ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের স্বাধীনতা

0
139

বলার অপেক্ষা রাখেনা ভাষা আন্দোলনই ছিলো বাঙালির একতাবদ্ধ হবার প্রথম নিদর্শন।এর মধ্য দিয়েই বাঙালি প্রথম পাকিস্তানি সৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সাহস দেখাতে সক্ষম হয়।চলুন দেখে আসি সুদীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় জিন্নাহ প্রকাশ্য জনসভায় ঘােষণা করেন যে, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” তার এ ঘােষণায় বাঙালি জনসাধারণ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। তারা দাবি জানাল যে, উর্দু ও বাংলা উভয়ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লােক পূর্ব বাংলায় বাস করে এবং তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী তা মেনে নেয় নি।জিন্নাহর ঘােষণাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানে ব্যাপক তােলপাড় শুরু হয়। বাঙালিরা জিন্নাহর ঘােষণাকে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারমূলক বলে ঘােষণা করে। তখন থেকেই বাঙালি জাতি মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যায়। লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক ছিল তাঁর এ নিযুক্তি। খাজা নাজিমউদ্দিন শাসনকার্যে ছিলেন অদক্ষ। তাই শাসনতান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। খাজা নাজিমউদ্দিন ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি কায়েদে আজমের অনুকরণে ঢাকার এক জনসভায় ঘােষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তার এ ঘােষণায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে। ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে।ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে খাজা নাজিমউদ্দিনের ঘােষণাকে কেন্দ্র করে ছাত্র ধর্মঘট পালিতন হয়। পরে সর্বদলীয় রাষ্ট্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় । জনাব আবুল হাশিম, জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব কামরুদ্দীন আহমদ ও জনাব তােয়াহা প্রমুখ এর সদস্য ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের সাহসী সৈনিক বাংলার গ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবসের ঘােষণা দেয়। অপরদিকে, একই দিন (২১ ফেব্রুয়ারি) ছিল পাকিস্তান সরকারের বাজেট অধিবেশনের দিন। ছাত্রদের কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য সরকার পূর্বেই ১৪৪ ধারা জারি করলে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা এক জরুরি বৈঠকে সমবেত হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ দিন সর্বাত্মক হরতাল পালনের মধ্যদিয়ে ছাত্ররা প্রতি দশজনের একটি মিছিল বের করে। ভাষা আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য পুলিশ বাহিনী মাঠে নামে। পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। যখন দেখা যায়, একপর্যায়ে এগুলাে কোনাে কাজ করতে পারছে না তখন পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। ফলে সালাম,বরকত,রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা আরােও অনেকেই নিহত হয়। ভাষা আন্দোলন সমর্থন করার ব্যাপারে মওলানা ভাসানী, জনাব আবুল হাশিম, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, খন্দকার মুশতাক আহমদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, জনাব অলি আহাদ, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ও এম ওসমান আলী প্রমুখকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা অরও বাড়তে থাকে।
বাঙালির অধিকার সচেতনতার অভাবে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। তাই সর্বপ্রথম বাঙালি জাতি ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছিল এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে ছিল বদ্ধপরিকর এবং সচেতন। অতএব বলা যায় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালির মধ্যে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা। তাছাড়া এর পিছনে লুকিয়ে ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির একটি রাজনৈতিক ইচ্ছে। তাই ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মে একত্রিত করে । এ আন্দোলনের অনুপ্রেরণার মাধ্যমেই বাঙালি পরবর্তীতে নিজ মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর কবল থেকে মুক্ত করতে আন্দোলন সংগ্রামে লিপ্ত হয়।আর ভাষা আন্দোলনের কারণেই বাঙালি জাতি অধিকার সচেতন ও আত্মসচেতন হয়ে ওঠে এবং একের পর এক দাবি আদায়ের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনের পথ ধরেই ছাত্রদের ১১ দফা, শেখ মুজিবের ছয় দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়। এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে ৭১ এ স্বাধীনতার পথ সুগম হয়।

যদি ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিজয় সম্ভব না হতাে, তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ সাধিত হতাে না। জাতীয়তাবাদের বিকাশে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এক মাইলফলক। যার প্রমাণ হলাে ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম।
তাহলে বলতেই হবে ভাষা আন্দোলনই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল। কারণ এ আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি অধিকার সচেতন ও আত্বসচেতন হয় নানা ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে পারে, জাতীয়তাবােধের উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়, ভাষা আন্দোলনের ফলেই- ১৯৫৪, ৫৮, ৬২, ৬৯, ৭০ এর ‘আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

পরিশেষে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ভাষা আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতার সূতিকাগার।এই ভাষা আন্দোলনে অধিকার প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বপিত হয় যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে রুপ নেয় এবং নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এদেশবাসী।বিশ্বের বুকে এঁকে দেয়া হয় লাল সবুজের পতাকা তথা চিরসবুজের মানচিত্র।

লেখক
জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে