আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দা সূফি সাধক আরকুম শাহ

0
99

আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দা সূফি সাধক আরকুম শাহ

যুগে যুগে আমাদের এই দেশে অনেক আধ্যাত্মিক মরমী সাধকের জন্ম হয়েছে।তারা মানুষের উপলদ্ধিকে মরমে মরমে উপলদ্ধি করে গান, কবিতা লিখে গেছেন। তেমনই একজন মরমী সাধক সিলেট ভূমির আরকুম শাহ।চলুন বন্ধুরা আজ এই মহান মরমী সাধকের সম্পর্কে অজানা কিছু জেনে আসি।

মরমি গানের মহান সাধক আরকুম শাহ (১৮৫১-১৯৪১)। উনিশ ও বিশ শতক আলোকিত করেছেন তার রচিত গান ও কবিতা দিয়ে। তিনি একজন উঁচুমানের সাধক ছিলেন। সংগীত তার সাধনার অঙ্গ। কিন্তু কবি কেবল আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দাই ছিলেন না। সমকালীন সমাজ ও জগতকেও তিনি দেখেছেন ‘চোখের আলোয়’ ‘চোখের বাহিরে’। তিনি অন্তরেও দেখেছেন ‘যখন আলোক নাহি রে’। একজন কবি তো সর্বদাই অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী। আমরা যা দেখেও দেখি না, তারা তা পরোক্ষ করেন। এজন্য আরকুম শাহ কেবল আধ্যাত্মিক গান রচনা করেই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেননি। তিনি সমকালীন বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনটি ভট্ট কবিতা- ‘নিরানব্বই সনের গিরাইর কবিতা’, ‘ভূমিকম্পের কবিতা’ এবং ‘ভূমিকম্পের শেষ ফল কবিতা’। এসব কবিতাকে ‘পথুয়া কবিতা’ও বলে। মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন ‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা’য় তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থ তিনটি এবং গীতিগ্রন্থ ‘হকিকতে সিতারা’(১৯৪০) -এর একাধিক মুদ্রণ তার জীবদ্দশায়ই হয়েছিল। এ ছাড়া লোকগবেষক সুমনকুমার দাশের সম্পাদনায় ‘আরকুম শাহ রচনাসমগ্র’ প্রকাশ করেছে ঢাকার উৎস প্রকাশন।সিলেটি নাগরীলিপিতে বেশ কিছু গ্রন্থ লিখেছিলেন আরকুম শাহ। ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ভূমিকম্প নিয়ে তিনি কাবিননামা নামের কবিতা পুস্তক রচনা করেন।এরপরেও বর্তমানে তিনি যতটা আলোচিত ও প্রচারিত হওয়ার কথা, ততটা হননি। সাম্প্রতিককালে তার সম্পর্কে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তা পাঠকের তৃপ্তিদান করতে সম্পূর্ণ সফল হয়নি। এই অপূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতা দূরীকরণে এগিয়ে এসেছেন একজন স্বাধীন গবেষক সৈয়দা আঁখি হক। তার দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল ‘আরকুম শাহ : জীবনদর্শন ও গীতিবিশ্ব’ শীর্ষক ৪৩২ পৃষ্ঠার মেধাবী গ্রন্থ।

আরকুম শাহর জন্ম-মৃত্যুসহ সাধনালব্ধ জীবনের পুরো কাহিনী জনসমক্ষে তুলে ধরার মতো যে মহান কাজটি করেছেন তিনি বর্তমান সময়ের মরমি সংগীতসমুদ্রের এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী, মরমি সংগীত গবেষক সৈয়দা আঁখি হক। যিনি তাঁর পরিবার-পরিজনকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি আরকুম শাহের সংগীতকে সর্বজনীন করে তুলতে সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছা, উদ্যোগ, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে এ অদম্য কাজে হাত দেন। দীর্ঘদিন গবেষণার ফসল এ গ্রন্থে আরকুম শাহকে সুফি ঘরানার সাধক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আরকুম শাহর পুরো জীবনের যাবতীয় তথ্য উদঘাটন, বিশ্লেষণ করে, অগ্রন্থিত গান, গানের বাণী সংকলন করে এক মলাটে আবদ্ধ করেন। উক্ত গ্রন্থে সংযোজন করেন আরকুম শাহর দূর্লভ ছবি ও ব্যবহৃত সামগ্রী। এ গ্রন্থেই পাওয়া যাবে আরকুম শাহের গানের শুদ্ধপাঠ। আরকুম শাহ দেখতে কেমন ছিলেন? কেমন ছিলো তাঁর জীবন ভাবনা? কেমন ছিলো তাঁর সাধনা, গুরু, শিষ্য? গবেষকের অনুসন্ধান ও অস্যাধ্য সাধন পাঠকের কৌতূহল পূরণ করবে। আরকুম অনুরাগীর জন্য আরকুম শাহর ছবিটি বিশাল পাওনা। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। আরকুম শাহ মূলত আধ্যাত্মিক ও ভক্তিমূলক গানের রচয়িতা।আরকুম শাহ’র জনপ্রিয় কয়েকটি গানঃআজি দরশন মিলন হইলো এখন রাধা কানাই প্রেম লীলা বৃন্দাবন, সোনার পিঞ্জিরা আমার কইরা গেলায় খালিরে, হায়-রে আমার যতনের পাখি, মন সুয়ারে, একবার পিঞ্জিরায় আও দেখি, কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে,ফুলে পাইলো ভ্রমরা, দুনিয়া পিরিতের বাজার।

জীবন ও সত্তার অর্থ আবিস্কারে ব্রতী এক সৃষ্টিশীল কবি আরকুম শাহ। সত্যান্বেষণে নিবেদিত এই সাধকপুরুষ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ধরাধরপুর গ্রামে আনুমানিক ১৮৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাসের রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদগুলো বাংলা সাহিত্যের মান উন্নীত করেছে। এগুলো যেমন সুমধুর, তেমনই আধ্যাত্মিক রসে ভরপুর। সেই ধারাবাহিকতায় সুফি কবি আরকুম শাহের মরমি মানস ও শিল্পবোধ তার গানকে সর্বজনীন করে তুলেছে।আধ্যাত্মিক সাধকরা অন্তরের প্রেমময় সত্তাকে সর্বক্ষণ জাগ্রত রাখতে সাধনার অংশ হিসেবে গানকে স্থান দিয়েছেন সর্বোচ্চে। তাদের অন্তরের ভাবধারা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো গান, আর গানের প্রধান অনুষঙ্গ প্রেম। তাদের প্রেম আর গান যেন এক সুতোয় গাঁথা। জীবন ও সত্তার অর্থ আবিস্কারে ব্রতী আরকুম শাহ সুফিবাদী ভাবদর্শনের মগ্নচেতনায় ছিলেন বিভোর। তিনি ধার্মিক ছিলেন, তবে ধর্মান্ধ নয়। সমাজের হিংসা, বিদ্বেষ, কলহ-দ্বন্দ্ব, কোন্দল, অনাচার-ব্যভিচার, বৈরিতা, স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৪১ সালের ১৯ মার্চ জাগতিক দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।আমরা এই মহান সাধকের আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

লেখক-

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া,হাওরপিডিয়া,প্রতিদিনের সকাল ডটকম,প্রবন্ধঃ সৈয়দা আঁখি হক,দৈনিক সমকাল,দৈনিক সংগ্রাম(শফিক আহমদ শফি’র প্রতিবেদন)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে