বঙ্গবন্ধুঃ যার জন্ম না হলে জন্ম হতোনা একটি দেশ বাংলাদেশ

0
162

ইতিহাসের পাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবলই একটি মানুষের নাম নয় বরং একটি যুগের নাম,একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম যার জন্ম না হলে জন্ম হতো না আমাদের আজকের চির সবুজ দেশটির।আজকে যে দেশটিতে দাঁড়িয়ে গান,কবিতা লিখি,যে দেশটির বুকে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেই,অজস্র কলকাকলির শব্দ শুনি সেই দেশটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে নামটি স্থায়ী হয়ে আছে সেই নামটি হলো জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।আর তাই তো কবি লিখেছেন-

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরি মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।”
– অন্নদাশঙ্কর রায়

সত্যিই তাই।যে নামটি আমাদের নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে জড়িয়ে আছে তার নাম পদ্মা, মেঘনা, যমুনা যতদিন বহমান থাকবে ততদিন তো থাকবেই এমনকি কোন কারণে পদ্মা,মেঘনা,যমুনা ও গৌরী বহমান না থাকলেও আমাদের মাঝে অমলিন হয়ে থাকবে।

কেন বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে জন্ম হতোনা এই দেশের

ছাত্র জীবন থেকেই প্রতিবাদী এ প্রাণপুরুষ প্রতিটি আন্দোলনে সবার আগে। তার প্রতিটি কথাতেই ছিল প্রতিবাদী সূর। পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা সব সময় বঙ্গবন্ধুর ভয়ে তটস্ত থাকত। সে কারণে তারা বিভিন্ন অজুহাতে তাকে জেলে বন্দী রেখেই স্বস্তি পেত।
সর্ব প্রথম জেল থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগকে তিনি পৌছে দিয়েছেন রাজনীতির শীর্ষ দুয়ারে। ১৯৬৬ সালে সর্ব প্রথম ৬ দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছেন। এই ৬ দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্রষ্টা, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ মৃত্যু অবধি অসংখ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জীবনে শুভ প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলেই মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হয়েছিল। শেখ মুজিব অজস্র স্বাধীনতা সংগঠকের দীক্ষাগুরু ছিলেন, ছিলেন নয়নের মণি, আত্মার আত্মীয় ও পথ প্রদর্শক। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাকমূহুর্তে তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশেই পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হতো। অসাধারণ বাগ্মি, দূরদৃষ্টি, শত্রুকে আপন করে নেওয়ার অপার মানসিকতা, রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি সুমহান স্নেহ ও অগাধ ভালবাসা ব্যক্তি শেখ মুজিবকে অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছিল। শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন: আমি হিমালয় দেখিনি তবে মুজিবকে দেখেছি।

শেখ মুজিবের দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক দৃঢ়তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণেই মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে আমাদের স্বাধীনতার লালিত স্বপ্নকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। কী অসাধারণ যোগ্যতা ছিল বঙ্গবন্ধুর, যার বদৌলতে তিনি একমাত্র নেতা এবং দীক্ষাগুরু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তাঁর মুখের এক একটি বাণী এবং নির্দেশ বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষের কাছে পথ্যের ন্যায় বিবেচিত হয়েছিল। আর ৭ মার্চের সেই ক্ষণজন্মা ও বুদ্ধিদীপ্ত ভাষণ পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছিল, বাঙালি জাতি তাদের মুক্তির জন্য কতটা কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, আর সেটি কেবল সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম তীক্ষ্ম এবং তেজোদীপ্ত নেতৃত্বের জন্যই। যার জন্য তিনি তিলে তিলে বাঙালিকে বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন সংঘবদ্ধ এবং প্রতিবাদী জাতি হিসেবে এবং যার প্রত্যক্ষ ফলাফল বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা।

ক্যারিশমেটিক লিডার হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনন্য। রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথিতযশা, তাই তো ২৫শে মার্চ বিকালের দিকেই তিনি জানতে পারেন যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সব ধরনের সম্ভাবনার আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখনই তিনি তার প্রজ্ঞাবান এবং তেজোদীপ্ত সহকর্মীদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার নির্দেশ দেন। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি তাঁর বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে পালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান, যাতে পাকিস্তানিরা কোন মিথ্যার আশ্রয় নিতে না পারে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন তাঁর “ম্যাসাকার” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনঃ মধ্যরাত অবধি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে ঘটনা প্রবাহ আমূল পাল্টে যাচ্ছে। টেলিফোনের মাধ্যমে কামানের গোলার শব্দের সাথে সাথে নিরীহ মানুষের চিৎকারে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল।

তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যুষিত সামরিক ঘাটিতে পাকিস্তানিরা আগে আক্রমণ করবে। তাই সেই রাতেই, ২৬শে মার্চে, বাঙালির অবিসংবাদিত জননেতা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে। সাথে সাথে জনৈক বন্ধুকে বেতার যোগে ঘোষণাটি পাঠাবার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।
পাকিস্তানি কুচক্রী সরকার স্বাধীনতা ঘোষনার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহীতার অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয়। কিন্তু প্রতিবাদী সুশীল বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে বার বার তাকে ফাঁসির দড়ি থেকে ফিরিয়ে এনেছে। ১৯৭২ সালের ১০ই মার্চ যখন তিনি দেশে ফিরেছিলেন এ দেশের মানুষ আবেগে উচ্ছাসে বরণ করেছিল এ বিশ্ববরেণ্য নেতাকে।

৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সচিব ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতৃস্থানীয় সর্বজনাব, বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতা, জননেতা তোফায়েল আহমেদের ভাষ্যমতে, ১৯৭১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তিনি সহ-শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান এবং আব্দুর রাজ্জাককে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাড়িতে ডেকে নিয়ে একটি ঠিকানা মুখস্থ করতে বললেন। ঠিকানাটি ছিল: ২১ রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন রোড, ভবানীপুর, কলকাতা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আক্রান্ত হলে এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। পরবর্তীতে সেই বাড়িতেই মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ অবস্থান করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের রনকৌশল ঠিক করতেন। রাজেন্দ্র রোডের পাশেই থিয়েটার রোডে জাতীয় চার নেতা বাস করতেন যুদ্ধকালীন সময়ে। এ সব তদারকি কিন্তু বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্বেই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের জন্য প্লাটফরম তৈরি করেছিলেন যেগুলোর উপর ভিত্তি করেই মহান মুক্তিসংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল।

১৯৬৯-৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে তিনি এই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে বাঙালির আলাদা রাষ্ট্র ও জাতিসত্তা গঠনের প্রত্যয় গড়ে ওঠে। তাঁর নেতৃত্বে জনগণের আস্থা ছিল বলেই আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অভূতপূর্ব ম্যান্ডেট পায়।

এই অভূতপূর্ব জনসমর্থনের জন্যই তিনি ১৯৭১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাত থেকে নিজের হাতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। লাখ লাখ বাঙালি তাঁর আদেশের অপেক্ষায় ছিল এবং একমাত্র তাঁর নির্দেশই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। তাই স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর নামেই ঘোষিত হয়েছিল। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধও হয়েছিল তাঁর নামেই। দেশে–বিদেশে সবাই মাত্র একজন নেতাকেই চিনতেন—তিনি বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী বিজয় ও অপার জনসমর্থন তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বৈধতা দিয়েছিল।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসজুড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, তা নজিরবিহীন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, তখন সারা দেশের মানুষ, এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও সে ডাকে সাড়া দেন। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের কার্যত সরকারপ্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে। এই অনুভূতিই তাদের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

সর্বশেষে বলতেই হয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ধারক ও বাহক। মূলত তার দিকনির্দেশনাই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং এতে দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই। দেশের পাশাপাশি বর্হিবিশ্বেও মুক্তি-স্বাধীনতার জন্য শেখ মুজিব বহু নেতৃত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিধায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অল্প দিনের মধ্যেই বিশ্ববিবেক সৃষ্টি হয়েছিল। বিশ্ববিবেকের জনমত স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের সাহস এবং অনুপ্রেরণাকে আশান্বিত করেছিল। সুতরাং আমরা বলতেই পারি, বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের মুক্তি স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা।অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ,বঙ্গবন্ধু মানেই আমাদের বাঙালি জাতির অস্থিত্ব।কাজেই আবারো বলতে হয় বঙ্গবন্ধ,যার জন্ম না হলে জন্ম হতো না একটি দেশ বাংলাদেশ।তাই বিনম্র শ্রদ্ধা হে মহান বীর সেনানী,তোমার আত্মার চির শান্তিই আমাদের সকলের কাম্য।

লেখক
জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃ স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখমুজিব(মোঃ সাখাওয়াত হোসেন- চ্যানেল আই অনলাইন),বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অভ্যূদয়- রওনক জাহান,প্রথম আলো,বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে