মূর্তিপূজা কি?
ঈশ্বরের প্রতিরুপ কল্পনা করে কোন আকৃতি দান করে, ঐ আকৃতির মাধ্যমে পূজা করার নামই মূর্তি পূজা।
♠ হিন্দুশাস্ত্রে সরাসরি মূর্তিপূজা সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। তবে হিন্দুশাস্ত্রে মূর্তিপূজা করতে নিষেধও করা হয় নি।। গীতায় মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ নয়। হিন্দুশাস্ত্রে মূর্তিপূজা সম্পর্কে একদম সরাসরিভাবে কিছু বলা নেই। তবে হিন্দুশাস্ত্রে মূর্তিপূজা করতে নিষেধও করা হয়নি।।
★★ নিম্নে “শ্রীমদভগবদগীতা” এর আলোকে হিন্দুধর্মে মূর্তিপূজার বিষয়টি আলোচনা করা হলো—
♣♣ শ্রীমদভগবদগীতাতে “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ” বলেছেন—
*** সপ্তম অধ্যায় শ্লোক ২০-২৩:
১| কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।
(গীতা- ৭/২০)
অনুবাদঃ জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয়।
[[ তাৎপর্যঃ ]] এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে— জড়-জাগতিক মোহে আচ্ছন্ন ব্যক্তিরাই অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা অন্য কারো শরণাগত না হয়ে শুধু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই শরণাগত হন।।
২| যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধ্যাম্যহম্।।
(গীতা- ৭/২১)
অনুবাদঃ যে যে স্বকামীভক্ত যে যে দেবতাকে শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করে, আমি তাদের শ্রদ্ধা সেই সেই দেবতার প্রতি স্থির করি।
[[ তাৎপর্যঃ ]] এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন— যে যে ভক্ত যে দেবতাকে শ্রদ্ধাপূর্বক পূজা করে, ভগবান স্বয়ং সেই ভক্তের ভক্তি সেই দেবতার প্রতি স্থির করেন। কারণ ভগবান সব ভক্তকেই স্বাধীনতা দিয়েছেন। ভক্তের অধিকার আছে যে সে কোন দেবতাকে পূজা করবে।
কিন্তু ভগবান এটিও বলেছেন– ভক্ত ইচ্ছামতো যেকোনো দেবতাকে আরাধনা করতে পারে কিন্তু সেই আরাধনা তারাই করে যারা “অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন”।
তবে ভগবান গীতায় এটিও বলেছেন— যে যে ভক্ত তাকে যেভাবে পুজা করে ভগবান সেভাবেই তার পূজা গ্রহন করেন।
ভগবান ভক্তকে যেকোনো দেব-দেবীর পূজা করার অধিকার দিয়েছেন।।
৩| স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হি
তান্।। (গীতা- ৭/২২)
অনুবাদঃ সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেব-বিগ্রহের পূজায় তৎপর হন এবং সেই দেবতার মাধ্যমে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন।
[[ তাৎপর্য ]] : এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন— ভক্ত যে দেবতারই পূজা করুক না কেন ভক্ত দেবতার নিকট যে “বর” বা “বস্তু” পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই সেই ভক্তের আরাধ্য দেবতার মাধ্যমে ভক্তের ইচ্ছা পূরণ করেন। কারণ পরমেশ্বর ভগবানের অনুমোদন ছাড়া কোনো দেব-দেবীই কাউকে কিছু দিতে পারেন না।
দেব-দেবীরা আমাদের বরদান ও আশির্বাদ দিতে পারেন। কিন্তু “মোক্ষ” দিতে পারেন না।
একমাত্র ঈশ্বরই আমাদের “মোক্ষ” দান করতে পারেন।।
৪| অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি
মামপি।। (গীতা- ৭/২৩)
অনুবাদঃ অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের আরাধনার ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন।
[[ তাৎপর্য ]] : এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বোঝাতে চেয়েছেন অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা যে অন্য দেবতাদের আরাধনা করে সেই দেবতাদের থেকে প্রাপ্ত ফল বা প্রাপ্ত বস্তু অস্থায়ী।
যারা অন্য দেব-দেবীর আরাধনা করে তারা মৃত্যুর পর “দেবলোক” প্রাপ্ত হন। কিন্তু ভগবানের ভক্তরা মৃত্যুর পর “গোলোক” প্রাপ্ত হন। যেমন: যারা শনির উপাসনা করে তারা “শনিলোক” প্রাপ্ত হন। যারা সূর্য উপাসনা করে তারা “সূর্যলোক” প্রাপ্ত হন। যারা শিব উপাসনা করে তারা “শিবলোক” বা “কৈলাস” প্রাপ্ত হন। কিন্তু এগুলো সবই অস্থায়ী। পরে তাকে আবার পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে। আর যদি কেউ একবার “গোলোক” প্রাপ্ত হয় তবে তার আর কখনো পৃথিবীতে জন্ম নিতে হয় না।
*** নবম অধ্যায় শ্লোক ২৩:
৫| যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্।। (গীতা- ৯/২৩)
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! যারা অন্য দেবতাদের ভক্ত এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাদের পূজা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা অবিধি পূর্বক আমারই পূজা করে।
[[ তাৎপর্য ]] : এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বোঝাতে চেয়েছেন যারা অন্য দেবতাদের শ্রদ্ধা সহকারে পূজা করে তারা আসলে শ্রীকৃষ্ণেরই পূজা করে। কিন্তু তা বিধিসম্মত নয়। তাই ভগবান পূর্বের শ্লোকগুলোতে বলেছেন যে ভক্ত অন্য দেবতার পূজা করে সে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি।
{{ উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে এটিই বোঝা যায় যে– ভগবান কখনই কোনো শ্লোকে মূর্তি পূজা করতে নিষেধ করেন নি। তিনি বলেছেন অন্য কোনো দেবতার শরণ না নিয়ে তার (শ্রীকৃষ্ণের) শরণ নিতে এর যথার্থ কারণও তিনি বলেছেন। আর ভগবান যদি মূর্তি পূজা করতে নিষেধই করতেন তাহলে আমরা শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতাম কীভাবে? কারণ আমরা যে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করি সেটাওতো মূর্তির মাধ্যমেই। }}
★ পবিত্র বেদে বলা হয়েছে–
১| নমস্তে পরমং ব্রহ্ম
সর্বশক্তিমতে নমঃ।।
নিরাকারোহপি সাকারঃ
স্বেচ্ছারুপং নমো নমঃ।
(যজুর্বেদ, শান্তি পাঠ)
অনুবাদঃ যিনি পরম ব্রহ্ম, যিনি সর্বশক্তিমান, নিরাকার হয়েও সাকার, ইচ্ছামত রূপধারী, তাকে নমস্কার করি।
[[ তাৎপর্যঃ ]] এখানে দেখা যাচ্ছে যজুর্বেদে বলা হয়েছে— পরম ব্রহ্ম বা ঈশ্বর নিরাকার হয়েও সাকার।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে– ঈশ্বর নিরাকার। কিন্তু তিনি আবার সাকার রূপও ধারণ করতে পারেন। তাই সনাতন ধর্মে ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য নিরাকার ও সাকার দুটি পদ্ধতিই স্বীকৃত।
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦
[[ আর হিন্দুরা দেব-দেবীর মূর্তিকে “ঈশ্বর” মনে করে না। হিন্দুরা শুধুমাত্র সেই মূর্তিকে দেব-দেবীর “প্রতীক” ছাড়া আর কিছু মনে করে না।
হিন্দুরা সেই দেব-দেবীর মাধ্যমে “অবিধিপূর্বক” ঈশ্বরই পূজা করে। ]]
[[ এছাড়াও নিরাকার ঈশ্বরকে ধ্যানের মাধ্যমে উপাসনা করা হয়। কিন্তু সবাই সেটা পারে না। কারণ- ধ্যানে মনোসংযোগ করা খুবই কঠিন।
তাই দেব-দেবীদের মূর্তির মাধ্যমে সাকাররুপে পূজা করা হয়। যেটা সবার পক্ষেই করা সম্ভব। কারণ- কোন দেব-দেবীর মূর্তি সামনে থাকলে মনে “শ্রদ্ধা” ও “ভক্তি” সহজেই আসে। আর গীতায় বলা হয়েছে— ঈশ্বরের নিরাকার রূপের চেয়ে সাকার রূপের উপাসনা করাই ঈশ্বরের উপাসনার শ্রেষ্ঠ উপায়।]]
তাহলে মূর্তিপূজা করতে দোষ কোথায়?
সুতরাং নিঃসন্দেহে এটি বলা যায় যে, হিন্দুধর্মে মূর্তিপূজা স্বীকৃত।
বিঃদ্রঃ পাঠকের বুঝার স্বার্থে উপরোক্ত আলোচনায় মূর্তিপূজা শব্দটি বহার করা হয়েছে।আসলে হিন্দুরা মূর্তি নয় মূর্তির মাধ্যমে প্রতিমাপূজা করে।মূর্তির মাধ্যমে মন্ত্রোচ্চারণ করে যখন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন সেটি হয় প্রতিমা।সনাতন হিন্দুরা মূলত প্রাণ সম্বলিত প্রতিমারুপ ঈশ্বরের পূজা করে থাকে।