পোষ্য কোটার বৈষম্য দূরীকরণ হবে মেধার জাগরণ-আজিজুল হক

0
209

পোষ্য কোটার বৈষম্য দূরীকরণ হবে মেধার জাগরণ

আজিজুল হক

বাংলাদেশের সরকারি চাকরি বাজার বিভিন্ন কোটার জাতাঁকলে পিষ্ট। বাংলাদেশের ১ম শ্রেণী থেকে শুরু করে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোটার প্রচলন থাকলেও ১ম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোটা পদ্ধতির শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। তবে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে সব ধরণের কোটা অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উদ্ভুদ্ধ করতে একটা সময় কোটা প্রথার প্রচলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোটা প্রথা একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নয়। কোটা প্রথা মূলত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দেশের কল্যাণে ধাবিত করার জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে উদ্ভুদ্ধ করা হয়। সে লক্ষ্যে সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের দফা- ১ ও ২-এ ধারাবাহিকভাবে বলা হয়েছে ১. সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকিবে; ২. সামজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করতে, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেকোন অনগ্রসর, অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অথবা বঞ্চিত অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভের জন্য নিদিষ্ট সময়ের জন্য কোটা প্রথা মেনে চলতে দেখা যায়। কোটা প্রথা মূলত একটা সাময়িক ব্যবস্থায় মাত্র। অনগ্রসর, অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর যখন উপযুক্ত জায়গায় প্রতিনিধিত্ব ঘটে তখন কোটা প্রথার সংকুলান, সংস্করণ এবং ক্ষেত্র বিশেষ রহিতকরণ ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে এটি ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে এসেও কোটায় ক্ষত-বিক্ষত দেশের চাকরি বাজার। সাম্প্রতিক প্রকাশিত বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৩৫ শূন্য পদের সহকারি ষ্টেশন মাস্টার পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কোটা হারের বিভাজনটি পর্যবেক্ষণ করা যাক – পোষ্য কোটা ৪০%, মুক্তিযোদ্ধা ৩০%, নারী ১৫%, জেলা ১০%, আনসার ভিডিপি ১০%, প্রতিবন্ধী ১০%, উপজাতি ৫% এবং জেলা ৪%। যদিও বর্তমান কোটা বিভাজন এরূপ- মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/ নাতি- নাতনীদের জন্য ৩০%, নারী ১০%, জেলা ১০%, উপজাতি ৫% এবং প্রতিবন্ধী ১% সর্বমোট ৫৬% কোটায়।

স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পোষ্য কোটা যেন সাধারণ চাকুরি প্রত্যাশীদের জন্য খাঁড়ার উপর মরার ঘাঁ সমতুল্য। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতেও পোষ্য কোটার প্রচলন দেখা যায় । কোটা যেখানে সুবিধাবঞ্চিত, অনগ্রসর ও অবহেলিত গোষ্ঠীকে উপযুক্ত স্থানে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বিশেষ সুযোগ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য পোষ্য কোটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা এখন ভাবনার বিষয়। এছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ে, আনসার ভিডিপির মতো অনেকে প্রতিষ্ঠানে পোষ্য কোটার ব্যাপক ছড়াছড়িতে সাধারণ চাকুরী প্রার্থীদের মেধার জোড়ে চাকুরী পাওয়া ভাগ্যের সুপ্রসন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই যদি হয় দেশের সরকারি চাকুরির নিয়োগে কোটা বিভাজন, তাহলে দেশের মেধাবিদের মেধার মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয়। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় কৃতকার্য হয়েও মেধাবীরা তাদের চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। মেধাবী চাকুরি প্রত্যাশীদের জন্য স্বাধীন দেশে এ বৈষম্য সত্যিই পীড়াদায়ক।

সঙ্গত কারণেই এখন সময় এসেছে দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন কোটা পদ্ধতি সংস্কার এবং রহিতকরণের । সুবিধাভোগীদের জন্য চাকুরির সিংহভাগ পোষ্য কোটা রাখা অপ্রাসঙ্গিক এবং বৈষম্যমূলক। বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রেল ও আনসার ভিডিপি সহ অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনির এ পোষ্য কোটা রহিতকরণ করে মেধাবিদের সুযোগ করে দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এ কোটার বিশেষ সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখে অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত খেটে খাওয়া গ্রাম বাংলার কৃষক, জেলেসহ নিম্ন শ্রেণীর মানুষের সন্তান-সন্ততিরা। যেহেতু সংবিধানে কোটা পদ্ধতির প্রচলন মূলত অনগ্রসর, সেহেতু সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য তাই সুবিধাভোগীদের সন্তানদের জন্য পোষ্যকোটা সংবিধানের অবমাননা হয়ে দাঁড়ায়।

সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের ৩নং দফায় বলা হয়েছে জাতীয় জীবনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত করবে। বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিটি জায়গায় নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা, খেলাধুলা কিংবা রাজনীতি কোন সেক্টরেই নারীরা পিছিয়ে নেই। সমতার পাল্লায় নারীরা এখন এগিয়ে। নারীদের ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। সুতরাং মহিলা কোটার ১০ ভাগও সংস্কারযোগ্য হয়ে উঠেছে।

সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর নিয়োগ ব্যতিত দেশের সকল সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত নিয়োগ প্রদানে কম বেশি কোটা প্রথার প্রচলন রয়েছে। দেশের সকল সেক্টরে অতীব প্রয়োজনীয় কোটার সংস্করণসহ পোষ্য কোটার রহিতকরণ সময়ের দাবি। কেননা,কোটা এসেছে সময়ের প্রয়োজনে। আবার বর্তমান সময়ের প্রয়োজনে অন্যান্য কোটা সংস্কার এবং পোষ্য কোটা বাতিল করা জরুরি। আমরা কোটা প্রথার বিরোধী নয়। পোষ্য কোটার জোড়ে অনেকেরই চাকরি পরীক্ষাতে ততটা পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। পোষ্য কোটার ব্যাপক এই হার সাধারণ শিক্ষার্থীদের হতাশাগ্রস্ত করছে। কিন্তু এ ধরনের কোটা প্রথার চিন্তা ভাবনা বর্তমানে আমাদের জাতিকে পিছিয়ে দেবে। মেধাবিরা দেশে নিজেদের মেধার মূল্যায়ন না পেলে তারা বিদেশ পাড়ি জমাতে বাধ্য হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে, আগামী দিনে মেধা পাচারের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। তাই, বাস্তবতা এবং সম্ভবণাময় তরুণদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি ।

শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চ.বি শাখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে