সনেট কি
কবিতার একটি নির্দিষ্ট রীতি হল সনেট। আরো নির্দিষ্টভাবে বললে সনেট হল এক জাতীয় গীতিকবিতা। বংলায় সনেটকে চতুর্দশপদী কবিতাও বলা হয়। চোদ্দ অক্ষর বা মাত্রাযুক্ত পংক্তি বিশিষ্ট, চোদ্দ পংক্তির গীতিকবিতাকে সনেট বলা হয়।
ইতালীয় শব্দ Sonetto থেকে Sonnet শব্দটির উৎপত্তি। ল্যাটিন শব্দ Sonus এর অর্থ হল শব্দ Sound। সেখান থেকে Sonetto উদ্ভব। Sonetto-র অর্থ ছোট শব্দ বা গান। জিয়াকোমো ডা লেন্টিনি (Giacono De Lentini) সনেটে উদগাতা বলে মনে করেন কেউ কেউ। গিডট্রন দ্যা অ্যারেৎসো (Guittone d! Arezzo) একাদশ শতাব্দীতে এটি পুনপ্রচলিত করেন।
বাংলা সনেটের উদ্ভব ইতালীয় সনেট বা পেত্রার্কার সনেট থেকে। বাংলা সনেট নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মধুসূদন দত্তকে বাদ দেবার কোনো উপায় নেই। বাংলায় সনেটের উৎস মুখের সূচনা কবি মধুসূদন দত্তের হাত ধরে। তিনিই প্রথম পেত্রার্কার সনেট অনুসরণে বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতাবলী লেখেন। তিনি কিছু শেক্সপীয়রীয় রীতির সঙ্গেও লিখেছিলেন।
মধুসূদন ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার বড়াল, প্রমথ চৌধুরী, দেবেন্দ্রনাথ সেন, মোহিতলাল মজুমদার, গোবিন্দচন্দ্র দাস, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ, জয় গোস্বামী প্রমুখ কবিরা বাংলা সনেটে রঙ ছড়িয়েছেন।
এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে যে একশটি সনেট লিখেছিলেন তাতে তিনি নানাধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তা ইতালীয় বা শেক্সপীয়রীয় রীতিকে ছাপিয়ে আরও অন্যরকমের হয়েছে। স্তব্ধ বিন্যাস কখনও আট ছয়, কখনও চারচার ছয়, কখনও ছয় ছয় দুই, কখনও চারচার চার দুই, কখনও আট চার দুই, কখনও সাত সাত, কখনও বা দশ চার। প্রমথ চৌধুরীর হাত ধরে বাংলায় ফরাসী ধারার সনেটের প্রবেশ। এর স্তবক আট দুই চার।
সনেট কবিতার প্রবর্তক কে
সনেট কবিতার প্রবর্তক কে এ সম্পর্কে অনেকে মনে করেন সিসিলীয় কবিগোষ্ঠী টুবাদুরদের রচিত প্রভেঁসাল গীতিকবিতা অবলম্বনে সনেট রচনা করেন। আবার অনেকে মনে করেন পিয়ারো দেল ভিনে সনেটের প্রথম প্রবর্তক। তবে এটি সবাই স্বীকার করেন যে বাংলা সনেট কবিতার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
সনেট মিশ্রবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত মূলত পয়ার ছন্দে লিখিত। উপরে আমারা সনেট কি বা কাকে বলে? এ সম্পর্কে জানলাম, তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, সব চতুর্দশপদী কবিতাই কিন্তুসনেট নয়।
সনেটের কয়টি অংশ এবং সনেট কত প্রকার :-
সনেটের দু’টি অংশে ভাগ করা হয় এক অষ্টক (Octave) এবং ষটক (Satak)।
সনেট মূলত তিনটি প্রকার হিসেবে বেশি প্রচলিত। এগুলো হলো-
১ – ইতালিয়ান বা পেত্রাৰ্কীয় সনেট (Italiaon or Petrachan Sonnet)
২ – ফরাসি বা স্পেনসারীয় সনেট (Spenserian Sonnet)
৩ – শেক্সপীয়রীয় সনেট (Shakesperean Sonnet)
এছাড়াও মিলটনীয় সনেট (Mioltonic sonnet), তেজা রিমা সনেট (Terza Rima Sonet) এবং কার্টাল সনেট (Curtal Sonnet) ও উল্লেখযোগ্য।
সনেট কবিতা কত লাইন :-
সনেট কবিতায় ১৪ টি লাইন থাকে। এই ১৪টি লাইন আবার দু’টি অংশে ভাগ করা হয় এক অষ্টক (Octave) এবং ষটক (Sestet)। অষ্টকে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে। ষটকে তারই বিস্তার ঘটে।
সনেটের বৈশিষ্ট্য :-
এখন আমরা চতুর্দশপদী কবিতার বা সনেটের বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে আলোচনা করবো-
১ – চোদ্দ পংক্তি আট ও ছয় পংক্তির স্তবকে বিভক্ত থাকে। প্রথম আট পংক্তি অষ্টক এবং শেষ হয় পংক্তি ষটক নামে পরিচিত।
২ – প্রথম আট পংক্তিতে থাকে ভাবদর উপস্থাপন এবং ষটকে এই ভাবের বিস্তার ঘটে।
৩ – সনেটের স্তবকে অন্ত্য মিল থাকে। অষ্টকের অন্ত্য মিল এরকম হয়- কখ খক কখ খক বা কখ কখ কখ কখ। ষটকের ক্ষেত্রে অন্ত্যমিল গঘঙ বা গঘ গঘ গঘ বা গঘগ গঘগ বা গঘ ঘগ ঙঙ।
৪ – অষ্টক থেকে ষটকে যাবার সময় কবির যোজনা বা সময়ের পরিবর্তন ঘটে।
নিচে এতটি কবিতার মাধ্যমে সনেটের অন্ত্যমিল বিষয়টি পরিস্কার করা হলো-
কপোতাক্ষ নদ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।
কবিতাটির অন্ত্যমিল হচ্ছে প্রথম আট লাইনে কখকখকখখক এবং দ্বিতীয় ছয় লাইনে গঘগঘগঘ অন্ত্যমিল।অনেকেই এই “কখকখকখখক” এগুলো কি আসলে তা বুঝেননা।তাহলে চলুন দেখে নেয়া যাক এগুলো কি।
আসলে সনেটে প্রতিটি লাইনের শেষের অন্ত্যমিলটাকে বিভিন্ন অক্ষর দ্বারা প্রকাশ করা হয়।যেমেন কপোতাক্ষ নদ কবিতায় প্রথম লাইনের শেষ অন্ত্যমিল “নে” (ম+নে) কে “ক” দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।তেমনিভাবে দ্বিতীয় লাইনের শেষে “লে” (বি+র+লে) কে “খ” দ্বারা নামকরণ করা হয়েছে। তাহলে প্রথম অষ্টকের মিলটা দেখুন (নে,লে নে,লে,নে, লে,লে, নে) এটাকে যদি নে= ক,লে= খ ধরি তাহলে প্রথম অষ্টকের অন্ত্যমিল দ্বারায় (কখকখকখখক)।
অপরদিকে দ্বিতীয় ষটকে অর্থাৎ দ্বিতীয় ছয় লাইনে নতুন অন্ত্যমিল আসছে “বে” এবং “তে”। স্বাভাবিক ভাবেই এক কবিতায় আগের অন্ত্যমিলে “ক” এবং “খ” ব্যবহার হওয়ায় এবার নামকরণ করতে হচ্ছে “গ” এবং “ঘ” অর্থাৎ “বে” = গ এবং “তে” = ঘ।তাহলে দ্বিতীয় ষটকের অন্ত্যমিল (বে,তে,বে,তে,বে,তে) = ( গঘগঘগঘ)। একই আরো নতুন কোন অন্ত্যমিল আসলে তাকে “ঙ”,“চ” নামকরণ করা হতো।আশা করি আলোচনাটিতে সনেটের অন্ত্যমিল বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে।