“যোগক্ষেমং বহাম্যহম্”;
ভক্তের ভার ভগবান বহন করেন
ভগবানকে কিছুই দেয়ার নেই আমাদের, শুধুই প্রেম-ভক্তি ছাড়া। এ জগত ভগবানের।জগতের প্রত্যেকটি অণুতে পরমাণুতে তিনি বিরাজিত। জগতের সকল ঐশ্বর্যের অধিপতি তিনি, তাই তাঁর নাম ভগবান। অনন্যচিত্তে তাঁর স্মরণ নিয়ে, শুদ্ধতর প্রেম-ভক্তির মাধ্যমে যদি তাঁর আপনজন হয়ে উঠতে পারি ; তবে সকল কিছুই সম্ভব। এ অবস্থায় তিনি ভক্তের আকাঙ্ক্ষিত সকল কিছুই শুধু দানই করেন না ; নিজে পিঠে বহনও করে চলেন, ভক্তের বোঝা। ভক্তের ভক্তি যদি পাকা হয়, তবে ভক্তের বোঝাও ভগবান বহন করেন। অসংখ্য উদাহরণ আছে এর জগতে। শ্রীরামপ্রসাদ সেনের জন্যে ব্রহ্মস্বরূপা মাকালী নিজে তাঁর মেয়ে হয়ে এসে ঘরের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেছেন। ভক্তের অনন্য ভক্তিতে ভগবান বদ্ধ। ভারতবর্ষের সাধক সাধিকাদের জীবনে এমন অসংখ্য দৈবঘটনা দেখা যায়। এমনি আরেকটি ঘটনা, দরিদ্র ব্রাহ্মণ ভক্ত অর্জুন মিশ্রের জীবনে দেখা যায়।তাঁর জন্যে ভগবান নিজে বলরাম সহ সাকার রূপে এসে; পিঠে করে খাবারের বস্তা বহন করে অর্জুন মিশ্রের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, পরম ভক্ত হয়েও তাঁর শ্রীমদ্ভগবদগীতার একটি শ্লোকের প্রতি অবিশ্বাস হয়েছিল। সে অবিশ্বাসকে দূর করতেই লীলাময় ভগবান ভক্তের সাথে লীলাটি করেন।সে সময়ে প্রিন্টিং প্রেস ছিল না, সকল গ্রন্থই হাতে লেখা হত। এ হাতে লেখা গ্রন্থগুলোকে হস্তলিখিত পুঁথির বলা হত। তখন হাতে লিখেই সকল গ্রন্থের অনুলিপি করে নিতে হত। পণ্ডিত অর্জুন মিশ্র একদিন শ্রীমদ্ভগবদগীতা অনুলিপি করতে গিয়ে নবম অধ্যায়ে এসে সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে যান। তিনি দেখলেন নবম অধ্যায়ের বাইশ নম্বর শ্লোকে, ‘যোগক্ষেমং বহাম্যহম্’ লেখা।
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৯.২২)
“যে সকল ভক্তগণ অনন্যচিত্ত হয়ে সর্বদা আমাকে উপাসনা করে; আমাতে নিত্য অনন্যচিত্ত সে সমস্ত ভক্তের যোগ ( প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান) এবং ক্ষেম ( লব্ধ বস্তুর সংরক্ষণ) আমিই বহন করে থাকি।”
এ শ্লোকে ভগবান বলেছেন, অনন্যচিত্ত হয়ে যে সর্বদা ভগবানকে উপাসনা করে; সে সমস্ত ভক্তের প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান এবং লব্ধ বস্তুর সংরক্ষণ সকলই তিনি বহন করে থাকেন। পণ্ডিত অর্জুন মিশ্র চিন্তা করলেন, ভগবান কি করে বহন করবেন। তিনি তো জীবকে সকল অলব্ধ বস্তু দান করবেন। জীবের সকল প্রয়োজনীয় বিষয় তিনি কেন বহন করবেন? এ চিন্তা করে তিনি শ্লোক থেকে ‘বহাম্যহম্’ শব্দটি কেটে ‘দদাম্যহম্’ শব্দটি বসিয়ে দেন। এর প্রেক্ষিতে অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ভক্তের বোঝা ভগবান বহন করেন, এর বদলে বাক্যটি হয়ে গেল তিনি ভক্তকে দান করেন।এরমধ্যেই অর্জুন মিশ্রের স্ত্রী তাঁকে বলে ঘরে কোন খাবার নেই, বাইরে গিয়ে কিছু ভিক্ষা করে নিয়ে আসতে। অর্জুন মিশ্র ভিক্ষার সন্ধানে বের হলেন। অর্জুন মিশ্র ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার কিছু পরেই অপূর্ব সুন্দর দুটি বালক এসে বিভিন্ন রকমের খাবারের বস্তা পিঠে করে বয়ে নিয়ে এসে হাজির হয়। অর্জুন মিশ্রের স্ত্রী হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমরা কোথা থেকে এসেছ? তখন সুদর্শন বালক দুটি বলে, আমরা রাজবাড়ী থেকে এসেছি; পণ্ডিত অর্জুন মিশ্র আমাদের এগুলো পাঠিয়ে দিয়ে বললেন তাঁর ঘরে পৌছে দিতে। তাই আমরা তাঁর ঘরে পৌঁছে দিচ্ছি। মিশ্রের স্ত্রী লক্ষ্য করলেন, ছেলেদুটির পিঠ থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বাবারা তোমাদের পিঠ থেকে রক্ত কেন পড়ছে? বালক দুটি তখন বললেন, আমরা নাকি ভার বহন করতে পারিনা, তাই অর্জুন মিশ্রই আমাদের পিঠে আঘাত করে ক্ষত করে দিয়েছেন। তাঁর আঘাতেই আমাদের পিঠ থেকে রক্তপাত হচ্ছে। আপনিই তো স্বচক্ষে দেখলেন, আমরা ভার বইতে পারি, তাই গৃহে এসে খাবারের বস্তা বহন করে দিয়ে গেলাম। আপনার স্বামী গৃহে আসলে তাঁকে কথাটি বলবেন।
ব্রাহ্মণী খুবই বিস্মিত হলেন, অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের তাঁর স্বামী কি করে এই নিস্পাপ বালকদের গায়ে আঘাত করতে পারে? তিনি ভাবলেন অভাবের তাড়নায় তাঁর স্বামীর মাথা বুঝি নষ্টই হয়ে গেছে। দুপুরের পরে ভগ্নহৃদয়ে অর্জুন মিশ্র তাঁর গৃহে আসলেন। এসেই ঘরের দাওয়ায় বসে স্ত্রীকে বললেন, আজ সারাদিন এত ঘুরেও কিছুই ভিক্ষা পেলাম না। আজ হয়ত উপবাস করেই কাটাতে হবে।মিশ্রের কথা শুনে স্ত্রী হতবাক হলেন। তিনি বললেন, কি যে বল, তুমিই তো দুটি বালকের পিঠে সকল খাবার পাঠিয়ে দিয়েছ। তারা এসে জানালো তারা রাজবাড়ী থেকে এসেছে। একজন কালো এবং অন্যজন ধবধবে সাদা; অপূর্ব মনোহর তাঁদের মুখখানা। স্ত্রীর কথাগুলো শুনে অর্জুন মিশ্রের শ্লোকে ‘বহাম্যহম্’ শব্দটি কেটে ‘দদাম্যহম্’ করার কথা মনে পড়ে যায়। তাঁর চোখ আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে যায়। স্ত্রীকে খুলে বলেন সকল ঘটনা। তখন দুজনে বুঝতে পারেন, এ অপূর্ব দর্শন বালক দুটি আর কেউ নয়; তাঁরা হলে শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীবলরাম ভাতৃদ্বয়। বিরামহীন চোখের জলে ভিজে যায়, তাঁর বস্ত্র। তখন অর্জুন মিশ্র বুঝতে পারেন ভগবানের পিঠে রক্তাক্ত হয়ে যাওয়ার কারণ তিনিই।তিনিই না বুঝে ‘বহাম্যহম্’ শব্দটি কেটে দিয়েছে। সকল ভুল বুঝতে পেরে অর্জুন মিশ্র তাঁর নিজের লেখা ‘দদাম্যহম্’ শব্দটি কেটে সে স্থানে তিনবার ‘বহাম্যহম্’ শব্দটি লিখে দিয়ে ভগবানের কাছে অপরাধ মার্জনা করেন।
অনন্যচিত্তে স্মরণ নিলে ভগবান কৃপা করবেনই। যেহেতু তিনি শ্রীমদভগবদগীতাতে নিজে আমাদের কথা দিয়েছেন, তাঁর কথা অব্যর্থ। এরপরেও তাঁকে ডাকার আমরা সময় পাই না।বিষয়টি নিয়ে ভক্তকবি রজনীকান্ত সেনের অপূর্ব একটি সংগীত আছে।
“আমি সকল কাজের পাই হে সময়
তোমারে ডাকিতে পাই নে,
আমি চাহি দারা-সুত সুখ-সম্মিলন
তব সঙ্গ সুখ চাই নে।
আমি কতই যে করি বৃথা পর্যটন
তোমার কাছে তো যাই নে,
আমি কত কি যে খাই ভস্ম আর ছাই
তব প্রেমামৃত খাই নে।
আমি কার তরে দেই আপনা বিলায়ে
ও পদতলে বিকাই নে,
আমি সবারে শিখাই কত নীতি-কথা
মনেরে শুধু শিখাই নে।”
ভগবানকে সর্বস্ব সমর্পণ করতে পারিনা। বা প্রচেষ্টাও করি না। কারণ এ পথ অনেক কষ্টের, ত্যাগের এবং বৈরাগ্যের। তাই সকল কাজেই আমাদের সময় আছে শুধু ভগবানকে স্মরণের ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন অজুহাত। আমরা বাহির পানে চোখ মেলেছি, কিন্তু একবারও নিজের ভেতরপানে চেয়ে দেখি না। যিনি পরম বন্ধু স্বরূপে আমাদের রক্ষা করেন। দ্রৌপদী কৌরব রাজসভায় যতক্ষণ নিজে তাঁর দেহের পরিধেয় শাড়িটিকে যথাসাধ্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন, ততক্ষণই তাঁর দেহ থেকে শাড়ি খুলে গিয়েছে। যখন অসহায় হয়ে ভগবানের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন; তখনই অনন্ত শাড়ির যোগান চলে এসেছে তাঁর দেহে। কৌরবেরা হাজার চেষ্টা করেও তাঁকে বস্ত্রহীন করতে পারেনি। ভগবানের প্রতি দ্রৌপদীর সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ কৌরবদের সকল কুরুচিপূর্ণ প্রচেষ্টাকে ব্যার্থতায় পর্যবসিত করেছে। দ্রৌপদীর মত এমন আত্মসমর্পণ আমাদের প্রয়োজন, তবেই ভগবান আমাদের সকল কিছুই বহন করবেন। শুধু ছোট্ট একটি শর্ত, তাঁকে অনন্যচিত্তে স্মরণ করতে হবে, ভালবাসতে হবে।
অনন্যচিত্ত হয়ে স্মরণ নিলে যে ভগবান সকল প্রয়োজনীয় বস্তুর ব্যবস্থা করে দেন, এর অসংখ্য প্রত্যক্ষ আমি আমার নিজের জীবনে পেয়েছি। ভগবানের প্রতিশ্রুতি মিথ্যা হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দৃঢ়ভাবে ভগবানকে এবং তাঁর বাক্যকে আশ্রয় করতে হবে। অনন্যচিত্তে বিশ্বাস করতে হবে। তবেই দিনশেষে তাঁর কৃপাকণা আমাদের উপরে বর্ষিত হবে। আমরা পুরাণের কাহিনী পড়ি, কিন্তু কাহিনীগুলো হৃদয়ে উপলব্ধি করি না। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দে বর্ণিত হয়েছ, ব্রজবাসী ভক্তদের রক্ষার কাহিনী। ব্রজবাসীদের অনবরত বৃষ্টিপাতের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বামহাতের কনিষ্ঠ আঙুলে ব্রজবাসীদের মাথার উপরে ছাতার মত গোবর্ধন পর্বত ধারণ করেছিলেন। একটানা সাতদিন সাতরাত্রি গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে সকল ব্রজবাসীকে তিনি রক্ষা করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অবতাররূপে ব্রজে ছিলেন।এই সাতদিন সাতরাত্রি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলায় ব্রজবাসী সামান্যতম ক্ষুধা তৃষ্ণা অনুভব করেনি। মহাভাগ্যবান ব্রজবাসী কেবল অপলক দৃষ্টিতে, শরণাগত ভক্তদের রক্ষার্থে বালক শ্রীকৃষ্ণের গোবর্ধন উত্তোলনের অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করলেন।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়