হোলি ও দোল উৎসবের ইতিকথা এবং মাহাত্ম্য

0
339

হোলি ও দোল উৎসব দুটিকে অনেকেই এক মনে করলেও বাস্তবে উৎসব দুটি ভিন্ন।দুটি উৎসব একই দিনে হওয়ায় অনেকেই বিষয় দুটিকে আলাদা ভাবতে নারাজ।আবার অনেকেই দুটোকেই এক বিষয় বলে মনে করেন।তাহলে প্রিয় পাঠক চলুন দেখে নেয়া যাক দুটি উৎসবের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাটা কি।

হোলি উৎসবের ইতিহাস

বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ ঘেঁটে যতদূর জানা যায় দৈত্যরাজ হিরণ্যকশ্যপুর বধ কাহিনিতে ভক্ত প্রহ্লাদ অসুর বংশে জন্ম নিয়েও পরম ধার্মিক ছিলেন। তাঁকে যখন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও হত্যা করা যাচ্ছিল না তখন হিরণ্যকশ্যপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ হোলিকা এই বর পেয়েছিল যে আগুনে তাঁর কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু অন্যায় কাজে শক্তি প্রয়োগ করায় হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করলে বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুণ্ড থেকেও অক্ষত থেকে যায় আর ক্ষমতার অপব্যবহারে হোলিকার বর নষ্ট হয়ে যায় এবং হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, সেই থেকে হোলিকা পতন প্রথার শুভারম্ভ হয় এবং ঠিক তখন থেকেই হোলি কথাটির উৎপক্তি হয়। হোলিকা পতনের দিনটি ছিল পূর্ণিমার দিন। তখন ভক্ত প্রহ্লাদ দ্বারা পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার মহিমা বর্ষণ হয়েছিল হোলিকা বধ। সেই থেকে আজঅব্দি সনাতনী সমাজ এই পূর্ণিমাতে হোলি পালন করে আসছে। কিন্তু হোলি কোনও সনাতনী শাস্ত্র ও গ্রন্থিয় উৎসব নয়। তৎকালীন এক ভক্তের দীর্ঘায়ু ও অধর্মীর বিনাশ সরুপ, সনাতনী সমাজ হোলিকার নামে হোলি উৎসব পালন করে আসছে। অঞ্চল ভেদে হোলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সংপৃক্ত লোককথার ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু উদযাপনের রীতি এক। বাংলায় আমরা বলি ‘দোলযাত্রা’ আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে ‘হোলি’। রঙ উৎসবের আগের দিন ‘হোলিকা দহন’ হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে। শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একটা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয়। যা ছিলো হিরণ্যকশ্যপুর বোন হোলিকা পতন ও হোলিকার দাহ করার উৎসব। পরের দিন রঙ খেলা অর্থাৎ সনাতনী সমাজের ভক্ত প্রহ্লাদ পুনর্জীবিত হওয়ার আনন্দ প্রকাশ।

দোল উৎসব

বিশ্বমুক্তকোষ উইকিপিডিয়া হতে জানা যায়
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির বা গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। সেই থেকেই দোল উৎসব শুরু হয় আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।

কিভাবে চালু হলো উৎসব দুটি

কিভাবে এলো এই উৎসব দুটি ? অনেকেরই জানা নেই হয়তো সঠিক ইতিহাসটি। দোলযাত্রা বা হোলির সাথে মিশে আছে ধর্মের সব পৌরাণিক কাহিনী এবং লোকবিশ্বাস। আছে বিষ্ণু, দৈত্য, রাধা-কৃষ্ণের আখ্যান-উপাখ্যানের নানা পুরাকথা।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আর্য জাতি সূচনা করেছে রঙ খেলার। আবার এমনটাও জানা যায় যে, খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে থেকেই হোলি ও দোলযাত্রা উদযাপিত হয়ে আসছে এই ধরায়। প্রাচীনকালের পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্যে নাকি এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। দোলের কথা লেখা আছে পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরাণেও। ৭০০ শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতে দোল উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে দোল উৎসবের নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে বলে দাবি করেন বিশ্বাসীরা। তাহলে বলতে হয়, হোলি তথা দোল উৎসব বেশ প্রাচীন একটি উৎসব।

দোল ও হোলি উৎসবের মাহাত্ম্য

১। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে হোলিকার ভস্মে টিকা দিলে চোখের দোষ, গ্রহের বাধা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

২। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে হোলিকা দহনের পরে রেখে যাওয়া ছাই বাড়িতে নিয়ে এসে লাল কাপড়ে বেঁধে ভল্টে রাখলে আশীর্বাদ পাওয়া যায় এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ বন্ধ হয়।

৩। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, আপনার প্রিয় দেবতা/পরিবারের দেবতা/দেবতার সাথে হোলি খেলেও সুখ ও সমৃদ্ধি আসে। এই কারণে, হোলি উপলক্ষ্যে, সবার আগে তাদের রঙের অফার করা হয়।

৪। বিবাহে সমস্যা হলে তা দূর করতে হোলির দিনে একটি পানের ওপর একটি সুপারি ও এক পিণ্ড হলুদ রেখে শিবলিঙ্গে অর্পণ করুন এবং শ্রী শিব দরিদ্র দহন স্তোত্র পাঠ করুন।

৫। ভক্তি ভরে দোল উৎসব পালনে ভগবান সন্তোষ্ট হন এবং এতে জীবের পূণ্য লাভ হয়।

হোলির আট দিন আগে হোলাষ্টক হয়। এই সময়ে সমস্ত শুভ কাজ বন্ধ হয়ে যায় কারণ এই সময়ে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্রহের নেগেটিভ শক্তিগুলি বৃদ্ধি পায়। হোলি খেলার একদিন আগে হোলিকা দহন করা হয় বাংলায় যা ন্যাড়াপোড়া নাম পরিচিত। এই হোলিকা দহনের হল মন্দের ওপর ভালোর জয় অর্থাৎ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয় উৎসব।

সবশেষে বলা যায় হোলি ও দোল উৎসব দুটি সনাতন সসাজে বহুকাল পূর্ব থেকে শুরু হয়ে এখনো বর্তমান রয়েছে।উৎসব দুটিতে একদিকে যেমন সনাতনী সমাজ আনন্দে বিহ্বলিত হয় তেমনি উৎসব দুটিতে মানুষের মন ও পবিত্র হয়।শুদ্ধাচারে দোল উদযাপনে পূন্য লাভ ও মনোবাঞ্চা পূর্ণ হয়।

লেখক

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন সনাতন শাস্ত্রগ্রন্থ ও অনলাইন পত্রপত্রিকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে