দিলারা রুমা’র উপন্যাস নাইওরীঃ উদাসী জীবন আখ্যান
মুস্তাফিজ সৈয়দ
“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত -যৌবনা যদি তেমন বই হয়।” তাই বোধ করি খৈয়াম তার বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি।” – সৈয়দ মুজতবা আলী
সময় ছুটে চলে সময়ের প্রয়োজনে, পৃথিবীতে আজ আছি তো কাল নেই কিন্তু মানবসৃষ্ট সাহিত্য শিল্পকর্ম থেকে যাবে যতদিন পৃথিবী থাকবে। মানুষের চিন্তা,ভাবনা,কথার সংরক্ষণই তার বেঁচে থাকার এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। আমাদের জীবন যাপনের রূপ বৈচিত্র্যময় আখ্যান। মানব জীবনজুড়ে মিশে আছে সুখের অঝর শ্রাবণধারা আবার আমাদের আঙিনায় জীবন-যাপনের প্রান্ত সীমানায় উঁকি মারে কষ্টের কাঠফাটা রোদ্দুর। মানুষের ইতিহাসই সভ্যতার রূপায়ন, আমরা সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সভ্যতা যখন বিকশিত পুষ্পপল্লবে জীবনের মৌ-বনে, আমাদের জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে জীবনপথের নানা অববাহিকায় নানামুখী প্রেক্ষাপটের বিলাসী ছন্দে। সভ্যতা যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলছিল তখন মানুষও এগিয়ে ছলছিল কেননা মানুষের জন্যই সভ্যতার যাবতীয় উৎকর্ষতা। কালের পরিক্রমায় সভ্যতার সূচনালগ্ন হতে মানুষ শুধুই বস্তুগত বিষয়াবলীর উপর নির্ভর করেনি বরং খুঁজে নিয়েছে জীবনের আনন্দ, প্রাণোজ্জ্বল সহজ সরলতা অর্থবহতায় শৈল্পিকতার নানন্দিক ছোঁয়া। আদম-মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ভাষা এটি আপনাদের সবারই জানা।
ধ্বনি, শব্দ,ভাষা এই তিনে বাঙালি খুঁজে নেয় আশা। ধ্বনি, শব্দ,ভাষার বিবর্তন ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জন্ম হয়েছে সাহিত্য শিল্পের, এসব সজীব করেছে মানব হৃদয়ের নিরব শ্মশান। সাহিত্য মানুষের অভিজ্ঞতাপূর্ণ সত্যময় ও কল্পিত সুগঠিত প্রকাশ আর এই অভিজ্ঞতাপূণ সত্যতা,কল্পনা মানুষের কাছে চিরসৌন্দর্য, চিরযৌবনা বয়ে চলা এক নিরব নদী। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে বলেছেন, “মানুষের অভিজ্ঞতার জগৎই শিল্প সাহিত্যের অবলম্বন।”
প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় কথাসাহিত্যিক দিলারা রুমা বিরচিত নিটোল সৌন্দর্য রূপ লাবন্যের অপরূপ গ্রামবাংলা, হাওর, বাওর, প্রকৃতি ও বাউল মনের উদাসী আউলা পবনসহ মানবজীবনের নানাবিধ ঘটনার বিন্যাসে অনবদ্য উপন্যাস নাইওরী। মহামতি প্লেটোর উক্তির সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হয় নাইওরী উপন্যাসটি অবশ্যই মানুষের অভিজ্ঞতার এক জগৎ। নাইওরী উপন্যাস সম্পর্কে অনেক কিছু বলাই যাবে, পরবর্তী বক্তারা বিস্তর আলোচনা করবেন তবে এর আগে আমাদের একটু পিছন ফিরে পা রাখি ফেলে আসা সেই পথে যে পথে পড়ে আছে জীবনস্মৃতি, জীবনীশক্তি।
আমরা ভুলে যাই আমাদের সোনালী অতীত, সোনালী অতীতই ভবিষত্যের বিজয়মঞ্চ গড়ে তুলে। আমরা পিছু ফিরে পা রাখব উপন্যাস গঠনকালের সবুজ আঙিনায়, জীবন মরণের যোগ-বিয়োগ সমীকরণে। শিল্প-সাহিত্য পাড়ায় সমালোচনা-আলোচনা, ঘরোয়া আড্ডায় অন্যতম যা তার মধ্যে প্রথমেই নাম আসে উপন্যাসের।
উপন্যাস আধুনিকালের গদ্যময় ব্যঞ্জনাপূর্ণ এক প্রতিমা। ‘উপনয়’ বা ‘উপন্যস্ত’ শব্দ থেকে ‘উপন্যাস’ শব্দের উৎপত্তি, যা ইংরেজি Novel শব্দের পরিভাষারূপে গৃহীত। সাধারণ অর্থে উপন্যাস বলতে গদ্যে লিখিত দীর্ঘ উপস্থাপনাকে বোঝায়, ছোটগল্পের তুলনায় উপন্যাসের বিস্তৃতি অধিক। উপন্যাস রচনায় ব্যক্তিচেতনা ও সমাজচেতনা অপরিহার্য। সার্থক উপন্যাসে কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র, বর্ণনাভঙ্গি, রস, সংলাপ, ভাষা ইত্যাদির মাধ্যমে মূলত লেখকের জীবনদর্শন ও জীবনানুভূতিই প্রকাশ পায়। উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিতে সমগ্র মানবজীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।
বাংলা উপন্যাসের প্রথম ইঙ্গিত আসে রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যদ্বয়ে এবং পুরাণ নির্ভর সাহিত্যকর্মে। আরো বলা যায় দশকুমারচরিত, বৃহৎকথা, কথাসরিৎসাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কাদম্বরী ইত্যাদি সংস্কৃত গদ্য কাব্য এবং পালি ভাষায় রচিত জাতক কাহিনীতেও উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান লক্ষ্য করা যায়। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের উদ্ভব মূলত উনিশ শতকের প্রথম দিকে এবং এর উদ্ভব এর মূলে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব।
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নববাবু বিলাস নামের স্যাটায়ারিক তথা ব্যঙ্গাত্মক নকশা রচনা করেন তার মধ্যে প্রথম বাংলা উপন্যাসের লক্ষণ ফুটে ওঠে। ১৮৫৮ সালের প্যারীচাঁদ মিত্র টেকচাঁদ ঠাকুরের ছদ্মনামে আলালের ঘরের দুলাল নামক যে ব্যঙ্গাত্মক নকশাটি রচনা করেন তাতে উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য, চরিত্র ও সামাজিক চিত্র যথার্থভাবে অঙ্কিত হয় যদিও উপন্যাসের কলা-কৌশলের ত্রæটি পরিলক্ষিত হয় কিন্তু কালের স্্েরাতের একের পর এক ঔপন্যাসিক উপন্যাস রচনা করে গেছেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে শত বর্ষের ফেরারী শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র ১ম বাংলা সাহিত্যের কায়া তথা শরীর নির্মাণ ও তাতে কান্তি যোজনা করেছিলেন। ‘নাইওরী’ উপন্যাসের প্রবন্ধপাঠে এসব উল্লেখ জরুরী যদি এগুলো আপনারা অনেকেই জানেন।