রুহিঙ্গা নয় ওরা মানুষ

0
122

রোহিঙ্গা নয় ওরা মানুষ

লিখাটা এমন এক সময় লিখছি যখন কেবল সারা দেশই নয়, বলা যায় পুরু বিশ্বটাই এখন রুহিঙ্গা ইস্যুতে জড়িয়ে পড়েছে।প্রতি দিনকার খবরের কাগজগুলোই তার প্রমাণ।আর বাংলাদেশ তো এর কেন্দ্র বিন্দুতেই রয়েছে।যাহোক বিবেকের তাড়নায় এতদবিষয়ে আজ দুচারটি কথা আপনাদের শেয়ার করতে বসছি।

রুহিঙ্গা কারা?

রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উলেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং , মংডু, কিয়কতাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা, কাইউকপাইউ, পুন্যাগুন ও পাউকতাউ এলাকায় এদের নিরঙ্কুশ বাস। এছাড়া মিনবিয়া, মাইবন ও আন এলাকায় মিশ্রভাবে বসবাস করে থাকে। বর্তমান ২০১৭ সালে, প্রায় ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করে। মায়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫লাখ সৌদিআরবে বাস করে বলে ধারনা করা হয় যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী। তাহলে ইতিহাস ঘাটলে এটাই প্রমানিত হয় যে এরা মায়ানমারেরই আদি জনগোষ্ঠী।যদিও পরে তারা ইসলাম ধর্মে দ্বীক্ষিত হয়েছে।তাই এদের বসবাসের অধিকার বার্মিজরা কেড়ে নিতে পারেনা।এটা মানবতার স্পষ্ট লঙ্ঘন।

গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাহ লক্ষ করলে,দেশি মিডিয়াগুলোর কথা যদি বাদও দেই আন্তর্জাতিক যেমন বিবিসি,রয়টার্স,ভয়েস অফ অ্যামেরিকা,ইত্যাদি মিডিয়াগুলোর কথাও যদি ধরি তবে একটি বিষয় অন্তত পরিষ্কার হওয়া যায় যে রুহিঙ্গাদের কোন দোষ ত্রুটির জের হিসেবে মায়ানমার এই হত্যা যজ্ঞ চালাচ্ছেনা বরং ওদের জাতিগত নির্মূলের উদ্যেশ্যেই নিরীহ রুহিঙ্গাদের হত্যা করছে বার্মিজ সরকার।এর প্রমাণ মিলাতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছেনা।যেমন- মায়ানমার বলছে সেনা চৌকিতে হামলা করে সেনা হত্যার প্রতিশোধের বদলা নিতেই তারা এমনটি করছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।কারণ গুটি কয়েকজন দোষী ব্যাক্তির জন্য পুরু জাতিকে নির্মূলের প্রক্রিয়া শুরু করা কোন সভ্য ব্যক্তি,সভ্য সমাজ তথা সভ্য জাতি সমর্থণ করতে পারেনা।এটা সম্ভব নয়।একটি সদ্যজাত সন্তান কখনো চেনেনা আরশা (ARSA-ARAKAN ROHINGYA SALVATION ARMY) কি, কখনো চেনেনা জঙ্গী হামলা কি? সুতরাং এমন নিঃষ্পাপ সন্তান গুলোকে হত্যা করার বিধান পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে লিপি বদ্ধ আছে কিনা আমার জানা নেই।আর শুধু সন্তানই নয় তাদের হাতে দুধের বাচ্ছা থেকে শুরু করে ছেলে বুড়ো , নারী সবাই নির্যাতিত,নিহত হচ্ছে।অতএব এটা নিঃসন্দেহে একটি জগণ্য অপরাধ। আর নিরীহ রুহিঙ্গা হত্যার মধ্য দিয়ে মায়ানমার যে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত হচ্ছে তা বলতে আর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।এর প্রমাণ ভুরি ভুরি।যাহোক একটি ছোট্ট প্রমাণ আপনাদেরকে দিচ্ছি।

মায়ানমার যেমন বৌদ্ধ রাষ্ট্র,শ্রীলংকাও তেমনি বৌদ্ধ রাষ্ট্র।অথচ শ্রীলংকার জাফনা দ্বীপের স্বাাধীনতা কামী দল LTTE (Leberation of Tamil Elom) তামিল টাইগার্স বাহিনীর কথা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাদের কে না জানে? বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্যতাবাদী গোষ্টীর মধ্যে তামিল টাইগার্স প্রথমটি।তাদের একটি পৃথক রেডিও ষ্টেশনও ছিল।জাফনায় তাদের জনসমর্থনও ছিল এমন কি বহির্বিশ্বে জনপ্রিয়তাও ছিল।ছিল নিজস্ব দখলকৃত এলাকা,অস্ত্র কারখানা।বলা হয়ে থাকে শ্রীলংকার সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমদাসা (১৯৯৩),ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট রাজীব গান্ধী (১৯৯১) হত্যার মাঝেও তামিল টাইগাররা জড়িত ছিল।কই ? তারা তো প্রতিশোধ নিতে নিরীহ জাফনাবাসীদের হত্যা করেনি।তারা তো কখনো নিরীহ হিন্দুদের দেশ থেকে নির্মূলের পরিকল্পনা করেনি? বরং তারা নিয়ম তান্ত্রিকভাবেই তামিল বাহিনীকে পরাস্ত্র করেছিল এবং তাদের নেতা ভেল্লুপিল্লাই প্রভাকরণকে হত্যার (১৮ মে,২০০৯) মধ্য দিয়ে তাদের বিজয় চিনিয়ে নিয়েছিল।তাদেরকে বলা যায় সাবাস।আর রুহিঙ্গাদের আরশা বাহিনীর তো না আছে জনসমর্থন,না আছে দখলকৃত এলাকা,না আছে অস্ত্রের সহজপ্রাপ্যতা তাহলে এমন একটা বাহিনীকে মোকাবিলা করতেই বার্মিজদের নিরীহ মানুষ হত্যা শুরু করতে হলো? এতে কি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা প্রমানিত হলো না? আর যদি সেটাই না হবে তাহলে নিশ্চই এটা একটা পরিকল্পিত হত্যা কান্ড? আর আজকের এই সভ্য সমাজে একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড কখনোই মেনে নেয়া যায়না।কোথায় জাতিসংঘ,কোথায় আসিয়ান,কোথায় সার্ক,কোথায় ওয়াইসি ? কোথায় মানবতার জিন্দাবতার আমেরিকা? আপনারা একবার এসে দেখে যান রুহিঙ্গাদের বাস্তব পরিনতি।

আজকের মায়ানমার ব্যবসা,বানিজ্য,রাজনীতি,অর্থনীতি কোনদিক দিয়েই একেবারে পিছিয়ে নেই।তবে মানবিকতার দিক দিয়ে যে ভিক্ষুকে পরিনত হয়েছে সেটা এখন আর কারো অজানা নয়।আমার এক পরিচিত বড় ভাই আক্ষেপ করেই বললেন-”এর চেয়ে যদি রুহিঙ্গাদের একবারে বোমা মেরে শেষ করে দিত তাইলেও ভাল হতো”।এর চেয়ে লজ্জার আর কি থাকতে পারে? কতটুকু মনে কষ্ট পেলে মানুষ এমন ভাবতে পারে তা সময় থাকতে বুঝা উচিত। ৭১ এ পাকবাহিনীর অত্যাচারের কথা দাদা,দিদির কাছে, শুনেছি,সিনেমা, টেলিফিল্মেও কিছুটা দেখেছি।তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে রুহিঙ্গা গনহত্যা যেনো বিশ্বের সকল রেকর্ড ছাড়ালো। বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে পদার্থ বিজ্ঞানের নিউটনের তৃতীয় সূত্রটির কথা মনে পড়ে গেলো।সূত্রটি নিম্নরুপঃ-”প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে”। এটা যদি সত্যি হয়(অবশ্যই সত্য) তবে এভাবে গন্যহত্যার পরিনাম পরম স্রষ্টা অবশ্যই আপনাদের দেবেন।খবরে প্রকাশ- ১ লক্ষ রুহিঙ্গা যুবক পাহাড়ে, গুহায়,জঙ্গলে ট্রেণিং নিচ্ছে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।স্ত্রী,সন্তান,মাতৃ-পিতৃহারা একজন যুবকের এমন প্রতিজ্ঞা হতেই পারে।তাদের স্পৃহা কি বন্দুক কামানে দমানো যাবে? এ দিকে আলকায়দাও হুমকি দিচ্ছে মায়ানমারকে দেখে নেয়ার।যদিও কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের হুমকি আমাদের কারো জন্যই সুখকর নয় তবু এদের হাতে এমন ইস্যু তুলে দেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হলো?এতে মায়ানমারের শান্তির বাতাস কি সমান্তরালে চলমান থাকবে? তাই বলা যায় শান্তি কখনো দ্বন্ধ দিয়ে নয় সন্ধি দিয়ে,মিল মহব্বত দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টি করতে হয়।এই কথাটি যত শীঘ্র বার্মিজরা উপলদ্ধি কতে পারবে ততই মঙ্গল।নতুবা অসময়ে ভোগতে হবে তাদেরকেই।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা ইতোমধ্যেই রুহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন,তাদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন এজন্য সাধুবাদ জানাই।”মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনের জন্য” ভূপেন হাজারিকার এই কথাটি যদি সত্য হয় তবে আমি বলব “ওরা রুহিঙ্গা নয় ওরা মানুষ”।আর তাই এমন বিপদে অবশ্যই আমাদের তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।তবে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত তাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করে নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে শীঘ্রই রুহিঙ্গাদের তাদের আবাস ভূমে ফিরিয়ে দেয়া উচিত নতুবা অতি আবেগে খাল কেটে কুমীর আনার সমান হয়ে যেতে পারে।তাই এব্যাপারে দলমতের ঊর্ধে থেকে আমাদের সকলেরই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিশেষে পরম স্রষ্টার কাছে সকল রুহিঙ্গা ভাই-বোনদের মঙ্গল কামনা করছি, সেই সাথে বার্মিজদের শুভ বুদ্ধির উদয় কামনা করছি।

লেখক-
জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

বিঃদ্রঃ লেখাটি ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে লেখা।তৎকালীল বঙ্গনিউজে প্রকাশ করা হয়েছিল।লেখাটি পূন সংরক্ষণের জন্য হাওরপিডিয়ায় প্রকাশ করা হলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে