কৃষকের কান্না,দায়ী কি কেবল বিধাতা?

0
103

কৃষকের কান্না, দায়ী কি শুধুই বিধাতা?

জীবন কৃষ্ণ সরকার :
কয়েকদিন ধরেই একের পর এক হাওরডুবির খবর পত্র-পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে আসছে বার বার। দেখতে দেখতে দেশের অন্যতম হাওরগুলোর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির
হাওর, মাটিয়ানের হাওরসহ প্রায় সবক’টি হাওরই এখন অথৈ জলের দখলে। সপ্তাহখানেক আগেও ‘সুনামগঞ্জের হাওর জুড়ে হাহাকার, ভেঙে যাওয়ার পথে টাঙ্গুয়ার হাওরের বাঁধ, শনির হাওরের বাঁধ’ ইত্যাদি শিরোনামে
পত্রিকায় বার বার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েনি। যার ফল হিসেবেই আজ একের পর এক তলিয়ে গেল জেলার প্রায় সবক’টি হাওর। এতে কে লাভবান হলো? এতে কি শুধু
কৃষকরাই ক্ষতি গ্রস্থ হলো? আপনার আমার কি কোন ক্ষতি হয়নি? এতে কি সরকারের কোন ক্ষতি হয়নি? আজকে আপনি- আমি যারা চাকরি করছি, যারা উচ্চাসনে বসে পা নাড়াচ্ছি হাওর ডুবিতে কি আমাদের কিছুই যায় আসে না? আজ যে বা যারা কৃষকের করুণ
কান্না দেখে মুচকি হাসি হাসছেন তাদের জন্য বলি, সেই হাসি বেশি দিন টিকবে না। মনে রাখবেন যম যখন দোয়ারে এসে দাঁড়ায় তখন কাউকেই ছাড় দেয়না। ঠিক তেমনি দেশে যখন অভাব, দারিদ্রতা, দূর্ভিক্ষ দেখা দেবে তখন আপনি, আমি, বড় বড় পদবীধারি কেউই বাঁচতে পারবো না। আমার কথাগুলো শুনে বিরক্ত বোধ করতে পারেন অনেকেই, কিন্তু এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাও মনে রাখবেন আমরা কৃষকের সন্তান, আমার বাবাও একজন প্রান্তিক চাষী। তাই আমরানবুঝি কৃষকের বুকের কষ্ট, মুখের কষ্ট। আমাদের মনাই নদীতে যখন পানি প্রবেশ করছিল তখনও সরোজমিনে দেখলাম, শুনলাম
কৃষক- কৃষাণীর অশ্রুসজল চোখে কান্নার রোল। তখনও বলতে শুনলাম আমার পল্লী জননীর কণ্ঠে ‘মা গঙ্গা রক্ষা করো, বাবা শাহ আরেফিন, বাবা শাহজালাল রক্ষা
করো।’ আরো বলতে শুনলাম ‘মা গঙ্গা এবার পাঁঠা গ্রহণ করেননি, মা গঙ্গা এবার বিমুখ হয়েছে তাই এবার আর রক্ষা নেই। মানুষের পাপের সংখ্যা বেড়ে গেছে তাই আল্লাহ বাঁধ ভেঙ্গে এবার নিজের হাতে শাস্তি দেবেন’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। কথা বলছিলাম মনাইপাড়ে চল্লিশোর্ধ এক কৃষাণী সালেহা বেগমের সাথে। যিনি ধানের মায়ায় নিজ হাতেই কাঁচি দিয়ে ধান কাটছিলেন হাঁটু পানিতে নেমে। চোখে-মুখে কান্নার ছায়া। তিনি বার বার বলছিলেন ‘এবার আমরা বেশি পাপ করেছি, এজন্যই আমাদের কপাল পুড়েছে, এ জন্যই আল্লাহর গজব পড়েছে।’ তেমনি মনাই পাড়ের আরেকজন কৃষক সুব্রত সরকার বলছিলেন ‘যে বছর ফসল বেশি হবে সে বছর
ফসল ঘরে তুলা যাবে না, এটা বিধাতারই
খেলা।’ বাহ! কি সুন্দর প্রবোধ এই সহজ সরল চাষী
সালেহা ও সুব্রতদের। এতেই খালাস আমাদের দূর্নীতির বরপুত্রদের। তাও ভালো এসব সহজ- সরল কৃষকরা সহজেই বুঝে নিচ্ছে ইহা আল্লাহ, মা গঙ্গা’র গজব বা শাস্তি। কিন্তু আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের
ব্যক্তিরা কি জবাব দিবেন আপনাদের আধুনিক শিক্ষিত সন্তানদের কাছে? হ্যাঁ, আপনাদেরকেই বলছি এই সহজ সরল অসহায় মানুষগুলো কি জানে এই গজব, শাস্তি
এড়ানোর পেছনে প্রায় ৯৫ ভাগই মানুষের হাত রয়েছে। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা একটু সচেতন হলেই এ ধরনের গজব/ শাস্তি সহজেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একজন কৃষক শ্রমে,
ঘামে শুধু ফসলই বুনেন না, তাঁদের স্বপ্নও বুনেন। যেভাবে একজন পিতা তার সন্তানকে যখন যা দরকার দিনের পর দিন তা দিয়ে লালন-পালন করে নিজের স্বপ্ন পুরণের জন্য। আর সেই সন্তান যদি লাশ হয়ে ফিরে ঘরে তা কি কোনো পিতা মানতে পারবে? ক্ষণেক্ষণে সার, সেচ দিয়ে পুত্র স্নেহে গড়ে তোলা পুত্রতুল্য ধানগুলো হারিয়ে যাওয়ার বেলায় কৃষকের মনের অবস্থা, কষ্ট, বেদনা পুত্রহারা পিতার চেয়ে কি কোনো অংশে
কম? কত কষ্ট সহ্য করবেন তাঁরা? কি দিয়ে শান্তনা দেয়া যাবে তাঁদের? হাওর পাড়ের মানুষগুলো সাধারণত এক ফসলের উপর নির্ভরশীল। আর সেই ফসল যদি
তলিয়ে যায় অথৈ জলে তাহলে কি খেয়ে বাঁচবে, কি দিয়ে পড়া-লেখা করাবে তাদের সন্তানদের? কিভাবেই হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ? জানি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর
দেওয়ার সাধ্য এই মূহুর্তে কারো নেই। তাই বিধাতাকে দোষ দিয়েই ক্ষান্ত হতে হবে তাঁদের। তবে এটাও সত্য, ভাগ্য অনেক কিছুই নির্ধারণ করে কিন্তু ব্যক্তিগত ইস্যু হলে এটা আমার মানতে বাঁধা নেই, তবে সমষ্টিগত ইস্যুর
ক্ষেত্রে আমি সেটা মানতে পারছিনা। একটি নির্দিষ্ট এলাকার সকল মানুষই পাপী হয়ে যাবে, কি আশ্চর্য! এটা কি কখনো বিশ্বাসযোগ্য? আমি বলছিনা আমাদের সরকার কিংবা স্থানীয় প্রতিনিধিরা কোনো উদ্যোগই
নেননি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সেক্টরে যখন ব্যর্থতা আসবে তখন দায়ভার তো তাকেই নিতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে হাওরবাসীর পক্ষ থেকে একটি হাওর মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বার বার সরকারের কাছে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু কে শুনবে এই ক্রন্দন? যার মাশুল হাড়ে হাড়ে গুনতে হচ্ছে নিরীহ হাওরবাসীদের। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়গণ
ভুলে যাবেননা এরাও এদেশেরই নাগরিক। এদেরও অধিকার আছে এদেশে সুষ্ঠু ভাবে বেঁচে থাকার। স্বাধীনতা যুদ্ধে এরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের জন্য নিজের
মায়া ত্যাগ করে। যাক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে তিনি বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মের ছুটিটা পরিবর্তন করে এখন মঞ্জুর করেছেন হাওর এলাকার কৃষকদের কথা ভেবে। সত্যিকার অর্থেই এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সাধুবাদ জানাই। তবে আশা রাখি
আমাদের ন্যয্য দাবি মেনে নিয়ে অনতিবিলম্বে “হাওর মন্ত্রনালয়” গঠণ করে সরকার হাওরবাসীদের প্রতি সদয় হবেন। সেই সাথে ফুটিয়ে তুলবেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলদেশের প্রতিটি কৃষকের, প্রতিটি পল্লী জননীর মুখে মুখে অনাবিল হাসি।

–লেখকঃ জীবন কৃষ্ণ সরকার
সহকারী শিক্ষক (গণিত),
লায়েছ ভুঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়, দাতিয়া পাড়া,
বংশীকুন্ডা, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ।

প্রথম প্রকাশঃ ২০/০৪/১৭ dpnews24.com এ প্রকাশিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে