মহাবীর বারবারিকের দৃষ্টিতে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ বীর যিনি
মহাভারতের যুদ্ধ শুরুর আগে, শ্রীকৃষ্ণ সব মহারথীদের পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তাদের একা যুদ্ধ শেষ করতে কত সময় লাগবে। ভীষ্ম জবাব দিয়েছিল তার ২০ দিন লাগবে। দ্রোণাচার্য বলেছিলেন ২৫ দিন সময় নেবেন। কর্ণ বলেছিলেন ২৪ দিন এবং অর্জুন বলেছিলেন যে তার ২৮ দিন সময় লাগবে। সবশেষে, কৃষ্ণ বারবারিক কে জিজ্ঞাসা করতেই বারবারিক জানালো, এই আসন্ন মহা যুদ্ধে উপস্থিত সকলকে তিনি এক মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কথাটি শুনে চমকে গেলেন। মাত্র এক মুহূর্তে যুদ্ধ শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী !! তাহলে কি বারবারিকই ছিলেন সেরা বীর সমকালীন ভারতে ?
ও হো, আগে বারবারিকের পরিচয়টা দেই। ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র ঘটোত্কচের ছেলে হচ্ছে বারবারিক। ঘটোত্কচের সঙ্গে বিয়ে হয় আহিল্যাবতীর। বারবারিক কে যুদ্ধবিদ্যা শেখান মাতা আহিল্যাবতী। ছেলের অন্তরে দয়ামায়ারও সঞ্চার করেন তিনি। বেদ ব্যাসের মহাভারতে বারবারিকের উল্লেখ নেই। আমরা পৌরাণিক ভাবে স্কন্ধ পুরানে, মহাভারতের অন্যান্য বিভিন্ন সংস্করণে এবং বিভিন্ন লোকগাথায় তাঁর উপস্থিতি খুঁজে পাই। দক্ষিণ ভারতে বারবারিকের পরিচয় এক শাপ ভ্রষ্ট যক্ষ। আবার রাজস্থানে তিনি পূজিত হন খাটুশ্যাম নামে।
পিতামহী হিড়িম্বা বারবারিককে ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রদান করতে থাকলেন। বারবারিক একদিন জিজ্ঞাসা করলেন হিড়িম্বাকে, মোক্ষ প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজ উপায় কি ? হিড়িম্বা বললেন , যদি তুমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতে বীরগতি প্রাপ্ত হও ,তবেই মোক্ষ লাভ ঘটবে। এরপর দিব্য অস্ত্রে বলীয়ান হওয়ার জন্য তিনি সিদ্ধিমাতার, মতান্তরে মহাদেবের আরাধনা শুরু করেন। সাধনায় তুষ্ট হয়ে সিদ্ধিমাতা অদ্ভুত তিনটি বান তাকে দিলেন। প্রথম বান শত্রুপক্ষের সকলকে চিহ্নিত করে। দ্বিতীয় বান নিজ পক্ষের যোদ্ধাদের চিহ্নিত করে, যারা সুরক্ষিত থাকবে। আর তৃতীয় বান চিহ্নিত সকল শত্রুকে ধ্বংস করে। এই তিন বানের কারনে বারবারিক তখন অজেয়।
এদিকে কুরুক্ষেত্রে বেজে উঠেছে যুদ্ধের ভেরী। বারবারিক তার অমোঘ অস্ত্র নিয়ে চললেন যুদ্ধে যোগ দিতে। আর কেউ না জানলেও কৃষ্ণ জানতেন যুদ্ধেবারবারিক যোগ দিলে যুদ্ধ নিমেষে শেষ হবে এবং ধর্ম সংস্থাপনের ক্ষেত্রে কৃষ্ণের তৈরি সকল সমীকরণ পাল্টে যাবে। তাই যেকোন ভাবেই বারবারিক কে যুদ্ধে যোগদানে বিরত করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ তখন এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারন করে, করুক্ষেত্রের দিকে আসতে থাকা বারবারিকের সামনে উপস্থিত হলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি যুদ্ধ করতে যাচ্ছ, কিন্তু তোমার সাথে সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র কোথায় ? বালক উত্তর করলো আমার কোন সৈন্যের প্রয়োজন নেই, আমি আমার এই তিনটি বানের দ্বারা নিমিষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ করে দিতে পারি। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কৃষ্ণ উত্তর শুনে। আগ্রহী হলেন বারবারিকের বানের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে।
বারবারিককে বললেন, যে অশ্বত্থ গাছের নীচে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার সবুজ সব পাতাকে একটিমাত্র তীরে গেঁথে দেখাও। বারবারিক এই কাজটি সম্পাদন করার জন্য ধ্যান করা শুরু করার সাথে সাথে বালকটির অলক্ষ্যে গাছ থেকে একটি পাতা ছিঁড়ে নিজের পায়ের তলায় লুকিয়ে ফেলেন শ্রীকৃষ্ণ। প্রথম তীরটি ছোঁড়ার পর সেটি চোখের নিমেষে গাছের সবকটি পাতাকে চিহ্নিত করে শ্রীকৃষ্ণের পায়ের ঠিক ওপরে দাঁড়িয়ে পরে, যেখানে লুকোনো পাতাটি আছে। বারবারিক ব্রাহ্মণকে অনুরোধ করে তার পা সরিয়ে ফেলতে, অন্যথায় পরবর্তী বাণ পা ভেদ করে পায়ের নিচের পাতা ছেদন করবে। এরপর যথারীতি তৃতীয় বাণটি নিক্ষেপ করলেন বারবারিক, সমস্ত পাতা ছেদন করে ফিরে গেল তার তূনে।
কৃষ্ণ নিশ্চিত হলেন বারবারিকের শক্তি সম্পর্কে। এবারে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কোন পক্ষে যুদ্ধ করবে ?বারবারিক বললেন, আমি মাতাকে কথা দিয়েছি,যে পক্ষ দুর্বল,সেই পক্ষে আমি যুদ্ধ করবো। কৌরব পক্ষে ১১ অক্ষৌহিনী সেনা অপরদিকে পান্ডবের মোটে ৭ অক্ষৌহিনী সেনা। আমি তাই পাণ্ডব পক্ষেই যোগ দিব। কৃষ্ণ এবারে বললেন, আজ পাণ্ডবদের হয়ে তুমি যুদ্ধ করলে কৌরব পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়বে তখন তুমি কি করবে ?বারবারিক বললেন আমি তারপর কৌরবদের হয়ে লড়বো।কৃষ্ণ শুনে বললেন, বেশ কথা। তারপর আবার পাণ্ডবদের সেনা ক্ষয় হবে আর ওরা দুর্বল হয়ে যাবে। এভাবে যুদ্ধ করলে তো তুমি ছাড়া আর কেউই জীবিত থাকবে না।বারবারিক শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ,তবে উপায় কি ? শ্রীকৃষ্ণ বললেন এর সমাধান হল যুদ্ধে অংশগ্রহন না করা। অনেক ভেবেও শ্রীকৃষ্ণের প্রস্তাবে সম্মত হতে পারল না বারবারিক। কারণ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এতে মনে করবে বারবারিক কাপুরুষ ছিল। তাই বললেন, যুদ্ধে যোগ না দেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কৃষ্ণ বুঝলেন এভাবে বারবারিককে নিবৃত করা যাবে না। তাই তিনি ভিন্ন পথ নিলেন। ব্রাহ্মনবেশী কৃষ্ণ ভিক্ষা চাইলেন – ভবতি ভিক্ষাঙ্গ দেহি। বারবারিক বললেন – কি চাই আপনার বলুন। ব্রাহ্মণ বললেন – আপনার মস্তক চাই। বারবারিক বুঝতে পারলেন ইনি কোন সাধারণ ব্যক্তি নন। তাই পরিচয় জানতে চাইলেন ব্রাহ্মণের। শ্রীকৃষ্ণের পরিচয় পেয়ে সে আপ্লুত হয়ে গেলেন। বুঝতে পারেন আজন্মকাল লালিত স্বপ্ন মোক্ষ লাভের সময় তার এসে গেছে।
বারবারিক তার অন্তিম আর্জি জানালেন।আমার মস্তক আপনি পাবেন, তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ দেখার আমার খুব সাধ। সেই ইচ্ছা কি আপনি পূরণ করতে পারেন না , হে মধুসূদন!করুনার উদ্রেক হলো কেশবের মনে। আশীর্বাদ করে বললেন, হে বালক, শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেলেও তোমার মস্তক জীবিত থাকবে। ছিন্ন মস্তক কুরুক্ষেত্রের একটি উঁচু জায়গাতে স্থাপিত হবে, সেখান থেকে সম্পূর্ণ যুদ্ধ দেখতে পারবে । আশ্বাস পেয়ে বারবারিক তার মস্তক ছিন্ন করে শ্রীকৃষ্ণের হাতে দিলেন। শ্রীকৃষ্ণও কুরুক্ষেত্রের সুউচ্চ স্থানে সেই মস্তিষ্ক স্থাপন করলেন, যেখান থেকে বারবারিক পুরো যুদ্ধ দেখলেন। আঠারো দিনের যুদ্ধাবসানের পর কে বেশি বীরত্ব দেখিয়েছে? অর্জুন নাকি ভীম- যখন এই নিয়ে সবাই তর্কে ব্যস্ত, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাদের নিয়ে যান বারবারিকের মাথার কাছে। তারা বারবারিককে বললেন, যেহেতু তুমি সম্পুর্ন যুদ্ধ দেখেছ, তুমিই বল, কে এই যুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর? প্রশ্ন শুনে ঈষৎ হাসলেন বারবারিক, বললেন, ‘আমি শুধু শ্রীকৃষ্ণকেই দেখেছি। নিহত ও নিধনকারী – সবই আসলে কৃষ্ণ। সুতরাং তিনিই এই যুদ্ধের শ্রেষ্ঠতম বীর! আমি দেখেছি, অর্জুনের তীর বা ভীমসেনের গদা শত্রুর প্রাণ নেয়ার আগেই কৃষ্ণের চক্র শত্রুর সংহার করে ফেলেছে। এইভাবে সমগ্র গীতার সারাৎসার অতি সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় বারবারিক। শ্রীকৃষ্ণ খুশি হয়ে তাকে বর দেন, কলিযুগে আমার জায়গা নিয়ে তুমি দুষ্টের দমন করবে। আমার নামেই লোকে চিনবে তোমায়। সেই বরে খাটু শ্যামজি নামেই পূজিত হন বারবারিক।
একলব্য আর বারবারিক দুজনের মধ্যেই এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। দুজনেই মহান বীর,একজন ত্যাগ করলেন আঙ্গুল, একজন মস্তক – তবুও মহাকাব্যে উপেক্ষিতই থাকলেন তারা। যারা স্বার্থ ত্যাগ করেন তারা থেকে যান উপেক্ষিত – যুগে যুগে এই বোধ হয় নিয়ম।
তথ্যসূত্র –
1) দেবদূত পট্টানায়েক – Jaya – an illustrated retelling of the mahabharata
2) স্কন্দপুরান
3) wikipedia – Barbarika
4) santanexpress এ প্রকাশিত প্রবন্ধ বর্বরিকঃ কৃষ্ণকে মস্তক উৎসর্গকারী শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ | খাটু শ্যামের কাহিনী |