শিক্ষক লাঞ্চনা কি সর্বানন্দদের আনন্দের খেলা?

0
181

শিক্ষক লাঞ্চনা কি সর্বানন্দদের আনন্দের সৌখিন খেলা ?

জীবন কৃষ্ণ সরকার:
গত কিছুদিন ধরে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই জন শিক্ষককে মারধর ও লাঞ্ছিত করার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়ে আসছে বারবার। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে শিক্ষকের মত অসহায় প্রাণী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আর থাকবেইবা কেনো,পৃথিবীতে শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও একই গোত্রের। নিজে অত্যচারিত হবে তবু অন্যের দুঃখের কথাই সে বলে যাবে প্রতি মূহুর্ত, বলে যাবে মেহনতি মানুষের কথা অবিরত।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা দুটি আলাদা পেশা হলেও একটি জায়গায় একশতে একশ মিল। আর তা হল তাঁরা নিজে শত বঞ্চনার শিকার হয়েও স্বপ্ন দেখান সমাজের বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের
ভাগ্য উন্নয়নের, প্রতিজ্ঞা করেন বলবান করতে
সম্বলহীনদের। পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী
আছে যারা সারা জনম অন্যের উপকারার্থে জীবন উৎসর্গ করবে বিনিময়ে প্রাপ্তির ঝুড়ি শুন্য নিয়েই ফিরতে হয় তাদের। সময়ের বিবর্তনে শিক্ষক এবং সাংবাদিকরা যেন সেই স্থানটিই দখল করে নিয়েছে আজ আপন মনে। তা কেবল সম্ভব হয়েছে স্বার্থপর, লোভী, বিবেক বর্জিত আজকের এই সমাজ ব্যাবস্থার কারণে।
আমি একজন শিক্ষক, একজন কবিতার মানুষ। কবিতা আমার প্রাণের খোঁড়াক। যখনই একটু সময় পাই কবিতা লিখে যাই আপন মনে। কলাম লেখার অভ্যাস আমার নেই।কিন্তু শিক্ষক লাঞ্চনার খবরটি একজন শিক্ষক হিসেবে সত্যিকার অর্থেই আমাকে মর্মাহত করেছে। তাই কলাম লিখার নামে মূলত ব্যতীত বোবা লোকের মতো আর্তচিৎকার করার চেষ্টা করছি মাত্র।
যাহোক এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। গত ০৩/০৩/১৬ ইং রোজ বৃহষ্পতিবার ধর্মপাশা উপজেলার নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালেয়র সভাপতি সর্বানন্দ তালুকদার
ঐ বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষিকা দিপালী রানী দাস ও মনি রানী দাস কে বেধরক মারধর করে বলে খবরে প্রকাশিত হয়। এমন কি বিভন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে মহিলাদের গায়ে মারধরের চিহ্নের ছবিও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রশাসন নিরব ভুমিকা পালন করছে। যা আমাদের সমগ্র শিক্ষক সমাজের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং দূঃখজনক। কিন্তু তাতে কি এরকম ঘটনা তো আর একটি দুটি নয় পত্রিকার পাতা উল্টালেই অথবা অনলাইন ব্রাউজ করলেই নিমিষেই চোখের সামনে ভেসে
আসে এমন সংবাদ। বারবারই সর্বানন্দরা জয়ী হয়, নিরবে নিভৃতে সবকিছু সহ্য করতে হয় মনি রানী আর দিপালী রানীদের। গত বৃহষ্পতিবারের ঘটনাটিকে আমি নিছক ঘটনা হিসেবে ভাবতে পারছিনা। এর শিকড় একদিনে তৈরি হয়নি। যুগ যুগ ধরে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র যন্ত্রের যে অবহেলার মনোভাব তা থেকেই মূলত আজকের সর্বানন্দরা এই ধরণের ন্যাক্কার জনক কান্ড গুলো ঘটাতে পারছে। কারণ তারা জেনে গেছে পৃথিবীতে শিক্ষকরা এমনই আজব প্রাণী যাদেরকে কটু কথা বললেও ন্যায় নীতি বোধের কারণে সবই সহ্য করবে মুখ বুজে। যার ফসল হিসবেই শিক্ষক সমাজকে ভুগতে হচ্ছে আজ বারেবারে। আজকে আমরা যদি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি লক্ষ করি তাহলে দেখব যে সরকার সকল
চাকুরীজীবিদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করলেও
শিক্ষকদের বেলায়ই যত নয় ছয় অবস্থা। নতুন
স্কেলে সকল চাকুরীজীবিদের বেতন শুরু
হলেও এম. পি. ও. ভুক্ত শিক্ষকদের ফেব্রুয়ারী,
মার্চ দেখানো হচ্ছে এখনো। উপরন্তু স্বল্প
আয়ের ঐ সকল শিক্ষক যারা কিছু সংখ্যক ছাত্র/ ছাত্রী পড়িয়ে সামান্য রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করতো সেটাও এখন বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার শিক্ষা উন্নয়নের হাই প্রজেক্টের নামে। এই যখন অবস্থা সর্বানন্দরা আর হাতগুটিয়ে বসে থাকবে কেনো? তারাও মেতে উঠেছে শিক্ষক লাঞ্চনার মত সর্ব আনন্দের সৌখিন খেলায়। অত্যন্ত দুঃখের সাথেই সৌখিন শব্দটা এখানে বললাম কারণ” বিচার হীনতার রাজ্যে বিবেক হীনতাও যে একপ্রকার তুমুল শখেরই অংশ! “যখন দেখি অনেক অখ্যাত
ব্যাক্তিরাও শিক্ষক লাঞ্চিত করে পত্রিকা খ্যাত
হয়েছে, শাস্তির বদলে তারা হয়েছে আরো
মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব! তখন আমাদের আর কি-ই বা বলার থাকে। শিক্ষক লাঞ্চনার ফিরিস্তি আজ আর আমার লেখা সম্ভব হচ্ছেনা। কারণ এটা লিখতে গেলে আরো শতেক লাইনের পৃথক একটি কলাম লিখতে হবে যা আজ একেবারেই সম্ভব নয়।সময়ে সুযোগে কোন দিন লিখব বলে আশা রাখি। আমি শুধু সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ দিয়েই ক্ষান্ত থাকছি আজ। আমরা দেশবাসী জানি যে গত কয়েক মাস আগে প্রকাশ্যে দিবালোকে সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখক, কলামিস্ট, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল স্যারকে চাবুক মারার ঘোষণা দিয়েছিল একটি গোষ্ঠী। সেটিরই আজ পর্যন্ত কোন
প্রতিবাদমূলক বিবৃতি পাওয়া যায়নি কোন দায়িত্বশীল মহল থেকে। গুটি কয়েক ছাত্র/ছাত্রী ব্যতীত আর কারো মুখে টু শব্দটিও বেরোয়নি এখনো। তেমনিভাবে প্রিন্সিপাল ননীগোপাল দাস লাঞ্চনা, প্রফেসর হারুনর রশিদ হত্যা, বারহাট্টায় প্রাথমিক শিক্ষক হত্যা, কোনটিরই সুষ্ঠু সমাধান হয়নি এ পর্যন্ত। আর সর্বশেষ গত তিন মার্চ দিপালি রানী ও মনি রানী লাঞ্চনার ঘটনা। এগুলো আগের ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতার ফল বৈকি? যদি পূর্বের ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হত তাহলে আজকের সর্বানন্দরা আর নতুন ঘটনার জন্ম দিতে পারতো না। একটি বাস্তব ঘটনার কথা বলছি।তখন আমি সিলেটে শাবিপ্রবিতে অনার্স চতুর্থ বর্ষ পড়ি। একদিন এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয় আমার। তিনি এখন একটি লাইব্রেরী পরিচালনা করেন। তাঁর মুখের করুণ কথা
শুনে আমার চোখে জল এসে গেল। সিলেটরই
একটি খ্যাতনামা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি। পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পাল করতে গিয়ে তিনি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির রোষানলে পড়েন। সর্বশেষ, বিদ্যালয়ের মহান শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাঁকে। এরকম হাজারো উদাহরণ দেশের আনাচে কানাচে।গত কয়েকদিন আগেও শিক্ষকদের সম্পর্কে বলা হলো ” তাঁদের জ্ঞান কম, জ্ঞানের অভাবে তারা আন্দোলন করছে” যে শিক্ষকরা মন্ত্রী, এমপি তৈরি করে তাঁদেরই কিনা জ্ঞান কম! ভেরি স্যাড! তথাকথিত সুশীল সমাজও রইল নিরব দর্শকের ভুমিকায়। আজব দেশের আজব নীতি। এ জন্যই বুঝি আমার দেশের দামাল ছেলেরা রক্ত ঢেলেছিল, জীবন দিয়েছিল একাত্তরে। উক্ত কথার প্রেক্ষিতে জনৈক এক ব্যক্তির একটি কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে গেল। মনের দুঃখ প্রকাশ করতে তিনি সেদিন বলেছিলেন ” ওহে জ্ঞান সমুদ্র! তোমার যে সময় হয়েছে জ্ঞান পুকুর থেকে জ্ঞান নেয়ার! ” তাঁর এই কথাটি ঝকঝকে হয়ে রইল আমার মানস পটে আজো। এভাবেই চলছে একের পর এক শিক্ষক লাঞ্চনার মহড়া,সাক্ষী কেবল মহাকাল। যাহোক খবরে দেখলাম গত ৬ ই মার্চ ধর্মপাশা উপজেলা সদরে শিক্ষক লাঞ্চনার প্রতিবাদে মানব বন্ধন করেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সেটি একটি ভালো উদ্যোগ। এর মধ্য দিয়ে হয়ত কিছুটা হলেও এধরনের ঘটনা হ্রাস পেতে পারে।
১০ মার্চ ‍দেশব্যাপী কর্মসূচি ডেকেছে বাংলাদেশ
প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক সমিতি। আমি বিশ্বাস করি একজন শিক্ষক মানে সে কি প্রাথমিকের, মাধ্যমিকের নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের তা খোঁজার দরকার নেই। তাঁর আসল পরিচয় তিনি একজন শিক্ষক। তাই এধরনের ঘটনা মুকাবেলায় সকল স্থরের শিক্ষকবৃন্দ সম্মিলিত ভাবে প্রতিবাদের সামিল হলে এসব ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই কমে যাবে। সেই সাথে আমি
সরকার, প্রশাসন সবার কাছে শিক্ষকদের বিষয়ে একটু বিশেষ নজর দেয়ার আহ্বান জানাই। তাই সকল শিক্ষকদের বলব, আসুন আমরা সবাই একই ফ্রেমে বন্ধী হই। একের দুঃখে অন্যজন সাড়া দিই। তাহলেই কেবল আমাদের দুর্দশা কিছুটা লাঘব হতেপারে, ফিরে পেতে পারি আমাদের সুষ্ঠু জীবন ব্যবস্থা।

লেখকঃসহকারী শিক্ষক (গণিত), লায়েছ ভূঁইয়া
উচ্চ বিদ্যালয়, দাতিয়াপাড়া, বংশীকুন্ডা, সুনামগঞ্জ।

Published by ( www.dpnews24.co
m ) on March 8,
2016

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে