উপনিষদের গুরুত্ব
উপনিষদ্ আমাদের অধ্যাত্ম-সংস্কৃতির মূল উৎস। মানবজীবনের সমস্ত আধ্যাত্মিক ভাবরাজির মূলে রয়েছে বেদ এবং সেই বেদেরই সর্বাপেক্ষা প্রধান অংশ হলো উপনিষদ্। কয়েকজন অনন্যপ্রতিভাশালী মানুষ অথবা ঋষিদের ভাবচক্ষের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল বেদ। বেদের মধ্যেই গ্রথিত হয়ে রয়েছে সেই সব মহান ঋষিদের সমস্ত অনুভূতি ও উপলব্ধি। মূল বেদের এক বিরাট অংশ আমাদের কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে; তবুও যা রয়ে গেছে তাও কম নয়। বেদের সংখ্যা চার এবং সমস্ত বৈদিক সাহিত্য যে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত তা হলো: সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ্। সংহিতায় আমরা পাই বৈদিক দেবদেবীদের স্তব-স্তুতি, ব্রাহ্মণে রয়েছে যজ্ঞ ইত্যাদি ক্রিয়াকর্মের বিবরণ, আরণ্যকে আছে সেইসব যজ্ঞ ও ক্রিয়াকর্মের দার্শনিক ব্যাখ্যা আর উপনিষদেই রয়েছে বেদের যথার্থ দর্শনতত্ত্ব। প্রতিটি বেদেই উপনিষদের ভাব কিছু না কিছু রয়েছে। বেদের সার রয়েছে উপনিষদে। তাই উপনিষদ্কে বলে বেদান্ত (বেদের অন্ত অর্থ্যাৎ বেদ+অন্ত = বেদান্ত)। বেদের দ্বিতীয় অংশ ‘জ্ঞানকাণ্ড’ই উপনিষদ্। অদ্বৈত বেদান্তের পুনরুজ্জবনকারী ও পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা আচার্য শঙ্কর বলেছেন: “উপনিষদ্ হলো জ্ঞেয় সত্য-সম্পর্কিত সেই জ্ঞান, যে জ্ঞান সংসারবীজের মূলকারণস্বরূপ অবিদ্যাকামনাকর্মরূপ অবিদ্যাপ্রসবকারী সমস্ত অজ্ঞান, বাসনা ও কর্মবন্ধন বিনষ্ট করে …. ফলে মুমুক্ষুগণ বিষয়ভোগে ইচ্ছা না করে জ্ঞানলাভে রত হন। …. উপনিষদ্ শব্দে ব্রহ্মবিদ্যা বোঝায়।” সুতরাং উপনিষদ্ শব্দের মুখ্য অর্থ হলো মোক্ষনিষ্পন্নকারী ব্রহ্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থাবলী। উপনিষদের সংখ্যা অনেক। এই উপনিষদগুলির প্রত্যেকটিরই গুরুত্ব অথবা প্রামাণিকতা সমান নয়। দশটি প্রধান উপনিষদ্ হলো: ঈশাবাস্য বা ঈশা, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য, এবং বৃহদারণ্যক। আচার্য শঙ্কর প্রতিটি উপনিষদের বিশদ ভাষ্য রচনা করেছেন। তাঁর সমস্ত ভাষ্যই অবশ্য চরম অদ্বৈত বেদান্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত। উপনিষদগুলি যুক্তিসঙ্গতভাবে বা ক্রমানুসারে বিন্যস্ত নয়। তাই সমস্ত প্রধান উপনিষদগুলির কালনির্দেশ করা দুঃসাধ্য।
উপনিষদের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক মতের ফলিত রূপ বুঝবার জন্য আমাদের দেখতে হবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দিকে। গীতা স্বয়ং নিজের সঙ্গে উপনিষদের অভিন্নত্ব ঘোষণা করে; গীতার প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে যেমন বলা হয় – “ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসু উপনিষৎসু…” ইত্যাদি। স্বামী বিবেকানন্দের মতে গীতা হচ্ছে, “উপনিষদ্ থেকে আহরিত আধ্যাত্মিক সত্যসমূহের সমাহারে সৃষ্ট এক অপূর্ব সুন্দর পুষ্পস্তবক”। গীতা উপনিষদের শিক্ষাকে তার উন্নত শিখর থেকে নামিয়ে এনে তাকে মানবমনের উপযোগী করে তুলেছে। তাই বলা যায় যে, উপনিষদ্ কতকগুলি শাশ্বত সত্য ও সার্বজনীন নীতির কথা বলে, ‘ব্রহ্মসূত্র’ বা ‘বেদান্তসূত্র’ সেই সত্য ও নীতির ওপর গড়ে তোলে দর্শন, আর ‘ভগবদ্গীতা’ তাকে প্রতিফলিত করে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চের পিছনে যে মৌলিক চরম সত্যের বার্তা তা অনুরণিত হয় উপনিষদে। উপনিষদের অপূর্ব দর্শনগুলি বিবৃত হয় ‘ব্রহ্মসূত্র’-এ। আর ‘ভগবদ্গীতা’য় প্রকাশিত হয় উপনিষদ্-বর্ণিত সত্যানুগ জীবনধারণের ফলিত উপায়সমূহ। ‘গীতাধ্যান’-এর এক সুপরিচিত শ্লোকে বলা হয়েছে: “সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ। পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ।।” অর্থ্যাৎ, ‘উপনিষাদাবলী গাভীসমূহ, সেই সকল গাভীর দোগ্ধা শ্রীকৃষ্ণ, বৎস অর্জুন, মহাদুগ্ধ অমৃতময়ীগীতা এবং বিবেকিগণ এই দুগ্ধের পানকর্তা।’ উপনিষদের মুখ্য উপদেশগুলি গীতার আঠারোটি অধ্যায়ে বিধৃত। ভারতবর্ষে বেদান্তের সহযোগি সমস্ত দার্শনিক মতবাদগুলি উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র এবং গীতাকে অবলম্বন করেই প্রতিষ্ঠিত। বেদান্ত প্রতিপাদ্য সকল দর্শনের এটি একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট। এই তিনকে অবলম্বন করে বেদান্তের বিভিন্ন সম্প্রদায় সগুণ ঈশ্বরোপাসনা (দ্বৈতবাদ) থেকে নির্গুণ উপাসনা অর্থ্যাৎ চরম অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠা করেছে। সাধারণভাবে অদ্বৈতবাদই বেদান্ত নামে সমাখ্যাত। শঙ্করাচার্য এই অদ্বৈততত্ত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার এবং তিনিই প্রথম এই তত্ত্বটিকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠা করেন। এখন দশটি প্রধান উপনিষদ্ এবং তার সারবস্তুর সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
ঈশোপনিষদ
প্রচলিত ধারনা মতে ঈশোপনিষদকেই প্রথম ধরা হয়। অবশ্য কালক্রমানুসারে এর প্রাচীনত্ব বিচার্য নয়। এই ঈশোপনিষদেই প্রথম মানুষ ও প্রকৃতির ভিতরের দেবত্ব এবং ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সমস্ত সৃষ্টির একত্বের কথা ঘোষিত হয়। এর প্রথম শ্লোকটিতে বলা হয়েছে: ‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং য কঞ্চ জগত্যাং জগৎ’ – পরিবর্তনশীল জগতের সবকিছুই অখণ্ড চৈতন্য সত্তা দ্বারা বিধৃত। সকল সৃষ্টির মধ্যেই সেই এক সদ্বস্তু রয়েছে। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁরই দ্বারা আবৃত এবং পরিব্যাপ্ত। সেই সত্তা সর্বভূতের হৃদয়ে বিরাজমান। এই ঈশোপনিষদ্ সকল বস্তুর মাঝেই সেই ‘এক’কে প্রত্যক্ষ ক’রে জীবনধারণের শিক্ষা দেয়, জীবনের সকল কর্মকেই উপাসনায় পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করে। যিনি উপনিষদের এইভাব জীবনে বিকশিত করতে পারবেন, তিনি জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন। সেই ব্যক্তি কখনো কর্মের দ্বারা বদ্ধ হন না কারণ তিনি তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন থেকে নিজ ইন্দ্রিয়সমূহের ওপর প্রভূত্ব করেন। ঈশোপনিষদের দৃঢ় ভিত্তির উপরে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে সুমহান বেদান্ত সাহিত্য। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ হিন্দু ঈশোপনিষদের সেই প্রথম শ্লোকটির গূঢ় অর্থে বিশ্বাসী; তাই হিন্দুজাতি আজও এক বলিষ্ঠ ও প্রাণচঞ্চল জাতি।
কেনোপনিষদের
মতে সেই এক চরম সত্যই জগৎপ্রপঞ্চের বিচিত্র প্রকাশের উৎস, ভিত্তি ও লক্ষ্য। এই উপনিষদ্ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জড় জগতের অতীত জীবের ভিতরের প্রকৃতি-বিকৃতিহীন আত্মবস্তু বা পরম সত্যের কথা বলে। চেতনার সর্ব অবস্থায় এক ব্রহ্মই চিরন্তন, একমাত্র তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এবং সর্বব্যাপী। কিভাবে গিরিরাজকণ্যা হৈমবতী উমা এই চরম অধ্যাত্ম সম্পদ বিতরণ করেছেন, সেই কাহিনী রয়েছে এই উপনিষদে। কেনোপনিষদ বলছে, এই মনুষ্যজীবনেই আত্মোপলব্ধি করতে হবে, এ অনন্য সুযোগ হাতছাড়া করলে চরম বিপর্যয় (অর্থ্যাৎ, দীর্ঘকালব্যাপী সংসারগতি) লাভ হয়।
কঠোপনিষদে
এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট রয়েছে। এটি অপূর্ব কবিত্ব সুষমা, গভীর অতীন্দ্রিয়বোধ এবং সুউ্চ্চ দার্শনিকতার এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। জীবন-মৃত্যুর রহস্যোদ্ঘাটনে যমালয়ে গিয়ে বালক নচিকেতার যমরাজের সঙ্গে সংলাপের মধ্যে রয়েছে কঠোপনিষদের গূঢ়শিক্ষা। জিজ্ঞাসু নচিকেতাকে যমরাজ জীবন-মরনের পারে যাবার দিব্যজ্ঞান দিয়েছেন। আত্মার প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করেছেন। কঠোপনিষদের এক জায়গায় (১/৩/৩-৬) সারথি ও তার অসংযত ঘোড়ার সাথে মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয়সুখান্বেষণের তুলনা করেছেন: আমাদের রথ ও রথীর সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে, আমাদের এই দেহ হ’চ্ছে রথ, তার মধ্যে যিনি আছেন সেই আত্মা হ’লো রথী, ইন্দ্রিয়গুলি পাঁচটি ঘোড়া, মন হ’চ্ছে লাগাম এবং বুদ্ধি হ’লো সারথি। এইভাবেই মানুষ মায়া অতিক্রম করে, মায়াতীত হয় এবং ঈশ্বরলাভ করে। কঠোপনিষদের বেশ কিছূ শ্লোক ‘ভগবদ্গীতায়’ স্থান পেয়েছে। কঠোপনিষদ্ একদিকে যেমন আধ্যাত্মিক পথকে ক্ষুরধারসম দুর্গম বলেছে, অন্যদিকে হতাশা ও অবসন্নতা ত্যাগ করে সর্বোচ্চ লক্ষ্যে অমৃতত্বলাভের পথে এগিয়ে যাবার জন্য উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান করেছে – ‘উত্তিষ্ঠত, প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’ – স্বামীজী এই অভয়মন্ত্রটি বারবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন – ‘ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।’
প্রশ্নোপনিষদে
নানা দার্শনিক সমস্যা ও তার সমাধান ছয়জন ঋষিবালক এবং এক ঋষির মধ্যে প্রশ্নোত্তরের (যার থেকে এর নামকরণ) মাধ্যমে আলোচনা করা হয়েছে। এতে সমস্ত প্রাণীজগতের উৎস, দেবদেবীদের সংখ্যা ও তাঁদের মধ্যে প্রধান কে, প্রাণের প্রকৃতি ও ক্রিয়া, জাগরন, সুষুপ্তি ও স্বপ্নাবস্থায় ইন্দ্রিয় সমূহের ক্রিয়াকর্ম ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। পবিত্র ওঁঙ্কার ধ্বনির ধ্যান ও তার চরম লক্ষ্য, সবশেষে চৈতন্যস্বরূপ সেই পরমসত্তা সর্বোচ্চ জ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্মসম্বন্ধীয় বিভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে প্রশ্নোপনিষদে। আচার্য প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর যথাযথ উদাহরণ ও উপমার সাহায্যে দিয়েছেন।
মুণ্ডোকোপনিষদের
শুরু জ্ঞান বা বিদ্যার শ্রেণীবিভাগের মধ্য দিয়ে। একটি উচ্চতর জ্ঞান বা পরাবিদ্যা যা সেই অজর, অব্যয় আত্মার সন্ধান দেয়। অপরটি নিম্নতর জ্ঞান বা অপরাবিদ্যা যা হচ্ছে শিল্প, বিজ্ঞান ও অন্যান্য অনাধ্যাত্মিক বিদ্যা। মুণ্ডোকোপনিষদ্ নামটিতেই বোঝা যায় এই উপনিষদে আত্মজ্ঞানলাভে ইচ্ছুক যে কোন মানুষের পক্ষে সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণই সর্বাপেক্ষা শ্রেয়। পৃথিবীর সমস্ত দার্শনিক ভাবের পূর্ণতর চিত্র মানবজাতির মুক্তির সামগ্রিক কল্পনার সারাংশ মুণ্ডকোপনিষদে (৩/১/১-৩) অদ্ভূত ভাষায় চিত্রিত হয়েছে, অপূর্ব রূপকে বর্ণিত হয়েছে: “একই বৃক্ষের উপর সুন্দর-পক্ষযুক্ত দুটি পাখি ব’সে রয়েছে। উভয়েই পরস্পর সখ্যভাবাপন্ন। নীচের ডালে বসা পাখিটি সেই বৃক্ষের ফল খাচ্ছে – কখনও পাকা-মিষ্টি ফল খাচ্ছে, কখনও কাঁচা-টক ফল খাচ্ছে এবং সে কারণে কখনও সুখী, কখনও বা দুঃখী হচ্ছে। কিন্তু উপরের ডালে বসা পাখিটি কোন ফল খাচ্ছে না, সে স্থিরভাবে নীরবে বসে আছে – সে ভালমন্দ কোন ফলই খাচ্ছে না, সে তাই সুখ-দুঃখ উভয়েই উদাসীন – নিজ মহিমায় মগ্ন হ’য়ে আছে। এই পাখিদুটি যথাক্রমে – জীবাত্মা ও পরমাত্মা। মানবাত্মার এই হ’ল যথার্থ চিত্র। মানুষ এইজীবনে স্বাদু ও কটুফল খাচ্ছে – সে কাঞ্চনের খোঁজে মত্ত – সে ইন্দ্রিয়ের পিছনে সদাই ছুটছে, সংসারের ক্ষণিক বৃথা সুখের জন্য মরিয়া হ’য়ে পাগলের মতো ছুটছে।” এই হচ্ছে জগৎপ্রপঞ্চ – মায়ার খেলা। কিন্তু যখন সে ঈশ্বরকে এবং তাঁর মহিমাকে নিজের থেকে অভিন্ন-রূপে দর্শন করে, তখন সে বীতশোক হয়। চরম নিবৃত্তির মহামুহূর্তটিতে ব্রহ্মস্বরূপ লাভ করে তাঁদের সবরকম বন্ধনমুক্তি ঘটে। এই উপনিষদেরই বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণা: ‘যিনি ব্রহ্মকে জানতে পারেন, তিনি ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যান।’ মুণ্ডোকোপনিষদের উক্তি ‘সত্যমেব জয়তে’ আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতীক অশোকচক্রের নিচে জাতির জীবনের আদর্শরূপে খোদিত।
মাণ্ডুক্যোপনিষদ্
হচ্ছে প্রধান উপনিষদ্গুলির মধ্যে সবচেয় সংক্ষিপ্ত। সত্যকে কেবল চৈতন্য-সত্তারই অভিব্যক্তিরূপে উপলব্ধি করে মাণ্ডুক্যোপনিষদ্ বলছেন – ‘সর্বং হ্যেতদ্ ব্রহ্ম, অয়মাত্মা ব্রহ্ম।’ এ সমস্ত অবশ্যই ব্রহ্ম, আত্মাই ব্রহ্ম। অদ্বৈতবাদী বেদান্তীর কাছে মাণ্ডুক্যোপনিষদই সর্বশ্রেষ্ঠরূপে পরিগণিত। এখানে পরমাত্মা ও পবিত্র ওঙ্কারধ্বনি এক ও অভিন্নরূপে ঘোষিত এবং ওঁ (অউম) শব্দটির গঠনকারী অক্ষরগুলির আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও বিশেষরূপে আলোচিত হয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, ওঁ শব্দটির যথাযথ ধ্যানের দ্বারা ব্রহ্মোপলব্ধি সম্ভব।
ঐতরেয়-উপনিষদ্
সৃষ্টি ও বিশ্বতত্ত্বের আলোচনা করতে করতে শেষে পরব্রহ্মের মহিমা উপলব্ধি করেছেন। বলছেন, ব্রহ্মই চৈতন্য অথবা প্রজ্ঞাস্বরূপ, সমস্ত জগৎপ্রপঞ্চ উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়কালে এই প্রজ্ঞানেই আশ্রয় নেয়। প্রজ্ঞা অথবা চৈতন্যই জগতের আশ্রয়। ব্যক্তিসত্তার প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু
তৈত্তিরীয় উপনিষদের
মতে ব্যক্তিসত্তা পঞ্চকোষ দ্বারা গঠিত। যথা, অন্নময় কোষ, প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ ও আনন্দময় কোষ। এ সবেরই পারে রয়েছেন সেই অন্তরতম সত্তারূপী আত্মা। ‘সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম’ – সত্য, জ্ঞান ও অনন্তই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ। এখানে আরও বলা হয়েছে: ‘যাঁর থেকে এ সমস্তই জাত, যাঁর দ্বারা এ সমস্ত জীবন ধারণ করে, বর্ধিত হয় এবং বিনাশকালে যাঁতে গমন করে, প্রবেশ করে, তিনিই ব্রহ্ম। তাঁকেই বিশেষরূপে জানতে আগ্রহী হও।’ এই উপনিষদে পরব্রহ্ম আনন্দস্বরূপে বর্ণিত। বাসনার পূর্ণ নিবৃত্তি হলেই আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মকে চেনা যায়। অথবা, একমাত্র ব্রহ্মোপলব্ধি হলেই এই আনন্দলাভ হয়। এই আনন্দই প্রকৃত আনন্দ। বিন্দু বিন্দু জলকণার মতো সমস্ত আনন্দ বিশাল এক আনন্দসমুদ্র থেকে উঠে (বিচ্ছিন্ন হয়ে) আবার তাতেই লয় পাচ্ছে। দশটি প্রধান উপনিষদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম উপনিষদ্ হলো ‘
ছান্দোগ্য-উপনিষদ্
’। আরুণি ও সনৎকুমারের মতো ঋষিপ্রতিম আচার্য এবং ব্যাকুল ও জিজ্ঞাসু নারদ, সত্যকাম ও শ্বেতকেতুর মতো সর্বজনপ্রিয় বালকদের আমরা ছান্দোগ্য-উপনিষদেই পাই। এখানেই জগৎপ্রপঞ্চ ও চরম সত্যের সমস্যাটির সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে। ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ তত্ত্বটি নানা রূপক ও উপমার সাহায্যে উপস্থাপিত হয়েছে। নাম ও রূপ-সম্বলিত দৃশ্যমান এই জগৎ প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা ও স্বপ্নের মতো, ব্রহ্মই একমাত্র সদ্বস্তু। তিনিই আত্মারূপে সর্বজীবে রয়েছেন। এখানেই সদর্পে ঘোষিত হয়েছে – ‘তত্ত্বমসি’ অর্থ্যাৎ তুমিই সেই এবং ‘তরতি শোকম্ আত্মবিৎ’ অর্থ্যাৎ আত্মজ্ঞানী ব্যক্তিই সকল শোক-দুঃখ অতিক্রম করতে পারেন। মহর্ষি প্রজাপতির শিষ্যদ্বয় দেবরাজ ইন্দ্র ও দৈত্যরাজ বিরোচনের কাহিনীটিও এর অংশ। এই কাহিনীটির সাহায্যে আমরা জড়বাদ ও তার কুফলরূপী স্বার্থপরতা ও ধর্মহীনতা এবং আধ্যাত্মিকতা ও তার প্রাপ্ত প্রসাদস্বরূপ শান্তি, প্রেম ও মৈত্রীর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারি।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ্
’। নাম থেকেই ধরে নেওয়া যায় যে, এটি হলো উপনিষদগুলির মধ্যে বৃহত্তম। সত্যিই এটি সুমহান চিন্তাবলি ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার এক বৃহৎ অরণ্য। এর উল্লিখিত অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। এঁদের মধ্যে রয়েছেন দুজন পুরুষ ও দুজন নারী। এঁরা হলেন: রাজর্ষি জনক, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য ও তাঁর গভীর সংবেদনশীলা স্ত্রী মৈত্রেয়ী এবং প্রতিভাশালিনী ঋষি গার্গী, যিনি যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণা হয়েছিলেন। পরমসত্যের আধ্যাত্মিক ও অপরিবর্তনীয় একত্ব এবং প্রতিটি মানবাত্মার মধ্যের দেবত্ব ও পবিত্রতা – এই বিষয়টি এতে যথাযথ যুক্তি-বিচার করে এবং উপযুক্ত উদাহরণ দিয়ে আলোচিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে। সেই পরম বস্তুকে ‘অভীঃ’ অর্থ্যাৎ ‘ভয়শূন্য হও’ বলা হয়েছে। আর যিনি সেই পরমাত্মাকে বুঝতে পেরেছেন তিনি চরম ভয়শূন্য বা অভীঃ অবস্থালাভে ধন্য হন। এই উপনিষদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিক্ষাটি হলো: দৃশ্যমান জগতে আমরা যা কিছু ব্যক্তি-বস্তু-বিষয়ে প্রিয়বোধ করি, তার সবই প্রিয় হয় আত্মার কারণে – ‘আত্মনস্তুকামায় সর্বং প্রিয়ং ভবতি।’ পতির কাছে পত্নী বা পত্নীর কাছে পতি, পতি বা পত্নীর কারণে প্রিয় হয় না, আত্মার কারণে প্রিয় হয়। পুত্র বা ধনসম্পদ, পুত্র বা ধনসম্পদের কারণে প্রিয় হয় না, আত্মার কারণে প্রিয় হয়। এই আত্মবস্তু পত্নী বা পতি অথবা পুত্র বা ধনসম্পদ অপেক্ষা প্রিয়তর – বিশ্ব চরাচরের সমস্ত বস্তু অপেক্ষা প্রিয়তর। এই আত্মবস্তুর কথা বলতে গিয়ে যাজ্ঞবল্ক্য স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বলেন – প্রিয়ে, এই আত্মাকে উপলব্ধি করো, এর বিষয়ে শ্রবণ করো, শ্রুত বিষয়ে মনন করো, তারপর ধ্যান করো। তাঁকে জানলে আর সব কাছু জানা যায়। এই তত্ত্বের মধ্যে বৃহদারণ্যক উপনিষদের নির্যাস রয়েছে – এই আত্মজ্ঞানলাভেই অধ্যাত্মবিকাশের চূড়ান্ত পরিণতি। বহূশতাব্দীকাল থেকে উপনিষদ্ ভারতবর্ষের সমস্ত ধর্ম ও দর্শন চিন্তার উত্তুঙ্গ শিখরের মহিমান্বিত ও গৌরবময় স্থানটি অধিকার করে রয়েছে। প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের অনুকরণে বলা যেতে পারে যে, এই পুণ্যভূমির সন্তানদের কাছে উপনিষদ্ জীবনে ও মরণে আশার বাণী সঞ্চার করে। প্রতিটি মানুষ ও ব্যাকুল সাধককে নৈতিকতার পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার জন্য আহ্বান জানায় উপনিষদ্। আধ্যাত্মিক সত্যের শীর্ষে আরোহণ করার জন্য জগতের সমস্ত অসারতা ত্যাগ ক’রে চিরন্তন সুখ, আনন্দলাভের উপায় ও আত্মজ্ঞানলাভের জন্য সদাই ধ্বনিত হয়ে চলেছে উপনিষদের অমোঘকণ্ঠ।
উপনিষদগুলোকে বলা হয় ব্রহ্মবিদ্যা বা অধ্যাত্মবিদ্যা – সেই নিত্যবস্তু-সম্পর্কিত জ্ঞান বা বিজ্ঞান। এই বিদ্যা শুধুমাত্র জগতের এক সদ্বস্তুর আভাসই দেয় তা নয়, তাকে লাভ করার উপায়ও বলে দেয়। উপনিষদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, যে নিত্যবস্তু সমস্ত সৃষ্টির প্রকৃত স্বরূপ, মানুষকে সেই সত্যে নিয়ে যাওয়া। ‘অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মাহমৃতং গময়।’ অর্থ্যাৎ, অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে যাওয়া, তমসার পরপারে সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সন্ধান দেওয়া এবং সংসারের মোহিনীমায়ায় মুগ্ধ হয়ে মানুষ যে মরীচিকার ব্যর্থ আকর্ষণে মৃত্যুর দিকে ছুটে চলেছে তাকে অমৃতের সন্ধান দেওয়া। উপনিষদ্ বলছে আত্মানুসন্ধানই শ্রেষ্ঠ অনুসন্ধান; আত্মজিজ্ঞাসাই শ্রেষ্ঠ জিজ্ঞাসা, আত্মবিজয়ই শ্রেষ্ঠ বিজয়, আত্মজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান – যাকে জানলে সব কিছু জানা হয়। উপনিষদ্ আরও জানাচ্ছে, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বযুক্ত মানুষ তার দেহ নয়, মন নয়, বুদ্ধি নয় – এমনকি এই তিনের সমষ্টিও নয়, সে সেই শুদ্ধ-বুদ্ধ-নিত্য-মুক্ত-নির্গুণ আত্মা। এই আত্মা এক এবং অদ্বিতীয় (একমদ্বিতীয়ম্), সর্বজনীন ও সর্বব্যপী। তিনি নির্গুণ জগতের বাইরের হয়েও জগতের সমস্ত জড়বস্তুতে প্রবিষ্ট একমাত্র চৈতন্যময়। এই চৈতন্যসত্তাই জড়কে চেতন ক’রে তার চৈতন্যের আলোকে জগৎকে বিভাসিত, প্রাণচঞ্চল কর্মমুখর করে। অর্থ্যাৎ, তাঁরই দীপ্তিতে সমস্ত প্রকাশিত, তাঁরই জ্যোতিতে সমস্ত ভাস্বর। তিনি না থাকলে জীবন থাকে না, থাকে না চেতনার আলো। সমস্ত সৃষ্ট ও অসৃষ্ট বস্তুর মাঝে বিরাজিত এই আত্মা স্বপ্রকাশ, স্বয়ংজ্যোতি – স্বয়ম্ভূ, অনাদি-অনন্ত, অবিনশ্বর ও শাশ্বত। এমন কোন স্থান নেই যেখানে তিনি নেই। এমন কোন কাল নেই যাতে তিনি নেই। তিনি দেশ, কাল ও নিমিত্তের পারে। তিনিই অতীত ভবিষ্যতের অধিকর্তা, সর্বকালে সমভাবে বর্তমান। মানুষের সমস্ত চিন্তায় ও কর্মে, জাগরণে, স্বপ্নাবস্থায়, এমন কি গভীর নিদ্রামগ্ন অবস্থায়ও আত্মাই নিরন্তর সাক্ষী। ‘তাঁর সাহায্যেই মানুষ স্বপ্নাবস্থায় ও জাগ্রতাবস্থায় সকল বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে।’ আত্মা স্বয়ং কার্যকারণ দ্বারা বদ্ধ নন, তবুও তিনি জগৎপ্রপঞ্চরূপ নিখিল বিশ্বপ্রদর্শনীর মূল ভিত্তি ও নেপথ্য পরিচালক। উপনিষদের মতে সমগ্র জগতের প্রধান এবং কারণ হলেন আত্মা বা ব্রহ্ম। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, উপনিষদের প্রধান বক্তব্য তিনটি: প্রথমত, সর্বব্যাপী ব্রহ্ম অথবা পরমাত্মাই আত্মারূপে সর্বভূতে বিরাজমান। জীবাত্মা বা আত্মাই স্বরূপত ব্রহ্ম অথবা পরমাত্মা। দ্বিতীয়ত, যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির সাহায্যে আত্মজিজ্ঞাসু মানুষ ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষরূপে উপলব্ধি করতে পারে উপনিষদ্ তার পথনির্দেশ করে। তৃতীয়ত, উপনিষদ্ ব্রহ্মজ্ঞানীর অবস্থা বর্ণনা করেন; যিনি ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী হন তিনি এক স্বর্গীয় শান্তি অনুভব করেন, সংসার-বন্ধনমুক্ত হয়ে তিনি মুক্তির আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠেন।
উপনিষদের দৃষ্টিতে আত্মোপলব্ধিই মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্য। সমস্ত প্রাণীকূলের মধ্যে মানুষই সত্যোপলব্ধির এই বিশেষ অধিকার ও মর্যাদা দাবি করে। বলা হয় যে, চরম আধ্যাত্মিক পূর্ণতালাভের জন্য দেবতাদেরও মানুষের শরীর ধারণ করতে মনুষ্যজন্ম নিতে হয়। মনুষ্যজন্মের সুবিধা ও মহিমার কথা উপনিষদ্ মানুষকে স্মরণ করিয়ে সেই চিরন্তন মুক্তি ও শাশ্বত শান্তিদায়ী সত্যলাভের অধিকারের এবং মনুষ্যজন্মের সদ্ব্যবহার করতে বারবার আহ্বান জানায়, প্রেরণা দেয়। উপনিষদের শক্তিদায়ী পবিত্র ও গভীর আধ্যাত্মিক রহস্যপূর্ণ মহাবাক্যগুলির সাহায্যে মানুষ তার সার্থক ও সফল অস্তিত্বের আধ্যাত্মিক ভিত্তিস্বরূপ সেই চিরন্তন পরমব্রহ্মকে লাভ করতে পারে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও সরল মহাবাক্য হলো: ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ – আমিই ব্রহ্ম, ‘তত্ত্বমসি’ – তুমিই সেই, ‘সর্বং খলু ইদং ব্রহ্ম’ – এ সবকিছুই ব্রহ্ম, ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ – এই আত্মাই ব্রহ্ম, ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ – প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই বস্তুজগৎ দ্বারা বদ্ধ নাম ও রূপের সমস্ত মায়ার আবরণ ভেদ করে মানুষকে তার হৃদয়ের অন্তরাত্মাকে উপলব্ধি করতে হবে। এর জন্য চাই কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনা, নিরন্তর অভ্যাস, নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় এবং চিত্তশুদ্ধি ও শুদ্ধমন। আত্মজ্ঞানই অধ্যাত্মজীবনের ফলশ্রুতি। আত্মজ্ঞান মানুষকে নিয়ে চলে মুক্তির পথে। যিনি সত্যকে জানতে পারেন তাঁকে আর বারবার এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হয় না। তিনি জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্তিলাভ করে জন্মহীন, ক্ষয়হীন, অনাদি-অনন্ত, চিরন্তনকে লাভ করেন। ব্রহ্মই মানুষের প্রকৃত স্বরূপ, তার যথার্থ বাসগৃহ, যার মধ্যে সে চির-আশ্রয় লাভ করে। মুক্তি সকল মানুষের জন্মগত অধিকার। এর জন্য চেষ্টা করতে হবে। শারীরিক মুক্তি, মানসিক মুক্তি ও আধ্যাত্মিক মুক্তিই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। উপনিষদ্ সেই মুক্তির উপায় বলে দেয়। প্রথমে চাই শারীরিক চাহিদার পরিপূর্তি। তারপর মানসিক শক্তি ও নৈতিক গুণাবলীর উৎকর্ষের দ্বারা দেহের চাহিদাকে অতিক্রম করতে হবে। নিজেকে আরও উন্নত করে এগিয়ে যেতে হবে আধ্যাত্মিকতার পথে। যে আত্মোপলব্ধি মনুষ্যজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য তার জন্য দেহ, মন ও বুদ্ধি এই তিনকেই শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্বাস, নির্ভীকতা ও মুক্তিই সাধকের প্রতি উপনিষদের মূল নির্দেশ। উপনিষদের মহাবাণীগুলিকে ভারতবর্ষের জনমানসে গ্রথিত করবার আকুল চেষ্টায় স্বামীজী বলেছেন: ‘উপনিষদ্ সকল জাতির, সকল মতের, সকল সম্প্রদায়ের দুর্বল দুঃখী পদানতদের উচ্চরবে আহ্বান করে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে মুক্ত হতে বলে। মুক্তি বা স্বাধীনতাই – দৈহিক স্বাধীনতা, মানসিক স্বাধীনতা, আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা – উপনিষদের মূলমন্ত্র।’ মানুষকে এই সান্ত (স+অন্ত) জড়জগতের ঊর্ধ্বে উঠে আত্মোপলব্ধি ও আত্মজ্ঞানের দ্বারা চৈতন্যের চিরন্তনতায় অবশ্যই প্রবেশ করতে হবে। এই হলো উপনিষদের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রধান বাণী।
(লেখক: সমীর কুমার বসু, শিলিগুড়ি)