“নক্ষত্রাণামহং শশী”;
বাক্যটি কি বিজ্ঞানবিরুদ্ধ ?
শ্রীমদ্ভগবদগীতার দশম অধ্যায়ের বিভূতি যোগে ভগবান জগতব্যাপী তাঁর বিভূতির বর্ণনা দিয়েছেন। একুশ থেকে উনচল্লিশ এ বিশটি শ্লোকে ভগবান তাঁর অনন্ত বিভূতির প্রতীক হিসেবে বিরাশিটি বিভূতির উল্লেখ করেছেন।ভগবানের নিজমুখে আত্মবিভূতি বর্ণনার প্রথম শ্লোকটি নিয়ে, বর্তমানে বিভিন্ন সময়ে প্রচুর অপব্যাখ্যা করা হয়।কারণ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্যে অধিকাংশ সময়েই আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বহু তত্ত্বকেই সম্যক উপলব্ধি করতে পারি না। যোগ্য অধিকারী বিহীন বৈদিক জ্ঞান আমাদের মাঝে ধরাও দেয় না। যারা যোগ্য অধিকারী, তারা হয়ত ব্রহ্মের অনন্ত জ্ঞানরাশির কিছুটা উপলব্ধি করতে পারে। পক্ষান্তরে অধিকাংশই পারে না। তখনই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। শ্রীমদ্ভগবদগীতার দশম অধ্যায়ের (১০.২১) শ্লোকটির ক্ষেত্রেও এমনি ঘটনা ঘটেছে।
আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্।
মরীচির্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী।।
“অদিত্যগণের মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিসমূহের মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, ঊনপঞ্চাশ বায়ুর মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রগণের অধিপতি চন্দ্র আমি।”
নক্ষত্রাণামহং শশী”; বাক্যটি আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয়। কিন্তু নিগূঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে শ্লোকটি নিয়ে সকল সংশয় বিদূরিত হয়ে যায়। শ্লোকটিতে ভগবান বলেছেন, সকল নক্ষত্রগণের মধ্যে তিনি চন্দ্র। এতেই আমাদের কিছু স্বধর্মদ্বেষী সহ অন্যান্যরা সুর চড়াও করে বলেন, শ্রীমদ্ভগবদগীতা যদি পরমেশ্বরের বাণী হয়, তবে এতে বৈজ্ঞানিক ভুল কি করে থাকে? কথাগুলো যৌক্তিক, কিন্তু এদেশীয় পরম্পরায় বাহিত জ্ঞানহীন। ভগবানের বিভূতি বর্ণনায় উক্ত হয়েছে, “নক্ষত্রাণামহং শশী।” কিন্তু চন্দ্র তো নক্ষত্র নয়, চন্দ্র হল পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। নক্ষত্র হল নিজস্ব তেজে দীপ্তিমান উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় গোলক যার নিজস্ব আলো আছে। কিন্তু আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে চন্দ্রের তো নিজস্ব আলো নেই এবং চন্দ্র কোন নক্ষত্রও নয়। তবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতার মধ্যে বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক সংশয়পূর্ণ তত্ত্ব কেন বললেন? বহুদিন থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা আমরা বৌদ্ধিক গবেষণা ক্ষেত্রের বহুস্থানেই দেখি। কিন্তু এর নিরসন অত্যন্ত প্রয়োজন। যথাযথ ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি নিয়ে কোন প্রবন্ধ আমার চোখে পরেনি; বিষয়টি দুঃখজনক।
রাতের আকাশে আমরা যে অসংখ্য নক্ষত্র বা তারা দেখি, সেগুলাে আসলে আমাদের সূর্যের মতই অতি উষ্ণ বিশাল আকারের গ্যাসের কুণ্ডলি।বেশির ভাগ নক্ষত্র আমাদের সূর্যের মতই প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম –এ দুটি গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। তারার ভেতরে প্রচণ্ড চাপে থাকা গ্যাস অত্যন্ত ঘন এবং উত্তপ্ত অবস্থায় থাকে। চলমান এই প্রক্রিয়ার ফলে প্রচুর শক্তির উদগিরণ ঘটে; এ শক্তিই মহাকাশে তাপ ও আলো হয়ে ছড়িয়ে পরে।প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে তারার গ্যাসগুলাে একত্রে ঘন হয়ে মিশে থাকে। কতটা গ্যাসের সমাবেশে একটি তারা গঠিত, তার উপর নির্ভর করে তারাটির মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, তাপমাত্রা, চাপ, ঘনত্ব এবং আকার। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ঋষি মুনি সহ রাতের আকাশের তারকামণ্ডলী নিয়ে কৌতুহলের অন্ত ছিল না। তাই আকাশের তারকামণ্ডলী পর্যবেক্ষণ মানুষের অন্যতম কৌতূহলের বিষয় হলেও; বিজ্ঞানীরা তারকামণ্ডলীর অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে পেরেছেন বিংশ শতাব্দীতে এসে।
বৈদিক শাস্ত্রে নক্ষত্রের সংজ্ঞা ভিন্ন। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান ও হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে নক্ষত্র হল চন্দ্রপথের ২৭টি ভাগ, যা ‘চন্দ্রনিবাস’ হিসেবে পরিচিত । সূর্যের গতিপথকে যেমন ১২ ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগের নাম রাখা হয়েছে রাশি তেমনি চন্দ্রপথকে ২৭ ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগের নাম রাখা হয়েছে নক্ষত্র।বিভিন্ন দেশে এই চন্দ্রনিবাসসমূহের নাম বিভিন্ন। ভূমধ্যাঞ্চলীয় আরবে ও পূর্বাঞ্চলীয় চীনে সময় পরিমাপের এ প্রাকৃতিক ঘড়িটিকে ভারতবর্ষের মতই ভাগ করা হয়েছে। আরবীয়রা এর প্রত্যেক ভাগকে বলে ‘মঞ্জিল’ এবং চৈনিকরা এ প্রত্যেক ভাগকে ‘সিউ’ বলে। মিশরেও এমন এক আকাশবিভাজন পাওয়া যায় , যা ৩৬ ভাগে বিভক্ত, একে বলা হয় ‘দেকান’।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় চন্দ্র পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র অনবরত নিজের কক্ষপথে ঘুরে চলেছে। পৃথিবীর মত চন্দ্রও সূর্যের আলােয় আলােকিত। চন্দ্র মাটি, শিলা, ধুলাবালিতে পূর্ণ গােলাকার এক উপগ্রহ, যার ব্যাসার্ধ পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ। এর কোনাে বায়ুমণ্ডল নেই, নেই কোন জল বা জীবন।চন্দ্রের পরিবেশ প্রাণহীন ও ধুলাবালিময়। তাপমাত্রা ১৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১২৭ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করে। মানুষের পক্ষে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে, চন্দ্রে মানুষের এখনও বসবাস করা সম্ভব নয়।চন্দ্র থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ৩,৮৫,০০০ কিলোমিটার এবং মহাকর্ষ বল পৃথিবীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ । আকর্ষণ বল কম হলেও পৃথিবী ও চন্দ্রের মধ্যকার দূরত্ব কম হওয়ায় পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার প্রধানতম কারণ চন্দ্রের মহাকর্ষ বল।
“নক্ষত্রাণামহং শশী” শ্রীমদ্ভগবদগীতার এ বাক্যটি নিয়ে ভুলবোঝাবুঝির অন্যতম কারণ, আমাদের বৈদিক পরম্পরাহীন জ্ঞান। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় উক্ত প্রাচীন আধ্যাত্মিক বাক্যকে আমরা বর্তমান পশ্চিমাদৃষ্টিকোণে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি। পশ্চিমা চশমা চোখে দিয়ে আমাদের এদেশীয় তত্ত্বের গবেষণা কর্ম পরিচালিত করছি।এতেই সকল গোল বেধে যাচ্ছে। নক্ষত্রের বর্তমান বৈজ্ঞানিক পরিভাষা এবং প্রাচীন পরিভাষা এক নয়। ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে গতিশীল সকলকেই নক্ষত্র বলে। বিষয়টি পরবর্তীকালের সংস্কৃত অভিধান তো বটেই, এমনকি পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন অভিধান গ্রন্থ যাস্কাচার্যের ‘নিরুক্ত’ নামক বেদাঙ্গগ্রন্থেও আছে। বৈদিক নিরুক্তে সুস্পষ্টভাবে ‘নক্ষত্র’ শব্দের অর্থে বলা হয়েছে, গতিশীল সকল কিছুকেই নক্ষত্র বলে। সে হিসেবে ভারতীয় পরম্পরায় সূর্য যেমন নক্ষত্র, তেমনি সূর্যকে পরিভ্রমণকারী নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীও নক্ষত্র। পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত প্রদক্ষিণকারী চন্দ্রও নক্ষত্র।
নক্ষত্রাণি নক্ষতের্গতিকর্মণঃ।
(বৈদিক নিরুক্ত :৩.২০.১১)
“নক্ষত্র’ শব্দ ‘গতিকর্মণঃ নক্ষতেঃ’;অর্থাৎ গত্যর্থক ‘নক্ষ্’ ধাতু হতে নিষ্পন্ন। গত্যর্থক ‘নক্ষ্’ ধাতুর উত্তর অত্রন্ প্রত্যয় করে ‘নক্ষত্র’ শব্দের নিষ্পত্তি হয়েছে। তাই নক্ষত্র গতিশীল।”
ভারতবর্ষের পরম্পরায় যেমন মহাবিশ্বের গতিশীল সকলকেই এককথায় নক্ষত্র বলে অভিহিত করা হয়। তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ বলে আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়; মহাবিশ্বের গতিশীল তাদের সকলকেই প্রাচীন ভারতবর্ষের সংজ্ঞায় নক্ষত্র বলা হয় । চন্দ্র একটি অনন্য সৌন্দর্যের অধিকারী নক্ষত্র, সে রাতের আকাশের শোভা। চন্দ্রের এ অনন্য অদ্বিতীয় সৌন্দর্যের কারণেই, “নক্ষত্রদের মধ্যে শশী” বাক্যটি বলা হয়েছে।অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব ফল্গুনী, উত্তর ফল্গুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, অভিজিৎ, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্ব ভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ, রেবতী এ সকল নক্ষত্রসমূহের অধিপতি হলেন চন্দ্র। রোহিণী আদি ২৭ টি বা মতান্তরে ২৮ টি নক্ষত্র চন্দ্রকে সর্বদা ঘিরে থাকে। তাই পুরাণে এ নক্ষত্রদের চন্দ্রের স্ত্রী হিসেবে অবিহিত করা হয়েছে। চন্দ্রের হ্রাস এবং বৃদ্ধিতেই শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষের মাধ্যমে ঋতুচক্র আবর্তিত হয়ে একটি বছর হয়। ঋতুচক্র সংবৎসরকাল সহ মাধুর্যমণ্ডিত সৌন্দর্যের কারণেই চন্দ্র নক্ষত্রদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বিভূতিযোগে ভগবান সৃষ্টির সকল শ্রেষ্ঠ, প্রাধান্যমূলক প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ বিভূতির কথা বলেছেন। এ বিভূতির মধ্যে নক্ষত্রমণ্ডলী এবং নক্ষত্রের অধিপতি চন্দ্র অন্যতম। কৃষ্ণ যজুর্বেদেও চন্দ্রকে ঘিরে থাকা নক্ষত্রগুলোর একটি দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যায়।
কৃত্তিকা নক্ষত্রমগ্নির্দেবতাঽগ্নে রুচঃ স্থ প্রজাপতের্দ্ধাতুঃ সোমস্যর্চে ত্বা রুচে ত্বা দ্যুতে ত্বা ভাসে ত্বা জ্যোতিষে ত্বা রোহিণী নক্ষত্রং প্রজাপতির্দেবতা মৃগশীর্ষং নক্ষত্র সােমাে দেবতাঽর্দ্রা নক্ষত্রং রুদ্রো দেবতা পুনর্বসু নক্ষত্রমদিতিৰ্দেবতা তিষ্যো নক্ষত্রং বৃহস্পতির্দেবতাঽশ্রেষা নক্ষত্রং সর্পা দেবতা মঘা নক্ষত্রং পিতরাে দেবতা ফল্গুনী নক্ষত্রম্ অর্ষ্যমা দেবতা ফল্গনী নক্ষত্রং ভগাে দেবতা হস্তো নক্ষত্রং সবিতা দেবতা চিত্রা নক্ষত্রমিন্দ্রো দেবতা স্বাতী নক্ষত্রং বায়ুর্দেবতা বিশাখে নক্ষত্রমিন্দ্রাগ্নী দেবতাঽনুরাধা নক্ষত্রং মিত্রো দেবতা রোহিণী নক্ষত্রমিন্দ্রো দেবতা বিচৃতৌ নক্ষত্রং পিতরো দেবতাঽষাঢ়া নক্ষত্রমাপো দেবতাঽষাঢ়া নক্ষত্রং বিশ্বে দেবা দেবতা শ্রোণা নক্ষত্রং বিষ্ণুদের্বতা শ্রবিষ্ঠা নক্ষত্রং বসবঃ দেবতা শতভিষঙ্ নক্ষত্রমিন্দ্রো দেবতা প্রােষ্ঠপদা নক্ষত্রমজ একপাদ্দেবতা প্রােষ্ঠাপদা নক্ষত্র মহির্বুধ্নিয়ো দেবতা রেবতী নক্ষত্রং পূষা দেবতাঽশ্বযুজৌ নক্ষত্রমশ্বিনৌ দেবতাঽপভরণীর্নক্ষত্রম্ যমো দেবতা পূর্ণা পশ্চাদ্যত্তে দেবা অদধুঃ ॥
( কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় সংহিতা :৪.৪.১০)
বিদেশি শব্দগুলোর যখন পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা হয়, তখন সর্বক্ষেত্রে এদেশীয় রীতি, সংস্কৃতি এবং পরম্পরাকে অনুসরণ করে পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা হয়নি। এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ আছে। এদেশীয় ‘ধর্ম’ শব্দ এবং ইউরোপীয় ‘রিলিজিয়ন’ শব্দটির মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। এরপরেও ‘রিলিজিয়ন’ শব্দটি ধর্মের ইংরেজি প্রতিশব্দ অর্থে ব্যবহৃত হয়। কারণ বিষয়টি প্রচলিত এবং জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আমাদের পরম্পরায় যেমন, মহাশূন্যে গতিসম্পন্ন সকলকেই নক্ষত্র বলে। পরবর্তীতে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের চিন্তার আলোকে নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ ইত্যাদি আলাদা আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণতার জন্যে এর প্রয়োজনও আছে। কিন্তু আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে সাথে এদেশীয় অর্থবোধটিও জানা প্রয়োজন।
পশ্চিমা বিজ্ঞান এবং এদেশীয় পরম্পরাগত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয় অত্যন্ত আবশ্যকীয়। এদেশীয় পরম্পরায় বাহিত জ্ঞান-বিজ্ঞান মানেই কুসংস্কার এবং পশ্চিমা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান মানেই সকল শুদ্ধ ; এ মানসিকতা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। পশ্চিমা সংস্কৃতির শব্দের অনুবাদে এদেশীয় পারিভাষিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বহুক্ষেত্রেই আমাদের গোল বেঁধে যায়। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। আমাদের মামা, জ্যাঠা, কাকা, মেসোমশায়, পিসামশায় ইত্যাদি পারিবারিক সম্পর্কের সবাইকেই আমাদের ভাষায় আলাদা আলাদা ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজিতে সকলকেই এক শব্দে প্রকাশ করা হয়ে হয়েছে ‘আঙ্কেল’। একইভাবে মামি, জেঠি কাকি, মাসিমা, পিসিমা এই এতগুলো সম্পর্কের সকলকেই একশব্দে ‘আন্টি’ বলা হয়। ইংরেজি ‘আঙ্কেল’ এবং ‘আন্টি’ এ দুটি শব্দের বিপরীতে আমাদের এত শব্দ থাকার কারণে; বিদেশিরা আমাদের সম্পর্কগুলো গুলিয়ে ফেলে। এমনকি এদেশীয় যারা শহরে এবং অণুপরিবারে মানুষ হয়েছে তারাও সম্পর্কগুলো গুলিয়ে ফেলে। বুঝতে পারে না কে কাকা, কে মামা, কে পিসামশায়, কে মেসোমশায় ইত্যাদি কে কোন সম্পর্কের আত্মীয়-পরিজন।
শ্রীমদ্ভগবদগীতার “নক্ষত্রাণামহং শশী”- বাক্যটিতে নক্ষত্র বলতে যেমন গতিশীল অর্থে বোঝানো হয়েছে। এ বিষয়টিকে এ অর্থ ছাড়াও আরেকটি অর্থে গ্রহণ করা যায়। নক্ষত্রদের মধ্যে শশী, অর্থাৎ ২৭ টি নক্ষত্রদের মধ্যে শোভমান চন্দ্র। তাই চন্দ্রকে সকল সৌন্দর্যের আধার তারাপতি বলা হয়।পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, রাশিচক্রে চন্দ্রের গতিপথে ২৭ টি নক্ষত্র রয়েছে। চন্দ্র প্রতিদিন এক এক নক্ষত্রে রাত্রি যাপন করে। ছাত্রছাত্রী দ্বারা পূর্ণ ক্লাসরুমের মধ্যে শিক্ষক প্রবেশ করলে; শিক্ষককে কেউ ছাত্র বলে না। তেমনি “নক্ষত্রদের মধ্যে শশী” বাক্যটিতে সকল নক্ষত্রদের মধ্যে চন্দ্র শোভমান – অর্থটিও গ্রহণ করা যায়। আকাশের দিকে তাকালে চন্দ্রের অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা আদি ২৭ নক্ষত্রকে আজও দেখা যায়। পঞ্জিকায় লেখা থাকে, চন্দ্র কবে কোন নক্ষত্রে অবস্থান করছে; ঠিক সেই ভাবেই চন্দ্রকে এক একটি নক্ষত্রে পাওয়া যায়। পঞ্জিকা বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে রচিত। ষড়বেদাঙ্গের অন্যতম হল ‘জ্যোতিষ’। এ জ্যোতিষ বর্তমানের প্রচলিত ‘হস্তরেখা বিদ্যা’ নয়; এ বিদ্যাটি হল নক্ষত্রবিদ্যা। যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, ‘Vedic Astronomy’. প্রাচীনকাল থেকে সে জ্ঞানের ধারা আজও বহমান। প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধারণ মানুষকে বোঝানোর সুবিধার্থে অনেক ক্ষেত্রে রূপকের মাধ্যমে বর্ণনা করা হলেও, এর ফলাফল বা সিদ্ধান্তটি সত্য।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়