লুৎফুন্নাহার জেসমিন

0
83

দুর্নিবার জেসমিন

___________ রোমেনা লেইস

বাবা-মা শখ করে মেয়ের নাম রাখলেন বদরুন্নেসা। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের নাম ডাকার বিকৃতিতে হয়ে গেলো” বদুরা”। হ্যাঁ, ডাঃ লুৎফুন্নাহার জেসমিন এর কথাই বলছি। যে বদুরা নামে পরিচিত। জন্ম যদিও সুনামগঞ্জ জেলার পেরুয়া গ্রামের বক্তারপুর পাড়ায়, কিন্তু বেড়ে উঠা সুনামগঞ্জ শহরে বাবার চাকুরীর সুবাদে। জীবনের প্রথম দুই আড়াই বছর নরসিংদী জেলায় কেটেছে বাবা অধ্যাপক মোঃ আব্দুর রশীদ সাহেবের চাকুরীর সুবাদেই। বাবার মতোই চেহারা,বাবার মতোই তোতলানো। সুনামগঞ্জ শহরে হেটে গেলে দেখেই সবাই চিনে ফেলতো” ও তুমি রশীদ স্যারের মেয়ে না? ছোট বেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলো। বাবা প্রফেসর আব্দুর রশীদ ছিলেন সুনামগঞ্জ কলেজের প্রাণীবিদ্যা র অধ্যাপক। মা রাহেনা বেগম ছিলেন গৃহিনী। মেয়ের তোতলানোর জন্য মুখ থেকে ” অ” “আ” ইত্যাদি মেয়ের মুখ থেকে বের করতে পারতেন না। কিন্তু সুনামগঞ্জ শহরের শিক্ষানুরাগী মোহাম্মদ আলী স্যার প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলেছিলেন জেসমিনসহ আরও কয়েকজন বাচ্চা নিয়ে। স্যারের বড় মেয়ে ঐ স্কুলের টিচার ছিলেন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্কুলে অসম্ভব মেধাবী মেয়েটি ‘অ আ ক খ/A B C D ইত্যাদি খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেললো।শিক্ষক ওকে দুই মাসের মধ্যেই ১ম শ্রেনী থেকে ২য় শ্রেনীতে প্রমোশন দিয়ে দেন। কি কারণে যেন স্কুলটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপরের সেশন এর মাঝামাঝি সময়ে শহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরতিদির কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে ২য় শ্রেণীতে ভর্তি হয় ১৯৭০ইং সালে। পরের বছর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে অটো প্রমোশনে ১৯৭২ সালে ৪র্থ শ্রেনীতে ওঠে। ৫ম শ্রেণীতে জুঁই আপা ক্লাস টিচার ছিলেন। বরাবরই ক্লাসে প্রথম হওয়া জেসমিন ৫ম শ্রেনী পাশ করে ৬ষ্ট শ্রেনীতে নূতন স্কুলে ভর্তি হলো । ৬ষ্ট শ্রেনী থেকে ৭ম শ্রেণীতে ৫ম স্থান অর্জন করে। এরপর থেকে রেকর্ড পরিমান মার্কস পেয়ে বরাবরই ১ম স্থান অর্জন করে। সরকারী সতীশচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ে ১৩ বৎসর পরে জুনিয়র বৃত্তি অর্জন করে জেসমিন । সে কুমিল্লা বোর্ডে মেধা তালিকায় ৫ম স্থান অর্জন করে। স্কুলে একজন দিদি ছিলেন যাকে কেউ কোনোদিন হাসতে দেখেনি সেদিন তিনি প্রাণ খুলে হেসেছিলেন। এসএসসি তে ১৯৭৯ সালে ৫টি বিষয়ে লেটার (পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, সাধারন গনিত,ইলেকট্রিভ ম্যাথ,ইসলামীয়াত) পেয়ে ১ম বিভাগে উত্তির্ন হয়।এইচএসসি ইডেন মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সনে ১টি বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস (৭৫৬)পেয়ে উত্তির্ন হয়।বুয়েট এ পড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দুই দুইবার ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য্য হয়। তবে নিরাশ না হয়ে পরে মায়ের প্রচন্ড আগ্রহে ১৯৮৩ সনে সিলেট মেডিকেল কলেজ ভর্তি হয়ে ১৯৮৯ সনে এমবিবিএস, ১৯৯০ সনে ইন্টার্নিশিপ শেষ করে। জীবনে কখনো কখনো সাফল্য না পেলে ভেঙ্গে পড়তে হয় না। অপেক্ষায় মিলে যে সফলতা তার স্বাদ অবশ্যই মিষ্ট।

১৯৯১ সনে সরকারি চাকুরীতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এ মেডিকেল অফিসার হিসেবে সুনামগঞ্জ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে যোগদান যা স্থানীয় ভাবে মাতৃমংগল নামে পরিচিত। চাকুরী জীবনের ১ম সাড়ে আট বৎসর সুনামগঞ্জ কাটিয়ে ১৯৯৯ সনে সিলেট বদলী হয়ে বিভিন্ন পজিশন চাকুরী করে বর্তমানে সিলেট জেলার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক হিসাবে কর্মরত। ১৯৯১ সালে সহপাঠী ডাঃ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।দুই সন্তান। ১ম সন্তান সৈয়দ তানজিম মোবাররাত বুয়েট থেকে পাশ করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করছে। ২য় সন্তান—সৈয়দা আতিয়া তাহসিন ।মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও ইন্টার্নিশিপ শেষ করে এখন সিলেটে।

একজন নারীর পাশে আরেকজন নারী যদি সহায়তার হাত বাড়ান, তাহলে চলার পথটা একটু বেশি মসৃণ হয়। মা ও শ্বাশুরীর কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো।

জেসমিন বললো রোল মডেল হতে চাইলে ভালো কাজ করতে হবে। আর নারীর ক্ষমতায়নে পুরুষদেরও সচেতন করতে হবে। স্বামী যদি বলেন, স্ত্রীকে বাইরে কাজ করতে দেবেন না, তবে ওই নারীর সংগ্রামটা আরও বেড়ে যায়। জেসমিন সংসার এবং এডমিনিস্ট্রেটিভ চাকুরী সামলিয়ে নিজের প্রফেশনাল ক্যারিয়ার সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৯৭-১৯৯৮ সনে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে EOC কোর্স সম্পর্ন করে। ২০০৪ সনে DGO(Diploma in Gynaecology & Obstetrics) অর্জন করে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু করেন। আমি তার স্বামী সন্তানসহ সুস্থ সুন্দর জীবন কামনা করছি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে