মূর্তি নয় প্রতিমা পূজা করেন হিন্দুরা

0
538

লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহিত:

মূর্তিপূজা কী? হিন্দুরা কি মূর্তিপূজা করে?

হিন্দুধর্ম মতে মূর্তিপূজা বলে কিছু হয় না, হিন্দুরা যে পূজা করে তা আসলে প্রতিমাপূজা। (আসলে ঠিক তাও যে নয়, তা পরে বোঝা যাবে।) হিন্দুধর্মে প্রতিমা আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য করা হয়। কোনো বস্তুর মধ্যে যখন ভগবানের অস্তিত্ব আহ্বান করা হয় এবং তাকে স্বয়ং ভগবানের প্রতীক মনে করা হয় তখন তাকে ‘প্রতিমা’ অথবা ‘শ্রীবিগ্রহ’ বলে। অর্থাৎ আপনার শোকেসে যেটা রাখা আছে সেটা অবশ্যই মূর্তি, কিন্তু যে মুহূর্তে বিশেষ পূজার মাধ্যমে তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় সেই মুহূর্ত থেকে সেটা হয়ে যায় শ্রীবিগ্রহ। এটা হিন্দুধর্মের আচার-বিশ্বাস।

প্রতিমাপূজা হলো প্রতীকের মাধ্যমে বিশেষভাবে প্রার্থনা করা। বিশেষভাবে শ্রদ্ধার সাথে সৃষ্টিকর্তার শক্তির আহ্বান করাকেই পূজা বলে। যেমন, নির্বাচনে কোনো একটি প্রতীককে ভোট দেয়া হয়, যার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে কোনো দল বিজয়ী হয় এবং দলের প্রধান তার মাধ্যমেই সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হন। এখানে যেমন সত্যিকার অর্থে প্রতীক বা অন্য কোথাও ভোট দেওয়া হয় না, তেমনি কোন ছবি, কাগজ বা প্রতীকের নয়, পূজা করা হয় দেবদেবীর, চূড়ান্ত অর্থে ঈশ্বরের গুণ ও আদর্শকে।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু, কাঠ, মাটি দিয়ে গড়া মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে হয়ে যায় আত্মহারা।’ ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে মূর্তিপূজা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘Hindus are not idol-worshipers. They are ideal-worshipers.’ অর্থাৎ, হিন্দুরা মূর্তি পূজারী নন, তারা আদর্শের পূজারী। মূর্তি হল একটি আদর্শের প্রতীক।

হিন্দু শাস্ত্র মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। হিন্দু দর্শন বলে, ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন স্রষ্টা নাই, তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা। প্রাচীন ঋষিগণ বলে গিয়েছেন, ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই (নিরাকার ব্রহ্ম) তাই তিনি অরূপ, তবে তিনি যে কোন রূপ ধারণ করতে পারেন। কারণ তিনিই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। ঋগ্বেদে বলা আছে ঈশ্বর ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’- ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বর সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে তিনি ‘অবাঙ্মানসগোচর’ অর্থাৎ ঈশ্বরকে কথা (বাক), মন বা চোখ দিয়ে ধারণ করা যায় না, তিনি বাহ্য জগতের অতীত। ঈশ্বর সম্পর্কে আরো কিছু উদ্ধৃতি-

১. ছান্দোগ্য উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ২ নম্বর পরিচ্ছেদের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে- ‘একাম এবাদ্বিতীইয়ম।’ অর্থ- ‘স্রষ্টা মাত্র একজনই দ্বিতীয় কেউ নেই।’

২. শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬ নম্বর অধ্যায়ের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে- ‘না চস্য কসুজ জানিত না কধিপহ।’ অর্থ- ‘সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের কোন বাবা-মা নেই, তাঁর কোন প্রভু নেই, তাঁর চেয়ে বড় কেউ নেই।’

৩. ‘একং সদ বিপ্র বহুধা বদন্তি’ (ঋগ্বেদ, ১/৬৪/৪৬) অর্থাৎ ‘সেই এক ঈশ্বরকে পণ্ডিতগণ বহু নামে ডেকে থাকেন।’

৪. যজুবেদের ৩২ নম্বর অধ্যায়ের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে- ‘ন তস্য প্রতিমা আস্তি’ অর্থ- ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সাথে কারও তুলনা হয় না।’

৫. যজুবেদের ৪০ নম্বর অধ্যায়ের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নিরাকার ও পবিত্র।’

৬. ‘একং সন্তং বহুধন কল্পায়ন্তি’ (ঋগ্বেদ, ১/১১৪/৫) অর্থাৎ ‘সেই এক ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে।’

৭. ‘দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত’ (ঋগ্বেদ, ১০/৭২/৭) অর্থাৎ ‘দেবতারও পূর্বে সেই অব্যক্ত (ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগত উৎপত্তি লাভ করেছে।’

৮. যজুর্বেদের ৪০.১, ‘এই সমস্ত বিশ্ব শুধু মাত্র একজন ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্টি ও পরিচালিত হচ্ছে। ”যিনি কখনই অন্যায় করেন না অথবা অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনের ইচ্ছা রাখেন না।

৯. ঋগ্বেদ ১০.৪৮.৫, ‘ঈশ্বর সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করেন। তিনি অপরাজেয় এবং মৃত্যুহীন ও এই জগতের সৃষ্টিকারী।’

১০. যজুর্বেদ সংহিতা ৩২.১১, ‘ঈশ্বর যিনি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর মধ্যে তিনি অধিষ্ঠিত।’

১১. ঋগ্বেদ সংহিতা ১০.৪৮.১ ‘ঈশ্বর যিনি সর্ব্বত্রই ব্যাপ্ত আছেন।’

দেবদেবীগণ ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণ। অর্থাৎ জগতের সব গুণের (Quality) আধার তিনি। আবার ঈশ্বর সগুণও কারণ সর্বশক্তিমান।ঈশ্বর চাইলেই যে কো্নো গুণের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুণের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন। দেবদেবীগণ ঈশ্বরের এই সগুণের প্রকাশ। অর্থাৎ ঈশ্বরের একএকটি গুণের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি যেকোনো রূপে সাকার হতে পারেন, কারণ, তিনি সর্বক্ষমতার অধিকারী।

হিন্দুশাস্ত্র মতে মানুষ কখনোই ঈশ্বরের বিশালতা বা অসীমতাকে তার সসীম চিন্তা দিয়ে বুঝতে পারবে না। বরং সর্বগুণময় ঈশ্বরের কয়েকটি বিশেষ গুণকেই বুঝতে পারবে। আর এ রকম এক একটি গুণকে বুঝতে বুঝতে হয়ত কোন দিন সেই সর্ব গুণময়কে বুঝতে পারবে। আর মূর্তি বা প্রতিমা হল এসকল গুণের রূপকল্প বা প্রতীক। এটা অনেকটা গণিতের সমস্যা সমাধানের জন্য ‘x’ ধরার মতো। আদতে x কিছুই নয় কিন্তু এক্স ধরেই গণিতের সমস্যার উত্তর পাওয়া যায়।

অথবা ধরুন জ্যামিতির ক্ষেত্রে কোনো কিছু বিন্দু দিয়ে শুরু করা হয়। কিন্তু বিন্দুর সংজ্ঞা হলো যার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ নাই, কিন্তু অবস্থিতি আছে- যা আসলে কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ এই বিন্দুকে আশ্রয় করেই প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা থেকে হিমালয়ের উচ্চতা সব মাপা যায়।

আবার ভূগোল পড়ার সময় একটি গ্লোব রেখে কল্পনা করা হয় এটা পৃথিবী। আবার দেয়ালের ম্যাপ টানিয়ে বলা হয় এটা লন্ডন, এটা ঢাকা, এটা জাপান। কিন্তু ওই গ্লোব বা ম্যাপ কি আসলে পৃথিবী? অথচ ওগুলো দেখেই পৃথিবী চেনা যায়। তেমনি মূর্তির রূপ কল্পনা বা প্রতিমা, স্বয়ং দেবদেবী নন, তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প মাত্র। এগুলো রূপকল্প হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ সম্পর্কে ধারণা দেয়, শেখায় ঈশ্বর সত্য। সব শেষে পরম ব্রহ্মের কাছে পৌছাতে সাহায্য করে। হিন্দু ধর্মে পূজা একটি বৈশিষ্ট্য। কল্পনায় দাঁড়িয়ে সত্যে উত্তরণই পূজার সার্থকতা বলে মনে করা হয়।

হিন্দুরা মনে করেন, সব ধর্মেই রূপকল্প, চিহ্ন বা প্রতীক আছে, যা তাঁদের কাছে পবিত্র। যেমন, খ্রিস্টানদের গির্জায় মাতা মেরী বা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিমা থাকে, যার সামনে তাঁরা নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেন। আবার মুসলিমরা কাবাশরীফের কালো পাথরকে পবিত্র মনে করে চুম্বন করে কিংবা কোন কাগজে আরবিতে আল্লাহ লেখা থাকলে তাকে সম্মান দেন, তাকে যেখানে সেখানে ফেলে দেন না। তাহলে ওই কাগজখানা কি আল্লাহ নিজে? না। কিন্তু তারপরও তাকে সম্মান করে কারণ তা আল্লাহর নাম, ওটা দেখে আল্লাহর কথা মনে আসে, তার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়।

হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিলো বিমূর্ত ধ্বনি রূপে। পরে তা কালির হরফে কাগজে লিপিবদ্ধ করা হয়। এটি কোরআনের মূর্ত রূপ। আধুনিক যুগে এর অসংখ্য প্রতিলিপি প্রিন্ট করা হচ্ছে। এই কপি বা প্রতিলিপি কিংবা কালির লেখা কোনোটাই তো সত্যিকার কোরআন নয়। বরং কালির হরফের লেখার মধ্যে যা নিহিত রয়েছে, তাই কোরআন। কিন্তু এই কাগুজে কোরআনকেই মুসলমানরা পবিত্র মনে করেন, একে সম্মান করেন, শ্রদ্ধা করেন। এর কোনো ধরনের অসম্মান বা অবমাননা সহ্য করতে পারেন না। কারণ এটি আল্লাহর কালাম বা বাণী ধারণ করেছে। মূর্তির ক্ষেত্রে হিন্দুদেরও ঠিক এমনই হয়।

হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। নিরাকার ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নাই, থাকা সম্ভবও না। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলা হয় নিরাকারবাদী। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদী। গীতায় বলা আছে, যারা নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর প্রাপ্ত হন। তবে নির্গুণ উপাসকদের কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার ব্রহ্মে মনস্থির করা স্বভাবগতভাবে অস্থিরমতি বলে মানুষের পক্ষে খুবই ক্লেশকর। কিন্তু সাকারবাদীদের সাকার ভগবানের উপর মনস্থির করা তুলনামূলক সহজ। এই সাকার ভগবানের চাহিদা মেটায় মূর্তিগুলো।

হিন্দুরা নিজেদের পৌত্তলিক মনে করেন না। তারা মনে করেন অন্য ধর্মের লোকেরা তাদের দর্শন সম্পর্কে ভালো মতো না জেনেই ‘মূর্তিপূজা’(?) দেখে মন্তব্য করে বসেন, হিন্দুরা পৌত্তলিক। কিন্তু সঠিক দর্শন জানলে তাঁদের এ ভুল ধারণা ভাঙবে বলে বিশ্বাস করেন তারা।

আগেই বলা হয়েছে, হিন্দুদের দেবতা অনেক কিন্তু ঈশ্বর এক। ঈশ্বরের কোনো প্রতিমা নেই। দেবতারা হলেন ঈশ্বরের এক একটি রূপের বা গুণের প্রকাশ। মূর্তি বা প্রতিমা হলো সে সকল গুণের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প মাত্র।

মূৃর্তিপূজা আসলে একটি Misnomer বা ভুলনাম। পূজায় মূর্তি ব্যবহার করা হয়, মূর্তির পূজা করা হয় না।

।।সংগৃহিত লেখা।।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে