হাওরের রত্ন মরমী কবি হাসন রাজা

0
88

হাওরগুলো আমাদের রত্ন ভান্ডার।এই হাওর থেকে কত রত্নের জন্ম হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।কোন কোন রত্নকে আমরা জীবদ্দশাতেই চিনতে পেরেছি,কোন কোন রত্নকে হয়তো মৃত্যুর পর পরই চিনতে পেরেছি আবার অনেক রত্ন হয়তো আমরা কোন দিনই চিনতে পারিনি।জীবদ্দশাতেই চিনতে পারা রত্নদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আমাদের মরমী কবি হাসন রাজা।তাহলে চলুন বন্ধুরা জেনে আসি আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি মরমী কবি হাসন রাজা সম্পর্কে।

দেওয়ান হাসন রাজা সিলেটের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে ২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪ (৭ পৌষ, ১২৬১) সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার আলী রাজা চৌধুরী ও হুরমত জাহান বিবির ২য় পুত্র। খালাতো ভাই আমির বখশ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে আলী রাজা চৌধুরী পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শে তারই নামের আকারে হাসন রাজার নাম রাখা হয় অহিদুর রাজা। তিনি নিজে ছিলেন স্বশিক্ষিত। সিলেটে তখন আরবি-ফারসির চর্চা ছিল অনেক।

হাছন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।হাছন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি নামক গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার কোণাউরা গ্রামে তার পূর্ব পুরুষ বিজয় সিংহ বসতি শুরু করেন, পরে কোন একসময় বিজয় সিংহ কোণাউরা গ্রাম ত্যাগ করে একই এলাকায় নতুন আরেকটি গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তার বংশের আদি পুরুষ রামচন্দ্র সিংহদেবের নামের প্রথমাংশ “রাম” যোগ করে নামকরণ করেন রামপাশা।

হাসন রাজার উল্যেখ যোগ্য গানগুলোর মাঝে “লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা না আমার,মাটির পিঞ্জিরায় পাখি বন্দী হইয়া রে, বাউলা কে বানাইলোরে হাসন রাজারে বাউলা কে বাসাইলোরে, নেশা লাগিল রে, নেশা লাগিলরে,গুড্ডি উড়াইল মোরে,মৌলার হাতের ডুরি,হাসন রাজারে যেমনে ফিরায়, তেমনে দিয়া ফিরি,আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল।কেমনে করিবে হাসন বন্ধের সনে মিল, যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি,টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরিরে। এই গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।বলা চলে এমন একসময় ছিল এই গানগুলো হাওরের প্রতিটি কোনায় কোনায় বিম্বিত হতো,এখনো একবারে কম হয়না।
হাসন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কত গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ‘হাসন উদাস’ গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্‌’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাসন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তার গানের পান্ডুলিপি আছে। অনুমান করা চলে, তার অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ ‘সৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয়-‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার(লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী,’মরমী কবি হাসন রাজা’)। ‘হাছন বাহার’ নামে তার আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাছন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
হাসন রাজার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। পনেরো বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হলে সংসার ও জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়। যৌবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৌখিন ও ভোগবিলাসী, কিন্তু পরিণত বয়সে সব বিষয়-সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ জীবন যাপন করেন। তাঁরই উদ্যোগে সুনামগঞ্জ হাসন এম ই স্কুল, অনেক ধর্ম-প্রতিষ্ঠান ও আখড়া স্থাপিত হয়। বিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্রের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করতেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও হাসন রাজা ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় এক হাজার আধ্যাত্মিক গান রচনা করেন। স্থানীয় বাউল-ফকিরেরা সেসব গান গেয়ে তাঁকে পরিচিত করে তোলে। হাসন রাজা ছিলেন একজন ঐশীপ্রেমী এবং সেই প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই তিনি গান রচনা করতেন। তাঁর গানে প্রেম ও বৈরাগ্যময় আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গানগুলি যেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের একটি মিলন ক্ষেত্র। তিনি গানের ভণিতায় নিজেকে ‘পাগলা হাসন রাজা’, ‘উদাসী’, ‘দেওয়ানা’, ‘বাউলা’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি কৈশোর ও যৌবনে শ্রীকৃষ্ণের নানাবিধ লীলায় অভিনয় ও করেছেন।

হাসন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। তিনি ঘোড়া পুষতেন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর এবং চান্দমুশকি।তাঁর সৌখিনতার পাশাপাশি, অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কথিত আছে এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শনে, হাসন রাজার জীবন দর্শন পরিবর্তন ঘটে। ধীরে ধীরে তিনি বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করতে থাকেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দেন এবং বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে আল্লাহ্‌র প্রেমে মগ্ন হন। এই সময় তিনি তাঁর সকল ধ্যান ধারণা স্বরচিত গানে প্রকাশ করতে থাকেন। পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে ‘হাসন এম.ই. হাই স্কুল’ এবং অন্যান্য অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হয়।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর এই মতো ান মরমী কবি মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। উল্লেখ্য এই কবরখানা তিনি মৃত্যুর পুর্বেই নিজে প্রস্তুত করেছিলেন।পরিশেষে বলা যায় হাসন রাজা তার নিজ কর্মগুণেই আজো হাওরের রত্ন হিসেবেই পরিচিত আছেন এবং থাকবেন।আশা করি তার লেখাগুলো সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আরো যত্ন সহকারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

লেখক—

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া,বাংলাপিডিয়া, হাওরপিডিয়া, নিউজ ভিউজ ডট মিডিয়া,অনুশীলন ডট অর্গ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে