মহাভারত প্রশ্ন উত্তর
১) মহাভারতের রচয়িতার নাম কি?
মহাভারতের রচয়িতা হলেন মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ ব্যাস বা সংক্ষেপে ব্যাসদেব।
মহাভারতের অপর নাম লিখ ?
মহাভারতেই মহাভারতকে দেয়, ভারত, বেদ, সংহিতা? ইতিহাস প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। আবার মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা শত সহস্র হওয়ার জন্য এর অন্য নাম শতসাহস্রী সংহিতা।
২ ) মহাভারতের ভাগগুলি কি নামে চিহ্নিত বা অভিহিত?
মহাভারতের ভাগগুলি পর্ব নামে চিহ্নিত বা অভিহিত হত।
মহাভারতের কয়টি পর্ব ও কি কি
মহাভারতে আঠারোটি পর্ব আছে। সেগুলি হল যথাক্রমে- আদিপর্ব, সভাপর্ব, বনপর্ব, বিরাটপর্ব, উদোগ পর্ব, ভীষ্ম পর্ব, দ্রোন পর্ব, কর্ন পর্ব, শল্যপর্ব, সৌক্তিক পর্ব, স্ত্রীপর্ব, শান্তি পর্ব, অনুশাসন পর্ব, অশ্বমেধিক পর্ব, আশ্রমবাসিক পর্ব, মহাপ্রস্থানিক পর্ব, স্বর্গারোহন পর্ব।
৩) মহাভারতের এরকম নামের তাৎপর্য কি ?
উ:=> বিপুল কলেবর ও বিষয় মাহাত্মের জন্য মহাভারতের “মহাভারত” বলা হয়। মহাভারতেই এ সম্পর্কে বলা হয়েছে – “মহত্বাদ্ ভারবত্ত্বাচ্চ মহাভারত মুচ্যতে”।
মহাভারতের শ্লোক সংখ্যা কত ?
মহাভারতের শ্লোক সংখ্যা এক লক্ষ।
৪) মহাভারতের রচনার সম্ভাব্য স্তরগুলির উল্লেখ কর ।
এখন যে আকারে মহাভারত পাওয়া যায় তাতে একথা স্পষ্ট যে, এই মহাগ্রন্থ কোনো একজনের দ্বারা কোনো এক বিশেষ কালে রচিত হয়নি, পর্যায়ক্রমে রচিত ও সংক্রমিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই স্তরগুলি হল-
ক) প্রথম স্তর- আনুমানিক ৭০০- ৫০০ খৃ: পূর্বাব্দ।
খ) দ্বিতীয় স্তর- আনুমানিক ৫০০-২০০ খৃ: পূর্বাব্দ।
খ) তৃতীয় স্তর- আনুমানিক ২০০-৩৫০ খৃ: পূর্বাব্দ।
৫) মহাভারত কাহিনী কোন্ তিনজন ব্যক্তি কর্তৃক কতবার বিবৃত হয়েছে ?
উ:=> মহাভারতের আদিপর্বে বলা হয়েছে যে, মহাভারত কাহিনী তিনবার তিনজন ব্যক্তি কর্তৃক বিবৃত হয়েছে। প্রথমে স্বয়ং ব্যাসদেব মহাভারত কাহিনী নিজ শিষ্য বৈশম্পায়ণকে শুনিয়েছিলেন, দ্বিতীয়বার বৈশম্পায়ণ মহারাজ জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে জন্মেজয়কে সেই গল্প শুনিয়েছিলেন। তৃতীয়বার লোমহর্ষনের পুত্র সৌতি শৌনক প্রভৃতি ঋষিদের নৈমিষারন্যে সেই কাহিনী শুনিয়েছিলেন। সৌতি-বর্ণিত কাহিনীই বর্তমান মহাভারত।
৬) মহাভারতে মোট কতগুলি অধ্যায় আছে ?
মহাভারতে আঠারোটি পর্বে মোট ১৯২৩ টি অধ্যায় আছে।
মহাভারতের কয়টি সংস্করন পাওয়া যায় ?
মহাভারতের প্রধান সংস্করণ দুটি উত্তর-ভারতীয় ও দক্ষিণ ভারতীয় । উত্তর ভারতীয় সংস্করণ মুম্বই থেকে এবং দক্ষিণ ভারতীয় সংস্করণ কুম্ভকোনম্ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই দুটি সংস্করণের কোনোটিই খুব প্রামান্য নয়। ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে পন্ডিত প্রবর ভি.এস.সুকথংকরের সুযোগ্য সম্পাদনায় পুনের ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত সংশোধিত সংস্করনটি মহাভারতের সবচেয়ে প্রামান্য সংস্করন।
৭) মহাভারতের অগ্রগতির বিভিন্ন স্তরের নাম কর।
উ:=> মহাভারতকে বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় পাই তাতে তাকে এই অবস্থায় পৌঁছতে কয়েকটি স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। কোন কোন সমালোচকের মতে সেই তিনটি স্তর হল:-
ক) জয়-কেবলমাত্র কুরু-পান্ডব-পাঞ্চালদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী। এই পর্বের শ্লোকসংখ্যা -৮৮০০।
খ) ভারত বা ভারত সংহিতা– এই অংশে অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাহিনী অর্থাৎ দুষ্যন্ত-শকুন্তলা, নল-দময়ন্তী প্রভৃতি মহাভারতের কাহিনী ও উপাখ্যান যুক্ত হয়েছে।
গ) মহাভারত ১৮টি পর্বে বিভক্ত ও এক লক্ষ শ্লোক সমন্বিত।
৮) মহাভারত মূলত: কয়শ্রেনীর রচনা পরিদৃষ্ট হয় ?
উ:=> মহাভারতে তিন শ্রেনীর রচনা পাওয়া যায়-
ক) সৌত রচনা(Bard Poerty)- এখানে কুরূপান্ডবের মূল কাহিনী বিবৃত।
খ) সৌত রচনা (Bratimanical Myths And Legends) এতে জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ, রুরু-প্রমদ্বরা, মনু-মৎস্য কথা, সাবিত্রী-সত্যবান প্রভৃতি অতিরিক্ত আখ্যান-উপাখ্যান প্রভৃতি সন্নিবিষ্ট হয়েছে। এসব কাহিনীর মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণদের মাহাত্ম্য প্রভৃতি প্রতিপাদিত হয়েছে।
গ) যতি, ভিক্ষুক ও শ্রমনদের রচনা(Ascetic Poetry) এগুলিতে নীতি – ধর্মসংক্রান্ত বিষয় বিভিন্ন কাহিনীর মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে আবার তিনশ্রনীর রচনা আছে- Fable.Parable এবং Maral Narrative.
৯) ব্যাসকূট কি ?
উ:=> ব্যাসদেব মহাভারত রচনা করতে প্রবৃত্ত হলে লেখার ব্যাপারে সমস্যা দেখা দেয়। তখন শ্রীগনেশের সংঙ্গে লেখার বিষয়ে কথা হয়। গনেশ লিখবেন । কিন্তু গনেশ এই শর্তে লিখতে সম্মত হলেন যে, তিনি লেখার সময় এক মুহূর্ত থাকবেন না। বিচক্ষন ব্যাসদেব ও গনেশকে এই শর্ত দেন যে, না বুঝে তিনি কিছু লিখতে পারবেন না। ব্যাসদেব মাঝে মাঝে এমন জটিল ও দুরূহার্থযুক্ত শ্লোক বলতেন – যার অর্থ উদ্ধার করতে গনেশের সময় লেগে যেত। সেই অবসরে ব্যাস পরবর্তী অংশ ভেবে নিতেন। ব্যাসদেবের এরকম জটিল সমস্যাপূর্ণ শ্লোকই “ব্যাসকূট” নামে পরিচিত।
১০) ব্যাসদেব তাঁর যে পাঁচজন শিষ্যকে মহাভারত কাহিনীর পাঠ বা আবৃত্তির শিক্ষা দান করেন, তাঁদের নাম উল্লেখ কর।
উ:=> ব্যাসদেব মহাভারতের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের জন্য তাঁর রচিত কাহিনী তাঁর প্রিয় পাঁচ শিষ্যকে উভয়ক্ষেত্রেই যাবতীয় বিবাদের মূলে রমনী । একজন অপহৃতা, অন্যজন লাঞ্ছিতা-নারীত্বের অবমাননা উভয়েই। একজনকে উদ্ধার করার পর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন, অন্য জনের অপমানের জন্য প্রতিশোধ গ্রহনের পর রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন। উভয় রমনীই বীর্যলভ্যা একজনকে হরধনু ভঙ্গ করে, অন্যজনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যভেদ করো।
১১) মহাভারত ও রামায়ণের মধ্যে কোনটি পূর্ববর্তী ?
উ:=> রামায়ণ মহাভারতের পূর্ববতী । কারন,
I) মহাভারতে রাম কাহিনীর উল্লেখ আছে।
Ii) রামায়ণের সভ্যতা ও সংস্কৃতি মহাভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে প্রাচীনতর রামায়ণে আর্য-অনার্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব ও প্রতিষ্ঠার কথা বিবৃত, আর মহাভারতে আর্যসভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত,
Iii) রামায়ণ আদি কাব্য, বাল্মীকি আদিকবি এবং বিষ্ণুর দশাবতার প্রসঙ্গে রাম কৃষ্ণের পূর্ববর্তী,
Iv) ঐতিহ্য অনুসারে রামায়ণের সূর্যবংশ মহাভারতের চন্দ্রবংশ অপেক্ষা প্রাচীনতর।
১২) মহাভারতকে পঞ্চমবেদ বলা হয় কেন ?
উ:=> কালক্রমে বৈদিক সাহিত্যে জনগনের কাছে কঠিন হয়ে পড়ল । তখন ইতিহাস ও পুরানের মাধ্যমে বেদার্থ বোঝার ব্যবস্থা হল- “ইতিহাসপুরানাভ্যং বেদং সমুপবৃহংহয়েত”। ইতিহাস ও পুরানকে পঞ্চমবেদ বলা হত, কারন এগুলিতে সকলেরই অবাধ অধিকার ছিল, বেদে ছিল না। বিবিধ কাহিনীযুক্ত ও ইতিহাস পুরানের লক্ষনযুক্ত মহাভারতকেও তাই পঞ্চমবেদ বলা হয়েছে।
১৩) কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা মহাভারতের কতগুলি পর্বে বিবৃত হয়েছে ?
উ:=> কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মহাভারতের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এই ঘটনা মহাভারতের সাতটি পর্বে বিবৃত হয়েছে। সেই পর্বগুলি হল- উদ্যোগ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, সৌপ্তিক ও স্ত্রীপর্ব।
১৪) ভারতীয় সমাজে মহাভারতের প্রভাব আলোচনা কর।
উ:=> ভারতীয় সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জল ও বায়ুর মতো কালে কালে মহাভারত থেকে প্রাণসত্তার অপরিহার্য শক্তি আহরন করেছে। মহাভারতের জ্ঞাতিবিরোধ ভারতীয় সমাজে খুবই পরিচিত ঘটনা-যা আজও ঘটমান। ব্যাস, কৃষ্ণ, যুদিষ্ঠির, ভীষ্ম, কর্ণ, গান্ধারী প্রভৃতি চরিত্র ভারতবাসীর চির শ্রদ্ধার পাত্র। দ্রৌপদীর অগ্নিবর্ষী ব্যক্তিত্ব ভারতীয় রমনীর প্রেরনা স্বরূপ। মহাভারতে সত্য ও ন্যায়ের জয় ঘোষনা আজও ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করে।
১৫) বাংলা সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উ:=> মহাভারত কাহিনী অবলম্বনে বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখ্য- গিরিশচন্দ্র ঘোষের জনা, পান্ড গৌরব, পান্ডবদের অজ্ঞাত বাস, মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটক শর্মিষ্ঠা, পত্রকাব্য বীরাঙ্গনা, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় রচিত মহাকাব্য বৃত্রসংহার, রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, কাব্যনাট্য কর্ণকুন্তি সংবাদ, বিদায়-অভিশাপ,গান্ধারীর আবেদন প্রভৃতি। বুদ্ধদেব বসুর অনবদ্য আলোচনা গ্রন্থ মহাভারতের কথা, সুবোধ ঘোষের ক্লাসিক গ্রন্থ ভারত প্রেম কথা প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য।
১৬) মহাভারতের প্রসিদ্ধ বাঙালী টীকাকার ও তাঁর রচিত টীকার নাম কর।
উঃ=> মহাভারতের স্পনামধন্য বাঙালী টীকাকার মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ একজন সাহিত্য স্রষ্টাও। তাঁর রচিত টীকার নাম “ভারতকৌমুদী”।
১৭) মহাভারতের প্রসিদ্ধ টীকা কি ? তার রচয়িতার নাম কর।
উঃ=> মহাভারতের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ টীকা হল “ভারতভাবদীপ”। টীকাকারের নাম নীলকন্ঠ চতুর্ধরী(খৃঃ ১৭শ শতক) । এঁর টীকায় আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা প্রাধান্য লাভ করেছে।
১৮) মহাভারতের সবচেয়ে প্রাচীন টীকা কোনটি ?
পরিব্রাজক দেববোধ বা দেবস্বামী রচিত “উত্তানদীপিকা” বা “জ্ঞানদীপিকা” টীকাটি সম্ভবতঃ মহাভারতের উপর রচিত সবচেয়ে প্রাচীন টীকা। খৃঃ একাদশ শতাব্দীতে টীকাটি রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
মহাভারতের সবচেয়ে প্রাচীন টীকার রচয়িতার নাম ও কাল উল্লেখ কর।
আবার অনেকের মতে, খৃঃ একাদশ শতাব্দীতে সর্বজ্ঞনারায়ণ রচিত “ভারতার্থপ্রকাশ” টীকাটি সবচেয়ে প্রাচীন।
১৯) মহাভারতের অনন্য বৈশিষ্ট্য কি ?
উঃ=> পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও দেখা যায় না যে,একটিমাত্র গ্রন্থে একটি জাতির সমগ্র জীবন- তার সাহিত্য,সংস্কৃতি,ধর্ম,দর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি- সমস্ত কিছু সহ স্বার্থকভাবে প্রতিফলিত ও চিত্রিত হয়েছে। একমাত্র মহাভারতেই সমগ্র ভারতবর্ষের সামগ্রিক পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। এই খানেই মহাভারতের অনন্যতা।
২০) মহাভারত প্রসঙ্গে “ষট্ সংবাদ” শব্দটির অর্থ কি ?
উঃ=> মহাভারত কাহিনী ব্যাসদেব, বৈশম্পায়ণ ও লোমহর্ষন পুত্র সৌতি -এই তিন ব্যক্তি কর্তৃক তিনবার কথিত হয়েছে। তিন ব্যক্তি ও তিনবার বলা একথা বোঝাতে “ষট্ সংবাদ” কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে।