর্ভুক্ত করেন।
রাধারমণ দত্ত ১৯১৫ সালে ৮৩ বছরে বয়সে তিনি নিজ গৃহে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাধারমণ দত্তের মৃত্যুর পর থেকে তার শীষ্যরা সমাধিমন্দিরে প্রতিদিন বাতি জ্বালিয়ে সমাধিস্থলকে রক্ষণাবেক্ষন করে আসছিল। যার ধারাবাহিকতায় বংশপরমপরায় এ সমাধিস্থলটি রক্ষণাবেক্ষণ হয়।আমরা চাই এই মহান মানুষটির কীর্তি-কর্ম যেনো রাষ্ট্রীয় ভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

লেখক:
জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃউইকিপিডিয়া,হাওরপিডিয়া,বঙ্গদর্শন ডটকম,সুনামগঞ্জ ডট গভ ডট বিডি,বিডি টুডে ২৪ ডটকম,somewhereinblog.net,ekushey-tv.com,gaanerpatha.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে