রণজিৎ দাস।।আমার বাবা রণজিৎ দাস।।

0
221

আমার বাবা রণজিৎ দাসঃ—
রিমা দাস

২৯ অক্টোবর ১৯৩২ সালে কমলা কান্ত দাস ও বাসন্তীলতা দাসের সংসার আলো করে এলো তাঁদের পঞ্চম ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, যার নাম রাখা হল “রণজিৎ”।‘রণজিৎ’ মানে যুদ্ধে যে জয়ী হয়।হয়তো সে সময় কমলা কান্ত দাস ও বাসন্তী লতা দাস বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের এই সন্তান এক সময় সুনাম অর্জন করবে, হয়তো তাঁদের মনে হয়েছিল এই সন্তান তার জীবনের প্রাত্যহিক যুদ্ধে কখনো পরাজিত হবে না।রণজিৎ তার বাবা-মার সেই স্বপ্নকে সত্যি করেছেন খেলার যুদ্ধে তার নৈপুণ্য দেখিয়ে।

ছোট থেকেই বাবার সান্নিধ্যে রণজিৎ এর খেলাতে মনোনিবেশ।৩০এর দশকে তার বাবা অবসর গ্রহন করায় তাঁরা সপরিবারে কলকাতা থেকে তাদের মূল বাড়ি সিলেট এ চলে এলেন।সিলেটে আসার পর তিনি তাঁর বাবার হাটার সঙ্গী হলেন।১৯৩৯ এর এপ্রিল মাসের কোনো এক বিকেলে পিতা ও পুত্র যখন হাঁটতে বের হলেন তখন টাউন মাঠে (বর্তমান শহীদ মিনার ও সদর হাসপাতাল)অনেক লোকের ভীড় দেখলেন পুত্র।তাঁর প্রবল আকর্ষন সৃষ্টি হল।তিনি তাঁর পিতার কাছে জানতে চাইলেন—‘কি হচ্ছে সেখানে?’তার পিতা জানালেন ফুটবল খেলা হচ্ছে।সেটা শুনে পিতার কাছে আবদার—‘আমিও খেলা দেখব’।পিতা সেই আবদার রেখেছিলেন।তাঁরা প্রায় ১৫/২০ মিনিট খেলা দেখেছেন,আর হাজার প্রশ্ন করেছিলেন তার পিতাকে।তাঁর পিতাও বন্ধুর মত সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন।পুত্রের এতো আগ্রহ দেখে পিতা সে রাতেই স্লেট নিয়ে ফুটবল খেলার মাঠ একে দেখালেন,শিখিয়ে দিলেন কোন স্থানে কে দাঁড়াবে,তাকে কি বলা হবে ইত্যাদি।আর এভাবেই খেলোয়াড় জীবনের হাতেখড়ি রণজিতের।১৯৩৯-৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি দর্শক হয়ে বিভিন্ন খেলা উপভোগ করেন।

ছোট রণজিৎ ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠার সাথে সাথে তাঁর খেলোয়াড় মনও জাগ্রত হতে থাকল।ফুটবলার রণজিতের প্রথম ভালবাসা ক্রিকেটের সাথে।তখনকার সময়ে শীতের ৩মাস ক্রিকেট খেলা হত এবং বাঙ্গালী খেলোয়াড় ছিল হাতে গুনা ক’য়েক জন। ১৯৪৭ সালে তিনি টাউন ক্লাবের একাদশে খেলার সুযোগ পান।টাউন ক্লাব ছিল সে সময়ের অন্যতম।ক্রিকেট তিনি যতদিন খেলেছিলেন সেখানে তার বেশ কয়েকটি সেঞ্চুরীও আছে।তাঁর বাবা প্রায়ই তাকে বলতেন এই খেলা তাঁর জন্য নয়।এই খেলার জন্য তাকে লাহোর বা বোম্বাই যেতে হবে।অবশেষে ১৯৪৭ সালেই তাঁর বাবার এই কথা সত্যি হয়ে যায়।১৯৪৭ সালের জুলাই এ গণভোটের পর এখানকার গণ্যমান্য /উঁচু শ্রেণির যারা ক্রিকেট খেলাকে পরিচালনা করতেন তারা দেশ ছেড়ে চলে যান।এর ফলশ্রুতিতে ক্রিকেটে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়।সেখান থেকেই আস্তে আস্তে রণজিতের ফুটবলে ঝুঁকে যাওয়া এবং ফুটবলে তাঁর ধ্যা্ন জ্ঞান স্থাপন করা।শুধু ফুটবল নয়,তার পাশাপাশি তিনি টেবিল টেনিস,ভলিবল ও হকিতেও সমান পারদর্শিতা দেখান।

ফুটবলের বিভিন্ন পজিশনে খেলতে খেলতে রণজিৎ গোলকিপারে স্থিতু হন যখন তিনি ক্লাস ৯ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।দি এইডেড হাই স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে উঠার পর দলনেতা নির্বাচিত হন ফুটবলার হামিদ।তখন হামিদ রঞ্জুকে গোলকিপার থেকে সরিয়ে তাঁকে গোল পোষ্টের অতন্দ্র প্রহরী নিযুক্ত করেন।হামিদের দৃঢ় মনোবল,তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, অনুশীলনী এবং অনেকের সহযোগিতায় সৃষ্টি হলেন আজকের অজেয় রণজিৎ।প্রথম দিকে রণজিৎকে অন্যান্য গোলকিপার/খেলোয়াড়রা তেমন পাত্তা দিত না।তারা মনে করত এই পজিশনে খেলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।কারণ তাঁর উচ্চতা ছিল ৫ফুট ৪ইঞ্চি,যা অন্যান্য গোলকিপারের তুলনায় অনেক কম।১৯৫৪ সনে তিনি টাউন ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দেন।ভাল কোন খেলায় তাকে না নেয়ায় তিনি মনে মনে ক্ষুব্ধ ছিলেন,ছিলেন হতাশও।এই ক্ষোভ ও হতাশাকে তিনি প্রচন্ড জেদে পরিণত করেন।কঠোর পরিশ্রম,অনুশীলন ও দক্ষতার মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে চাইলেন দৈহিক সীমাবদ্ধতা।অবশেষে ৭ অগাষ্ট ১৯৫৪ সালে সুযোগ এলো নিজের যোগ্যতা প্রমাণের।ফুটবলার জামান ভাই এর প্রস্তাবে তারা খেলতে যান হবিগঞ্জে।সেখানে হবিগঞ্জ টাউন ক্লাব বনাম ইউনাইটেড ফ্রেন্ডস ক্লাবের মধ্যে ফাইনাল খেলায় অংশগ্রহণ করেন তিনি।ঐ দিন হবিগঞ্জ পৌছেই তিনি মুখোমুখি হলেন এক তিক্ত অভিজ্ঞতার।সেদিনের নামী-দামী খেলোয়াড়ের ভিড়ে গোলরক্ষক রণজিৎ হলেন হাসির পাত্র,উপেক্ষিত।প্রচন্ড জেদী রণজিৎ তখন সমস্ত অপমান সহ্য করলেন,আর তাতে বেড়ে গেলো তাঁর নিজেকে উজাড় করা ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শনের ইচ্ছা।তৎকালীন জেইল মাঠে (বর্তমান জালাল ষ্টেডিয়াম)সেদিন তাঁর অনুপম ক্রীড়া নৈপুণ্যে জিতিয়ে দিলো তাঁর দলকে এবং অসাধারণ ড্রাইভ ও বল ধরার ক্ষমতায় অজ্ঞাত রণজিৎ দর্শকদের নন্দিত নায়কে পরিণত হলেন। তারপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যারা তাঁর উচ্চতা নিয়ে কথা বলেছিলেন, যারা তাঁকে কিছুই পারবে না বলে ধরে নিয়েছিলেন তাদের সবার মুখ বন্ধ করে দেবার জন্য একটা সুযোগ মনে মনে তিনি চাইছিলেন। আর তাঁর মনের সেই ঐকান্তিক ইচ্ছা এভাবেই বাস্তব হয়ে যায় এবং রণজিৎ সপ্রতিভভাবে নিজেকে মেলে ধরেন।

তিনি নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ময়ুরের মত ধীরে ধীরে মেলে ধরছিলেন। আর এই নান্দনিকতা যারা দেখেছিলেন তাদের সবার কাছে এক বিস্ময় ছিলেন রণজিৎ দাস। গোলপোস্টের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন তিনি। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে গোল করা প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াত। রণজিৎ দাস বলেন—” ফুটবল একটা দলগত খেলা। এখানে ব্যক্তিগত দক্ষতা দেখানোর সুযোগ কম। দলের সব খেলোয়াড়ের কম বেশি ভুল শোধরানোর সুযোগ থাকে, কিন্তু একজন গোলকিপারের ভুল শোধরানোর কোন সুযোগ নেই।” তিনি তাই তাঁর সর্বোচ্চ দিয়ে খেলতেন। প্রতিটি খেলায় তাই দেখা যায় বলের উপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন থাকত। যার ফলশ্রুতিতে খেলাতে পরাজিত হলেও গোলের ব্যবধান থাকত ১/২। বল যেকোন উপায়েই হোক তাঁর হাতে নেবার জন্য তিনি অনেকবার নিজের জীবন বাজি রেখেছেন। একবার একটা ফাইনাল খেলায় প্রায় গোল হওয়া থেকে দলকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি ড্রাইভ দিলেন, বল ধরলেন কিন্তু বলকে নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নিচে নামার সময় অন্যে কাঁধে লেগে মারাত্মকভাবে জখম হলেন। দাঁত দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তেই লাগলো। কিন্তু তিনি মাঠ ছেড়ে যান নি। খেলার মধ্যে সবাই দেখছিলো তাঁর জার্সি রক্তে একাকার। যেহেতু খেলা প্রায় শেষের পথে তাই তিনি কোন ধরনের রিস্ক এ যেতে চাননি। অবশেষে খেলা শেষের বাঁশি বেজে উঠলো, তারা জয়ী ঘোষনা করার পর তিনি তাঁর ক্ষত দেখালেন। সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করলো কতটুকু নিবেদিতপ্রাণ হলে এরকম করা সম্ভব। কারণ ঐ আঘাত এতটাই শক্তিশালী ছিলো তাঁর উপরের পাটি দাঁতগুলো ভেতরে ডেবে গিয়েছিলো, চোখের উপরের অংশ কেটে গিয়েছিলো। সেই আঘাতে ডাক্তার তাঁকে তিন মাস বেড রেস্ট দিয়েছিলেন। তাঁর রক্তের মধ্যে যে নেশা ছিলো সেই নেশায় তিনি একমাসও ভালো করে রেস্ট নেননি।

১৯৫৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৬৫ খ্রিঃ ছিলো তাঁর ফুটবলের স্বর্ণালী সময়। তখন তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে। খেলার পাশাপাশি তিনি তখন একজন দক্ষ ব্যাংক কর্মকর্তা। ১৯৬৩/৬৪ খ্রিঃ এ ব্যাংকিং পেশা এবং ফুটবলের পাশাপাশি তখন তিনি হকি টিম গঠন করার পরিকল্পনা করেন এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে খেলোয়াড়দের এনে গঠন করেন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ( বর্তমানের সোনালী ব্যাংক) হকি দল। সেই হকি দল ১৯৬৬ সালে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়ানশিপে অংশগ্রহণ করে রাওয়ালপিন্ডিতে। এই বছরই তারা ঢাকা আতিকুল্লা কাপ হকি চ্যাম্পিয়ানশিপে রানার্সআপ হন। ফুটবলের পাশাপাশি হকির গোলপোস্টেরও অতন্দ্র প্রহরী রণজিৎ, যার জন্ম যুদ্ধে বিজয়ী হবার জন্য।

আমরা তাঁর শুধু সফলতা জানি। আমরা জানি না বা জানতে চেষ্টা করি না একজন শিল্পীর বুকের গভীরে জমানো কষ্টের কথা। যে কষ্ট ফল্গুধারার মত তাঁর হৃদয়ে প্রবহমান। আমি আজ শুধু একজন লেখক নই, আমি তাঁর আত্মজা হিসেবে জানি তাঁর বেদনার কথা। সেই সময়ে যদি রণজিৎ দাসের খেলা ধারণ করে রাখা যেতো তবে পৃথিবীবাসী জানতো আমাদের এই দেশেও একসময় পেলে, ব্যাকেন বাওয়ার, ম্যারাডোনা, মিশেল প্লাতিনি, ববিমুর, মেসি প্রমুখ খেলোয়াড়দের মত সমান দক্ষতার খেলোয়াড় ছিলেন। আমাদেরও ছিলো বিশ্বকাপ খেলায় অংশগ্রহণকারীদের মত খেলোয়াড়। আমরাও পারতাম তাদের সমকক্ষ হয়ে খেলতে, যা এখন স্বপ্নের মত শুনায়।

তিনি দক্ষ খেলোয়াড়ের পাশাপাশি একজন দক্ষ প্রশিক্ষকও ছিলেন। তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে সিলেটের অনেক খেলোয়াড়। চাকুরি জীবন ও খেলোয়াড় জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি বিভিন্ন কারণে আরও অন্তর্মুখী হয়ে যান। যে মাঠ তাঁকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করত, যে স্টেডিয়াম গঠনে তাঁর অনেক অবদান সেই মাঠে খেলা হলে তিনি যেতেন না। একটা তীব্র অভিমানবোধ ছিলো তাঁর মধ্যে। একদিন যখন জানতে চাইলাম —- এত ভালোবাসার জায়গা, যাও না কেন? তাঁর স্পষ্ট উত্তর —” সারা জীবন স্টেডিয়ামের মূল গেইট দিয়ে প্রবেশ করেছি, বেরও হয়েছি মাথা উঁচু করে মূল গেইট দিয়ে। এখন আমাকে অন্য গেইট দিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতে হবে?” কি তীব্র বোধ! তাঁকে বোঝার মত সক্ষমতা আমাদের নেই। এখনও দেখি সিলেট স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক খেলা হচ্ছে অথচ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুরষ্কার পাওয়া ব্যক্তিটি কোন খবর পান না। তাতে তাঁর আক্ষেপ নেই এতটুকুও। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাঁর কাছে তাই লজ্জিত হই। আর দেখি মানুষটি কি নির্লিপ্ত! তাঁর মধ্যে নেই কোন চাওয়া পাওয়া, রাগ, অভিমান। একজন সাত্ত্বিক মানুষের প্রতিরূপ —- রণজিৎ দাস।

শুভ জন্মদিন বাবা। বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তোমার জন্য। আমি তোমার মত হতে চাই, যদিও জানি এই জীবনে তা সম্ভব নয়। আমাদের মাথায় ছায়া হয়ে থাকো আজীবন। আমার বটবৃক্ষ, আমার বাবা, আমার সন্তান, আমাদের বাবা আমাদের অহংকার ♥♥

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে