প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।।Pritilota Waddeder

0
575

বিল্পব ও মুক্তির অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

দেশের জন্য লড়াই করতে পারে, শিখিয়েছেন বিপ্লবের জন্য স্বাধীনতার জন্য কী করে হার না মেনে চালিয়ে যেতে হয় এক জীবন। এক জন্মের কর্মে কেমন করে থেকে যেতে হয় মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। বাঙালি নারী চিরকাল কেবল অবলা নয়। যে বাঙালি নারী আজীবন গৃহের কোণে থাকে কেবলই সাংসারিক কাজকর্মে। সেই নারীকে তিনি চিনিয়েছেন দেশের জন্য, বিপ্লবের জন্য একটি জীবনকে কতোখানি মহিমান্বিত করা যায়। কী করে গর্জে ওঠা যায় শোষকের বিরুদ্ধে। তাই তো তিনি অগ্নিকন্যা।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে। তার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী আর মা প্রতিভাদেবী ছিলেন গৃহিণী। পরিবারে ছয় ভাই বোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। প্রথমে তার বড় মধুসূদন, তারপর প্রীতিলতা, এরপর কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। বহু পূর্বে নামের শেষে তাদের পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে “ওয়াহেদেদার” উপাধি পেয়েছিলেন বলে নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার। শৈশবে প্রীতিলতার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তার বাবার মৃত্যুর পর নিজের পৈতৃক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া সপরিবারে ত্যাগ করেন পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে বড় হয়েছিলেন। এই বাড়িতেই প্রীতিলতার জন্ম হয়েছিল। মা প্রতিভাদেবী প্রীতিলতাকে আদর করে ডাকতেন “রাণী”। এক সময় ধলঘাট ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে আসে প্রীতিলতার পরিবার। চট্টগ্রাম শহরের আসকার দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে ওয়াদ্দেদার পরিবার। এখানেই বেড়ে ওঠা প্রীতিলতার।

ছোটবেলা থেকেই কিছুটা অন্তর্মুখী, অনেকটা মুখচোরা ও লাজুক প্রীতিলতা। মায়ের সঙ্গে গৃহস্থলীর কাজে দারুণ পটু ছিল। ঘরের নানা কাজে মাকে সাহায্য করতো ছোট্ট রাণী।

প্রীতিলতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় সাত বছর বয়সে ১৯১৮ সালে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রতি ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রীতিলতার ফলাফল ছিল দারুণ। ভালো ফলাফলের জন্য সব শিক্ষকই ভীষণ স্নেহ করত প্রীতিলতাকে। সেই শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষা দি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। স্কুলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত। এক বছরের বড় প্রীতিলতা কল্পনার সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতো। তাদের স্বপ্নের কথা পরবর্তী কালে লিখেছিলেন কল্পনা দত্ত। লিখেছিলেন “কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।”

প্রীতিলতা তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস এর মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে। এ ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে যুদ্ধের পর গ্রেপ্তার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাদের বিরুদ্ধে করা হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।

স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ঊষা দির সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই মামলার ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে অনেক কিছুই জানতে পারেন তিনি। ঊষা দির দেওয়া “ঝাঁসীর রাণী” বইটি পড়ার সময় ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনী তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।

১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিনান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনা বিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের অনেক নেতা ও সদস্য এই আইনে আটক হয়েছিল। তখন বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্র আর যুবকদের অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হতো। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়েন “দেশের কথা”, “বাঘা যতীন”, “ক্ষুদিরাম” আর “কানাইলাল”। এই সব বই প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে।
প্রীতিলতা দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেওয়ার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবী দলে নারী সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কোনো মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিল।

স্কুলে আর্টস এবং সাহিত্য প্রীতিলতার প্রিয় বিষয় ছিল। ১৯২৬ সালে সংস্কৃত পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন প্রীতিলতা। ১৯২৮ সালে তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। শুধু গণিতের নাম্বার খারাপ ছিল বলে তিনি বৃত্তি পেলেন না।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ছুটির সময় নাটক লেখেন প্রীতিলতা এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক চৌকি দিয়ে তৈরি এক মঞ্চে পরিবেশন করেছিলেন। পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার সময়টাতে তার বাড়িতে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারণে বিয়ের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিলেন তার মা।

আই.এ. পড়ার জন্য ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন প্রীতিলতা। এ কলেজ়ের ছাত্রী নিবাসের মাসিক থাকা খাওয়ার খরচ ছিল ১০ টাকা এবং এর মধ্যে কলেজের বেতনও হয়ে যেত। এ কারণেই অল্প বেতনের চাকুরে জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার মেয়েকে আই.এ. পড়তে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন।

ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন “শ্রীসংঘ” নামে একটি বিপ্লবী সংঘঠন ছিল। এই দলটি প্রকাশ্যে লাঠি খেলা, কুস্তি, ডন বৈঠক, মুষ্টিযুদ্ধ শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব তৈরি করেছিল। ঢাকায় শ্রীসংঘের “দীপালী সঙ্ঘ” নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। লীলা নাগের নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করতো। গোপনে তারা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজও করত।

ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমাদির মাধ্যমে লীলা রায়ের সাথে প্রীতিলতার পরিচয় হয়েছিলো। তাদের অনুপ্রেরণায় দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠি খেলা, ছোরা খেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছিলেন “আই এ পড়ার জন্য ঢাকায় দু’বছর থাকার সময় আমি নিজেকে মহান মাস্টার দার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে নিজেকে গডে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি।”

১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীরা চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের জেলা সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন, যুব সম্মেলন ইত্যাদি আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নারী সম্মেলন করবার কোনো পরিকল্পনা তখনও ছিল না কিন্তু পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বিপুল উৎসাহের জন্যই সূর্য সেন নারী সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দিলেন।

মহিলা কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে এবং তার বন্ধু ও সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত কোলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন। তাদের দুজনের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সূর্য সেনের অধীনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়।

১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আই এ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। এটি “চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ” নামে পরিচয় লাভ করে। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবী দলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। প্রীতিলতা লিখেছিলেন “পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯শে এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐ সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। কিন্তু ঐ বীরত্বপুর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম”।

১৯৩০ সালে আই এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করেছিলেন প্রীতিলতা। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান সঙ্গে কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বি এ পড়ার সুযোগ। তিনি যখন বেথুন কলেজে পড়তে যান তখন তার দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। যুব বিদ্রোহের পর তিনি মধ্য কলকাতায় বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসির বাসায় আশ্রয় নেন। প্রীতিলতা ওই বাসায় গিয়ে দাদার সঙ্গে প্রায় দেখা করতেন। বেথুন কলেজে মেয়েদের সাথে অল্প কয়েকদিনেই আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল প্রীতিলতার। দারুণ বাঁশি বাজাতেন প্রীতিলতা। বানারসী ঘোষ স্ট্রীটের হোস্টেলের ছাদে বসে প্রীতিলতার বাঁশি বাজানো উপভোগ করতো কলেজের মেয়েরা। প্রীতিলতার বি.এ. তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় তিনি ক্লাসে সেরা হয়েছিলেন। দর্শন বিষয়ে অনার্স করার ইচ্ছে ছিল প্রীতিলতার, কিন্তু পরবর্তীতে বিপ্পবের সাথে যুক্ত হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে অনার্স পরীক্ষা তার আর দেওয়া হয়নি।

পূর্ণেন্দু দস্তিদার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে মনোরঞ্জন রায় (যিনি পরবর্তীতে ক্যাবলা’দা নামে পরিচিত) নারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ করেন। যুব বিদ্রোহের পর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এবং কারাগারে বন্দী নেতাদের সাথে আত্মগোপনে থাকা সূর্য সেনের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ হতো। তারা তখন আরো হামলার পরিকল্পনা করছিল।

মনোরঞ্জন রায়ের সাথে প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্তের পরিচয়ের পর তিনি বুঝতে পারেন যে এই মেয়ে দুটিই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লবী কাজ করতে সক্ষম হবে। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুলিশের নজরদারী এড়িয়ে মনোরঞ্জন রায় কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম এসে সূর্য সেনের হাতে গান-কটন এবং বোমা তুলে দেন।

এ সময় তিনি জেলে থাকা বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে চিঠির আদান প্রদান এবং কলকাতা থেকে বিস্ফোরক বহন করে আনার বিপদ সম্পর্কে মাস্টার দার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শহর আর গ্রামের যুবকরা পুলিশের চোখে সবচেয়ে বড় সন্দেহভাজন। এ অবস্থায় সূর্য সেন নারী বিপ্লবীদের এসব কাজের দায়িত্ব দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কারণ তখনো গোয়েন্দা বিভাগ মেয়েদের সন্দেহ করতো না। মাস্টার দার অনুমতি পাওয়ার পর নারীদের বিপ্লবের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করা হয়। চট্টগ্রামে সূর্য সেনের কাছে বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফেরত আসার একদিন পরেই ২৪ নভেম্বর মনোরঞ্জন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সে সময়ে টি জে ক্রেগ বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে নতুন দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তাকে হত্যা করার জন্য মাস্টার’দা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে মনোনীত করলেন।

পরিকল্পনা অনু্যায়ী ১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে তারা রিভলভার নিয়ে আক্রমণ চালায় কিন্তু ভুল করে তারা মি. ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এসডিও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনেই পুলিশ বোমা আর রিভলভারসহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে। এই বোমাগুলোই কলকাতা থেকে মনোরঞ্জন রায় চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদণ্ড এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়।

ব্যয়বহুল বলে আলিপুর জেলের ফাঁসির সেলে মৃত্যু গ্রহণের প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণের সাথে চট্টগ্রাম থেকে আত্নীয়দের মধ্যে কেউ দেখা করতে আসা সম্ভব ছিল না। এ খবর জানার পর মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতার কাছে লেখা এক চিঠিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার চেষ্টা করতে অনুরোধ করেছিলেন। মনোরঞ্জন রায়ের মা হিজলী জেলে ছেলের সাথে দেখা করতে গেলে গোপনে তিনি প্রীতিলতাকে লেখা চিঠিটা তার হাতে দেন।

বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসি (যিনি গুনু পিসি নামে পরিচিত) তার উপদেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা মৃত্যু প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার জন্য আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে “অমিতা দাস” ছদ্মনামে “কাজিন” পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করেন। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে প্রায় চল্লিশ বার বিপ্লবী রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেছিলেন তিনি।

১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসি হয়। এই ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তার ভাষায় “রামকৃষ্ণদার ফাঁসীর পর বিপ্লবী কর্মকান্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল।”

রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির পর আরো প্রায় নয় মাসের মতো প্রীতিলতাকে কলকাতায় থেকে যেতে হয় বি এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বাড়ি এসে দেখেন তার বাবার চাকরি নেই। সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য তাই বাধ্য হয়ে শিক্ষকতার পেশা বেছে নিতে হয় প্রীতিলতাকে।

চট্টগ্রামে বিশিষ্ট দানশীল ব্যক্তিত্ব অপর্ণাচরণ দে’র সহযোগিতায় তখন নন্দনকাননে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (যা এখন অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত)। প্রীতিলতা এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দিলেন। স্কুলে যাওয়া, স্কুলের বাইরে মাসিক মাইনের বিনময়ে পড়ানো, মাকে সাংসারিক কাজে সাহায্য করে তার দিনগুলো কাটছিল। কিন্তু তিনি লিখেছিলেন “১৯৩২ সালে বি এ পরীক্ষার পর মাষ্টারদার সাথে দেখা করবই এই প্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম”।

বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা প্রীতিলতা কল্পনা দত্তকে বললেন। প্রীতিলতা কলকাতা থেকে আসার এক বছর আগে থেকেই কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বি এস সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। সে সুবাদে প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সাথে মাস্টার দা সূর্য সেনের দেখা হয়েছিল। প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহের কারণেই কল্পনা দত্ত একদিন রাতে গ্রামের এক ছোট্ট ঘরে তার সাথে নির্মল সেনের পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে ওই সাক্ষাতে নির্মল সেন প্রীতিলতাকে পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে তা জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন “টান আছে। কিন্তু পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ তো দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের কাছে বলি দিতে পারবো।”

এদিকে যুব বিদ্রোহের পর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়া সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে মাস্টারদা সূর্য সেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কারণে প্রীতিলতার সাথে সে রাতে তার দেখা হয়নি। প্রীতিলতার সাথে এই সাক্ষাতের কথা বলতে গিয়ে মাস্টার দা সূর্যসেন লিখেছিলেন, “অল্প কয়েকদিন পরেই নির্মলবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হতেই নির্মলবাবু আমায় বলল আমি রাণীকে কথা দিয়েছি আপনার সঙ্গে দেখা করাবো, সে এক সপ্তাহের জন্য যে কোন জায়গায় আসতে রাজ়ী আছে। রামকৃষ্ণের সঙ্গে সে ফাঁসীর আগে দেখা করেছে শুনেই তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হয়েছিলো। তার দেখা করার ব্যাকুলতা শুনে রাজী হলাম এবং কয়েকদিনের মধ্যে তাকে আনার ব্যবস্থা করলাম”।

মাস্টার দা এবং প্রীতিলতার প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনাতে মাস্টার দা সূর্যসেন লিখেছিলেন, “তার চোখেমুখে একটা আনন্দের আভাস দেখলাম। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে, তার জন্য তার চেহারায় ক্লান্তির কোন চিহ্নই লক্ষ্য করলাম না। যে আনন্দের আভা তার চোখে মুখে দেখলাম, তার মধ্যে আতিশয্য নেই, Fickleness নেই, Sincerity শ্রদ্ধার ভাব তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। একজন উচ্চশিক্ষিত cultured lady একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীর্ব্বাদ করলাম…”।

রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে তার দেখা হওয়ার ইতিবৃত্ত, রামকৃষ্ণের প্রতি তার শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রীতিলতা প্রায় দুই ঘণ্টার মতো মাস্টার দার সাথে কথা বলেছিলেন। মাস্টার দা আরো লিখেছেন “ওর action করার আগ্রহ সে পরিষ্কার ভাবেই জানাল। বসে বসে যে মেয়েদের organise করা, organisation চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই বলে।”

তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে থাকার পর অস্ত্রের নিশানা ও চালনা সম্পর্কে প্রীতিলতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দুই বছর অতিক্রম হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত এবং অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই বছরগুলোতে আক্রমণের নানা পরিকল্পনার পরেও শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীরা নতুন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এসব পরিকল্পনার মূলে ছিলেন মাস্টার দা এবং নির্মল সেন। এই দুজন আত্মগোপণকারী বিপ্লবী তখনো গ্রাম থেকে গ্রামে বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এই আশ্রয়স্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়িটি। পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামটা ছিল বিপ্লবীদের অতি শক্তিশালী গোপন আস্তানা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকে এই গ্রামে ছিলো মিলিটারি ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে সেনারা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপনরত বিপ্লবীদের ধরার চেষ্টা করতো।

সাবিত্রী দেবীর বাড়ি ছিল ওই ক্যাম্প থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। বিপ্লবীদের কাছে ওই বাড়ির গোপন নাম ছিল “আশ্রম”। বিধবা সাবিত্রী দেবী এক ছেলে এবং বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে ওই বাড়িতে থাকতেন। বিপ্লবীদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন “সাবিত্রী মাসিমা” নামে। এই আশ্রমে বসে সূর্য সেন এবং নির্মল সেন অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে সাক্ষাত করতেন এবং আলোচনা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতেন। অনেক সময় এই বাড়িতেই তারা দেশ বিদেশের বিপ্লবীদের লেখা বই পড়ে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখে সময় কাটাতেন।

১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড়-বৃষ্টির দিনে মাস্টার দার পাঠানো এক লোক প্রীতিলতাকে আশ্রমে নিয়ে আসেন। বাড়িতে প্রীতিলতা তার মাকে বলেন তিনি সীতাকুণ্ডে যাচ্ছেন। মাস্টার দা এবং নির্মল সেন ছাড়া ওই বাড়িতে তখন ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলার পলাতক আসামি তরুণ বিপ্লবী অপূর্ব সেন (বিপ্লবী ভোলা) অবস্থান করছিলেন। ১৩ জুন সন্ধ্যায় সূর্য সেন এবং তার সহযোগীদের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প জানতে পারে। এর আগে মে মাসেই ইংরেজ প্রশাসন মাস্টার দা এবং নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।

ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন খবরটা জানার পর ওই বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুরস্কার এবং পদোন্নতির আশা নিয়ে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, সাত জন সিপাহী, একজন হাবিলদার এবং দুজন কনস্টেবল নিয়ে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ওই বাড়িতে উপস্থিত হলেন। এর একটু আগেই মাস্টার দা এবং প্রীতিলতা দোতলা বাড়িটার নিচ তলার রান্নাঘরে ভাত খেতে বসেছিলেন। জ্বরের কারণে নির্মল সেন এবং ভোলা রাতের খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে ওপরের তলায় শুয়ে ছিলেন। মাস্টার দার সাথে খেতে বসে অস্বস্তি বোধ করায় প্রীতিলতা দৌড়ে ওপরে চলে যান। এমন সময় মাস্টার দা ঘরের ভেতরের মই বেয়ে দোতলায় উঠে বলেন “নির্মলবাবু, পুলিশ এসেছে”।

মাস্টার দা প্রীতিলতাকে নিচে নেমে এসে মেয়েদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন। ততক্ষণে সিপাহী এবং কনস্টেবলরা ঘর ঘিরে ফেলেছে। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের একতলায় থাকা সাবিত্রী দেবী ও তার ছেলে মেয়েকে দেখতে পান। “ঘরে আর কে আছে?” এ প্রশ্ন করে কোনো উত্তর না পাওয়া অভিযান পরিচালনাকারীরা এসময় ঘরের উপরের তলায় পায়ের আওয়াজের শব্দ শুনতে পান।

ক্যাপ্টেন ক্যামেরন হাতে রিভলভার নিয়ে ঘরের বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত নেন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের করা দুইটা গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মারা যান। গুলির শব্দ পাওয়ার পরেই ঘরের চারিদিকে থাকা সৈন্যরা চারিদিক থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটা গুলি এসে নির্মল সেনের বুকে লাগে এবং প্রচুর রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। টাকা পয়সা এবং কাগজপত্র গুছিয়ে প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাস্টারদা অন্ধকারে ঘরের বাইরে আসেন। এই সময়ে আমের শুকনো পাতায় পা পড়ার শব্দ পেয়ে আশেপাশে থাকা সিপাহীদের চালানো গুলিতে সবার আগে থাকা অপূর্ব সেন মারা যান।

মাস্টারদা আর প্রীতিলতা সেই রাতে কচুরিপানা ভরা পুকুরে সাঁতার কেটে আর কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। মণিলাল ওই বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিলেন। মাস্টারদার জন্য রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ লিখে ধলঘাটে এনেছিলেন প্রীতিলতা। সে পান্ডুলিপি পুকুরের মধ্যে হারিয়ে গেল। তাদেরকে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে নিয়ে যেতে বলেন মাস্টারদা।

মণিলাল দত্ত তাদেরকে ধলঘাট থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে পাহাড়, জঙ্গল এবং নদীর কাছাকাছি একটা গ্রাম জৈষ্ট্যপুরায় নিয়ে যেতে মনস্থির করলেন। পুলিশ এলে পাহাড় এবং জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা যাবে অথবা নদী পার হয়ে অন্য আশ্রয়ে যাওয়া যাবে। মাস্টারদা সূর্য সেন পরের দিন প্রীতিলতাকে বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে সূর্য সেনের নির্দেশে মণিলাল প্রীতিলতার বাসায় পুলিশের নজরদারি আছে কিনা তা জানতে শহরে খোঁজ নিয়েছিলেন। “সব কিছু ঠিক আছে” জানার পর প্রীতিলতাকে বাড়ি গিয়ে স্কুল শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।

ধলঘাট সংঘর্ষের সে রাতেই গোলাগুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের মৃত্যুর পর পুলিশের এসআই মনোরঞ্জন বোস পটিয়ার মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে আরো ত্রিশ জন সৈন্য এবং একটা লুইস গান নিয়ে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে ফিরে আসে। লুইস গানের গুলিবর্ষণে বাড়িটা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।

সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সেনাধ্যক্ষ মেজর গর্ডন দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। সাবিত্রী দেবী এবং তার ছেলে মেয়েকে বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তার মেয়ে স্নেহলতার জবানবন্দিতে আরো তিন যুবক—দীনেশ দাশগুপ্ত, অজিত বিশ্বাস এবং মনীন্দ্র দাশকে আটক করা হয়। পরবর্তীকালে সাবিত্রী দেবী, তার পুত্র রামকৃষ্ণ এবং এই তিন যুবককে বিপ্লবীদের আশ্রয় এবং সহায়তা করার দায়ে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ঘরের ভেতর চালানো তল্লাশিতে রিভলভার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের দুইটা ছবি, পাশাপাশি দুইটা মেয়ের ছবি (যার মধ্যে একজন ছিল প্রীতিলতা) সহ কিছু চিঠি এবং দুইটা বইয়ের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়।

ধলঘাটে ছবি পাওয়ার পর ১৯ জুন পুলিশ বাসায় গিয়ে প্রীতিলতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ২২ জুন এসআই শৈলেন্দ্র সেনগুপ্ত এর নেতৃত্বে একটি দল ওই বাড়িতে আরেক দফা তল্লাশি চালায়। তার নির্দেশে আশেপাশের সব জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়। জঙ্গল এবং আশেপাশের পুকুরে তল্লাশিতে অনেক কাগজপত্র উদ্ধার করা হয় যা থেকে প্রমাণিত হয় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর আত্মগোপনে থেকেও বিপ্লবীরা তাদের আদর্শের সাথে বিভিন্ন প্রবন্ধ পড়া এবং সামরিক প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিলো।

তল্লাশি অভিযানে কাজিন পরিচয় দিয়ে অমিতা দাশের (প্রীতিলতার) আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসির প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে সাক্ষাতের হাতে লেখা একটি বিবরণী পাওয়া যায়। ওই হাতের লেখার সাথে মেলানোর জন্য ৩০ জুন প্রীতিলতার বাসা থেকে পুলিশ তার গানের একটা বই নিয়ে যায়। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। ৫ জুলাই মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রীতিলতা আত্মগোপন করে। ছাত্রী পড়ানোর কথা বলে তিনি বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন।

তার বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার তখন অনেক খোঁজ খবর করেও মেয়ের কোনো সন্ধান পাননি। ব্যর্থ হয়ে যখন থানায় খবরটা জানানো হলো, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর যোগেন গুপ্ত আরেক নারী বিপ্লবী কল্পনা দত্তের বাড়িতে যান। কল্পনা দত্ত ওই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “আমাদের বাসায় এসে গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর বলে এত শান্তশিষ্ট নম্র মেয়ে ও, এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে, ভাবতেও পারি না তার ভিতর এত কিছু আছে! আমাদের খুব ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়ে গেল।”

চট্টগ্রাম শহরের গোপন আস্তানায় কিছু দিন কাটিয়ে প্রীতিলতা পড়ৈকড়া গ্রামের রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। বিপ্লবীদের আরেক গোপন আস্তানা এই বাড়িটার সাংকেতিক নাম ছিল “কুন্তলা”। এই বাড়িতে তখন আত্মগোপনে ছিলেন মাস্টারদা এবং তারকেশ্বর দস্তিদার। প্রীতিলতার আত্মগোপনের খবর ১৩ জুলাই ১৯৩২ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

“চট্টগ্রামের পলাতকা” শিরোনামের এই সংবাদে লেখা হয় “চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ধলঘাটের শ্রীমতী প্রীতি ওয়াদ্দাদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত।”

ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডের কারণে সেদিনের ওই পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড় ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা ছাড়া এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ওই ক্লাবের ধারে কাছে যেতে পারতো না। ক্লাবের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “ডগ অ্যান্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”। সন্ধ্যা থেকেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য নতুনভাবে পরিকল্পনা শুরু করে। চট্টগ্রাম শহরের কাছে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে ওই ক্লাবেরই একজন বেয়ারা যোগেশ মজুমদারের বাড়িতে বিপ্লবীরা আশ্রয় পেলেন।

১৯৩২ সালের ১০ আগস্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাত জনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল।

মাস্টারদা ১৯৩২ এর সেপ্টেম্বর মাসে আবার ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের ওপর দেবেন বলেন মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সাত দিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার ওপর।

২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবিদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবি ছেলেদের মতো পোশাক পরানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেওয়া কালী কিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তীর পোশাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে ছিল মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেনের।

বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেয়া তার গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ) ক্লাবের ভেতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, আনুমানিক প্রায় ৪০ জন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল।

তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে অস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলভার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলভার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেয়ার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারণে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তারাও পাল্টা আক্রমণ করলো।

একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলভারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চার জন পুরুষ এবং সাত জন নারী আহত হয়।

আহত অবস্থায় প্রীতিলতার ধরা পড়ার আশংকা দেখা দেয়। তাই পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্ব সিদ্বান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তার রিভলভারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন।

পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে। পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মরদেহ দেখে পরবর্তীতে প্রীতিলতাকে সনাক্ত করে। তার মরদেহ তল্লাশির পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, বিভলভারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না বরং পটাশিয়াম সায়ানাইড খাওয়াই ছিল তার মৃত্যুর কারণ।

বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারি প্রীতিলতার মৃত্যুর পর লন্ডনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো একটা রিপোর্ট লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, “Pritilata had been closely associated with, if not actually the mistress of, the terrorist Biswas who was hanged for the murder of Inspector Tarini Mukherjee, and some reports indicate that she was the wife of Nirmal Sen who was killed while attempting to evade arrest of Dhalghat, where Captain Cameron fell.”

প্রীতিলতার মৃত্যুর পর তার পরিবারের অবস্থা নিয়ে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, “প্রীতির বাবা শোকে দুঃখে পাগলের মতো হয়ে গেলেন, কিন্তু প্রীতির মা গর্ব করে বলতেন, “আমার মেয়ে দেশের কাজে প্রাণ দিয়েছে”। তাঁদের দুঃখের পরিসীমা ছিল না, তবু তিনি সে দুঃখকে দুঃখ মনে করেননি। ধাত্রীর কাজ নিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে নিয়েছেন, আজো তাঁদের সেভাবে চলছে। প্রীতির বাবা প্রীতির দুঃখ ভুলতে পারেননি। আমাকে দেখলেই তাঁর প্রীতির কথা মনে পড়ে যায়, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন”।

১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হয়তো শারীরিকভাবে চলে গিয়েছিলেন অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কিন্তু আজো তিনি রয়ে গেছেন কোটি প্রাণের হৃদয়ের গহ্বরে। আজো যখন বাঙালি নারীর অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেয়া হয়, দেশপ্রেম, আদর্শ আর বিপ্লবের কথা লেখা হয় সবার আগে আসে প্রীতিলতার নাম। প্রীতিলতা এক ধূমকেতুর নাম। মাত্র ২১ বছরের প্রীতিলতার দেশপ্রেম, আদর্শ, স্বাধীনতার জন্য অসীম ত্যাগ মানুষ স্মরণ করবে সব সময়।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তী বিপ্লবী, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্মবার্ষিকী ছিল গতকাল। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ইতিহাসের অগ্নিকন্যা, জাগরণীয়ার প্রতি।

তথ্যসূত্র –

প্রীতিলতা/ সম্পাদনা শংকর ঘোষ।

বীরকন্যা প্রীতিলতা- পূর্ণেন্দু দস্তিদার

সূর্য সেনের সোনালি স্বপ্ন/ রুপময় পাল

শতবর্ষের সন্ত বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী/ অলকা নন্দিতা।

স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম/ পূর্ণেন্দু দস্তিদার

প্রীতি ওয়াদ্দেদারঃ কল্পনা দত্ত/ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা।

আহমাদ ইশতিয়াক

ahmadistiak1952@gmail.com

৬ মে,দি ডেইলি স্টার অনলাইন সংস্করন হতে সংগৃহিত।

সংগ্রহেঃ জীবন কৃষ্ণ সরকার,সম্পাদক,হাওরপিডিয়া

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে