তিনি সিদ্ধিদাতা, তিনি বিঘ্নহর্তা, তিনি সকল প্রকার দুশ্চিন্তা দূরকারী একদন্ত। তিনি জ্ঞানের, অক্ষর ও বুদ্ধির দেবতা। তিনি ঋদ্ধি এবং সিদ্ধির স্বামী। তিনি শুভ এবং লাভের পিতা। তিনি তার ভক্তের উপর অশেষ আশীর্বাদের জন্য সারা ভারত তথা বিদেশেও প্রসিদ্ধ। তাই এমনিতে প্রতিদিন নিত্য পূজা থেকে শুরু করে সকল অন্ধকার দূরকারী এই দেবতার পূজা ভক্তিভরে সকল ভক্ত করে থাকেন।
কিন্তু তার জন্মের কাহিনী নিয়ে নানা পুরাণ এবং ধর্ম গ্রন্থে নানা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আর তাই গণেশ চতুর্থীর পুন্য তিথীতে আমরা গণেশ ভক্তগণ সেইসব গল্প বা কাহিনী শুনে নিজেদের ধন্য করবো। তাই এই প্রতিবেদনে আমরা ভগবান গণেশের জন্ম সংক্রান্ত নানা কাহিনী বা গল্প নিয়ে আলোচনা করবো। বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থ অনুযায়ী ভগবান গণেশের জন্ম সম্বন্ধে যে বিভিন্ন বর্ণনা দেওয়া আছে তা আমরা আজ জানবো।
শিবপুরাণ মতে গণেশের উত্পত্তি
কৈলাস থাকার সময় একদিন দেবী পার্বতী স্নান করতে যাওয়ার আগে তার স্নান ঘরের দরজার কাছে ভগবান শিবের একনিষ্ঠ অনুচর নন্দীকে দ্বার রক্ষীর কাজে নিয়োগ করেন। তিনি তাকে বলে দেন তিনি স্নানে থাকার সময় কেউ যেন তার স্নান কক্ষে প্রবেশ করে না। কিন্তু হঠাৎ দেখা যায় দেবাদিদেব মহাদেব সেইখানে এসে হাজির হয় এবং স্নান কক্ষে প্রবেশ করেন, নন্দী মহেশ্বরকে স্নান কক্ষে প্রবেশের আগে কোন বাধা দেন নি।
তারপর এই কুমারকে তিনি খুবই ভালোবাসা দিয়ে নিজের সবচেয়ে পছন্দের সন্তান রুপে আদর করতে থাকেন। একদিন তিনি তার এই সন্তানকে একইরকম ভাবে স্নান করতে যাওয়ার সময় দ্বার রক্ষীর দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন সেইস্থানে আবার মহাদেব এসে হাজির হলে তিনি তাকে স্নান কক্ষে প্রবেশ করতে বাধা দেন। ভগবান শিব তাকে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য জেদ করলে, গণেশ তাকে যুদ্ধে আহবান করেন এবং গণেশের শক্তিতে তিনি বিস্মিত হন। পরে যখন ভগবান শিবের ক্রোধ চরম সীমায় পৌঁছে যায় তখন তিনি তার ত্রিশূল দিয়ে গণেশের মস্তক খন্ডন করেন। পার্বতী যখন স্নান কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে গণেশের নিথর দেহ দেখতে পান এবং পুরো ঘটনা শুনে প্রচন্ড ক্রোধিত হন এবং মহামায়া মূর্তি ধারন করে সমগ্র বিশ্ব ব্রম্ভান্ড বিনাশ করতে উদ্যত হন।
তখন সমগ্র দেবতারা মাতা পার্বতীকে অনুরোধ করেন এই বিনাশ তিনি যেন না করেন। মাতা পার্বতী তখন দুটি শর্ত রাখেন দেবতাদের কাছে। প্রথম শর্তে তিনি গণেশের পুনরায় প্রাণ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান এবং দ্বিতীয় শর্তে তিনি বলেন যে তার এই পুত্র গণেশ যেন সমগ্র দেবতাদের পূজার সর্বাগ্রে পূজিত হন। তার দাবি সকল দেবতারা শুনে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান। এইসময় দেবতারা ভগবান শিবের কাছে যান, ইতিমধ্যেই শিবের ক্রোধ কমে এসেছিল। তিনি তখন তার অনুচরদের জানান উত্তর দিকে যে প্রাণীকে প্রথমেই দেখতে পাবে, তার মুন্ড যেন নিয়ে আসা হয়, সেই মতো তারা বেরিয়ে যায়।
প্রথমেই একটি হস্তী শাবক দেখতে পান তারা, আর তাই তারা হস্তী শাবকের মুন্ডটি নিয়ে আসেন। তারপর ভগবান ব্রম্ভা নিজের হাতে সেই মুন্ড নিয়ে গণেশের দেহে জুড়ে দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবেই গণেশের মুখ হয়ে ওঠে হস্তী মুখ। আর এইভাবেই সমগ্র দেবতার পূজার আগে বিঘ্নেশ গণেশের পূজার প্রচলন শুরু হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে গণেশের উৎপত্তি
দেবী পার্বতী একবার ভগবান বিষ্ণুর প্রকৃত রূপ অর্থাৎ শঙ্খ, চক্র ,গদা এবং পদ্ম হাতের রূপ দেখে সেরকম একটি সন্তান তার হোক বলে মনে মনে বাসনা করেন। তারপর তার বাসনা তিনি ভগবান বিষ্ণুর কাছে জানালে, তিনি তাকে তার ইচ্ছেমতো পুত্র সন্তান হওয়ার বর প্রদান করেন। সেইমতো পার্বতীর গর্ভে শ্রীবিষ্ণুর অনুরুপ সন্তান জন্ম গ্রহন করে। তারপর মহা ধুমধাম সহ যখন সেই সন্তানকে সকল দেবদেবী দর্শন করতে আসে, এবং আশীর্বাদ প্রদান করে যান। কিন্তু শনি দেব সেইখানে উপস্থিত থেকেও তিনি পার্বতীর নব সন্তানের মুখ দেখতে রাজি হচ্ছিলেন না। কারন তার ছিল তার স্ত্রীর অভিশাপ। তার স্ত্রী তাকে অভিশাপ দিয়েছিল, তুমি যার দিকে তোমার দৃষ্টিপাত করবে এক মনে তার মস্তক দেহ থেকে আলাদা হয়ে যাবে।
কিন্তু এই কথা দেবী পার্বতীর জানা ছিল না। তিনি তখন শনি দেবকে তার সন্তানকে দেখে আশীর্বাদ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তবুও ধর্মরাজ শনি রাজি হচ্ছিল না। শেষে অনেক জোরাজুরি করাই শনিদেব যখন পার্বতী পুত্রের দিকে তার দৃষ্টিপাত করেন তখন তৎক্ষণাৎ নব শিশুর মস্তক শরীর থেকে ছিন্ন হয়ে যায়। এই ঘটনায় চারিদিকে হুলস্থুল পড়ে যায়। আর মাতা পার্বতী তার জ্ঞান হারান। তখন ভগবান বিষ্ণু হস্তী শাবকের মুন্ড নিয়ে এসে সেই মস্তকহীন নবশিশুর দেহে স্থাপন করেন এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
বামন পুরাণ অনুযায়ী গণেশের উত্পত্তি
পার্বতী একবার স্নানের সময় নিজের দেহের গাত্রমল থেকে এক চতুর্ভুজ মূর্তি তৈরি করেন এবং পরে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি স্বামী শিবকে তা জানালে মহাদেব তাকে সন্তানের মর্যাদা দেন। যেহেতু এই পুত্র জন্মাতে মহাদেব শিবের কোন প্রয়োজন হয় নি, তাই ভগবান শিব তাকে বিনায়ক নাম দেন। এছাড়াও তিনি ভবিষ্যতে বিঘ্ননাশকারী হবেন বলে মাতা পার্বতীকে জানান।
দেবী পুরাণ অনুযায়ী গণেশের উত্পত্তি
একবার ভগবান মহাদেবের মধ্যে রাজসিক ভাব দেখা দিয়েছিল। আর তার তখন দুই হাত খুবই ঘামতে থাকে।আর এই ঘাম থেকেই গণেশের জন্ম হয়েছে।
মৎস্য পুরাণ অনুযায়ী গণেশের উত্পত্তি
মা পার্বতী যখন একবার স্নান করার জন্য সারা শরীরে বেসন মাখছিলেন, তখন তিনি তার হাতে থাকা বেসন থেকে একটি চতুর্ভুজ মূর্তি তৈরি করেন এবং তা গঙ্গা জলে ফেলে দিলে তা বিরাট আকার ধারন করতে থাকে। ধীরে ধীরে এই আকার সমগ্র পৃথিবী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন দেবী পার্বতী এবং মাতা গঙ্গা তাকে নিজের পুত্র বলে আহ্বান করেন। পরবর্তী সময়ে ভগবান ব্রহ্মা তাকে গনাধিপতি বলে সম্মান জানান।
পদ্মপুরান অনুযায়ী গণেশের উত্পত্তি
ভগবান শিব এবং মাতা পার্বতী একবার হাতির রূপ নিয়ে বনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তাদের মধ্যে রতি ক্রিয়া ঘটার ফলে হস্তী মুখী সন্তান গণেশের জন্ম হয়।
বরাহপুরাণ অনুযায়ী গণেশের উত্পত্তি
একবার দেবগন এবং সমস্ত ঋষিরা মিলে ভগবান শিবের কাছে গিয়ে এমন এক নতুন দেবতা সৃষ্টি করার অনুরোধ জানান তিনি সকল বিঘ্ন দূর করবেন। সেইমতো আশুতোষ আকাশে একটি কুমারের জন্ম দেন তার গণ যুক্ত। এই নব কুমারের রূপ দেখে মাতা পার্বতী এবং সমস্ত দেবগন মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এই রূপের অতিরিক্ত প্রশংসা মাতা পার্বতী করায় নীলকন্ঠ রেগে গিয়ে নতুন কুমারের রূপ বিকৃত করার অভিশাপ দেন। সেইমতো নতুন কুমারের মুখ হয় হাতির মুখের মতো। পেট বা উদর হয় লম্বা বা চওড়া হয়। এইভাবেই ভগবান গণেশের জন্ম হয়।