পণতীর্থ ধাম ও বারুণী স্নানঃ ধামের ইতিকথা,মাহাত্ম্য

0
1055

পণতীর্থ ধাম ও বারুণী স্নানঃ ধামের ইতিকথা,মাহাত্ম্য

প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে তাহিরপুর উপজেলার গঙ্গারূপি যাদুকাটা নদীতে পুণ্যস্নান সম্পন্ন করেন লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী। পুতপবিত্র ও মাঙ্গলিক কামনার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী পুরুষ নিজেদের মনোবাসনা পূরণের জন্য এখানে তারা আসেন।তো বন্ধুরা চলুন আজ জেনে নেয়া যাক পণতীর্থ মহাধামের আদি-অন্ত ইতিহাসটুকু জেনে আসি।

পণতীর্থের ইতিহাস

১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে পণতীর্থের সূচনা করেন শ্রীমান অদ্বৈত আচার্য্য প্রভু। মানুষ তাঁকে গৌরআনা ঠাকুর বলে জানেন। তাঁর জন্মস্থান (বর্তমান বাংলাদেশের)তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের নবগ্রামে। নদী ভাঙনে নবগ্রাম আজ বিলীন। সে সময় নবগ্রামের অবস্থান ছিল লাউড় রাজ্যের লাউড়েরগড় এলাকায়। বর্তমানে মন্দির গড়ে উঠেছে যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী লাউড়েরগড়ের পার্শ্ববর্তী রাজারগাঁও গ্রামে।

ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় , প্রাচীন শ্রীহট্ট এক সময় জৈন্তা রাজ্যের অংশ ছিল। পরবর্তীতে তিনটি অংশে বিভক্ত হয়। রাজ্য তিনটির নাম ছিল জৈন্তা, গৌড় ও লাউড়। ভারতের আসাম কামরূপ থেকে রাজা কামসিন্ধুর বিধবা স্ত্রী উমরী রাণী জনৈক প্রগশপতির দ্বারা হুমকি প্রাপ্ত হয়ে শ্রীহট্টের উত্তরাঞ্চলে চলে আসেন। ইতিমধ্যে তিব্বত এর হাথক শহরের যুবরাজ কৃষক চৌদ্দ ভাগা নদীর তীর ধরে ঘুরে ঘুরে জৈন্তাপুর এসে উপনীত হন। এখানে উমরী রাণীর সাথে পরিচয়ের পর চৌদ্দভাগা তাঁকে বিয়ে করেন। তাদের একটি পুত্র সন্তান হলে নাম রাখা হয় হাথক। পরবর্তীতে হাথক নামধারী কমপক্ষে ৯ জন রাজা জৈন্তাপুর রাজত্ব করেন। দশম রাজা গোবিন্দরাজ কেশব দেব একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজত্ব করেন। এরপর হাথকের পুত্র গুহক জৈন্তার রাজা নিযুক্ত হন। গুহক তাঁর তিন পুত্রকে সমানভাবে রাজত্ব ভাগ করে দিলে লুব্দুকের নামানুসারে তাঁর অংশের নাম হয় লাউড়। লাউড় রাজ্য বর্তমান লাউড়ের পাহাড় এবং সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীতে লাউড়ের রাজত্ব করেন আচার্য্য পরিবারের অরুণাচার্য্য বিজয় মানিক্য। সর্বশেষ দিব্যসিংহ। ঠাকুরবাণীর শ্রীধাম
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈতাচার্য্যর পিতা কুবেরাচার্য্য বা কুবের মিশ্র তর্ক পঞ্চানন রাজা দিব্য সিংহের মন্ত্রী ছিলেন।তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল নাভাদেবী।তিনি খুবই ধার্মিক পূণ্যবান মহিলা ছিলেন।তাঁর গর্ভের ছয়টি সন্তানই অজানা কারণে মারা যান।একপর্যায়ে যখন কুবের মিশ্র এবং নাভাদেবী হতাশ হয়ে পড়েন ঠিক তখনই সপ্তম সন্তান হিসেবে জন্ম নেন আজকের অদ্বৈত্যাচার্য প্রভু।তখন তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কমলাক্ষ মিশ্র।তাঁর গুরু মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর নাম হয় শ্রী অদ্বৈতাচার্য।

অদ্বৈত প্রকাশ গ্রন্থে উল্লেখ আছে-এক রজনীতে শ্রীঅদ্বৈত আচার্য ঠাকুরের মা নাভাদেবী স্বপ্নে দর্শন করেন তিনি গঙ্গা জলে স্নান করছেন। পরদিন সকালে রাতের সেই স্বপ্নের কথা তাঁর ছেলে অদ্বৈত আচার্য ঠাকুরকে বলেন। কিন্তু নাভাদেবী বৃদ্ধ হওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে গঙ্গা স্নান করা তাঁর পক্ষে মোটেই সম্ভব ছিল না। অদ্বৈত আচার্য ঠাকুর মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন বৃদ্ধ মাকে কিভাবে গঙ্গা স্নান করানো যায়। তখন তাঁর ভাবনায় আসে যেভাবে হোক তিনি এই স্থানেই (লাউড়ে) সপ্ত গঙ্গার আনয়ন করবেন এবং মায়ের গঙ্গা স্নানের অভিলাষ পূরণ করবেন। সেই কথা চিন্তা করে অদ্বৈত আচার্য ঠাকুর লাউড়ের এক ক্ষুদ্র পাথরের উপর ঝর্ণার জলের ধারায় সপ্তগঙ্গার আনয়ন করেন।তখন শ্রী অদ্বৈতার্যের মা নাভাদেবী তৃপ্তিভরে গঙ্গা স্নান করেন।সেই থেকেই যাদুকাটার নদীর তীরে প্রতিবছর চৈত্রমাসে মধুকৃষ্ণা তিথীতে গঙ্গা স্নান তথা বারুণী স্নান শুরু হয়। প্রভু অদ্বৈতাচার্য যোগবলে সপ্তগঙ্গাকে প্রতিজ্ঞা তথা পণ করিয়ে ছিলেন যে প্রতিবছরই মধুকৃষ্ণা তিথীতে তাহিরপুরের নবগ্রাম সংলগ্ন যাদুকাটা নদীতে আসতে হবে।সপ্তগঙ্গাও পণ স্বীকার করেছিলেন তারা আসবে এবং আসছেও।সেই থেকে তীর্থটির নামকরণ হয় পণতীর্থ বা পণাতীর্থ।এখানে স্নান করলে মহাপূণ্য হয় বলে অনেকেই একে পূণ্যতীর্থও বলে থাকেন।

পণতীর্থ মাহাত্ম্য

পাপ ক্ষয় ও পূণ্য অর্জনে পণতীর্থের মাহাত্ম্য ব্যপক। পণতীর্থ হচ্ছে শ্রীদ্বৈত আচার্যের প্রকটভূমি (যদিও অদ্বৈত আচার্যের স্মৃতিচিহ্ন নদীগর্ভে বিলনি হয়ে গেছে)। এই স্থানটি অদ্বৈত প্রকাশ, অদ্বৈত মঙ্গল ও ভক্তিরত্মাকরসন বহু বৈষ্ণব গ্রন্থে এক মহান তীর্থস্থান রূপে পরিগণিত হয়েছে।অদ্বৈত প্রকাশ গ্রন্থে লাউড়কে কারণ সাগরের আবির্ভাব রূপে বর্ণনা করা হয়েছে- “শ্রী লাউড় ধাম কারণ রত্মাকর হয়”। এই স্থানটি বর্তমান যাদুকাটা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। নদীর পূর্বপাড়ে রয়েছে রাজারগাঁও (নবগ্রাম)। যেখানে একটি ছোট মন্দির রয়েছে। নদীর পশ্চিম তীরে রয়েছে ইস্কনের একটি বৃহৎ ও নয়নাভিরাম মন্দির। সেখানে স্থাপিত হয়েছে, শ্রীশ্রী রাধা-মদনগোপাল বিগ্রহ, শ্রীজগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রা মহারাণীর বিগ্রহ এবং অদ্বৈত আচার্য্যর বিগ্রহ। এখানে মধুকৃষ্ণা এয়োদর্শীতে বিশাল অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়।

পরিশেষে বলা যায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পণতীর্থ এক মহাপূণ্য অর্জনের তীর্থ।লোকমূখে শোনা যায় “সব তীর্থ বার বার, পণতীর্থ একবার”। তাই বুঝাই যাচ্ছে তীর্থটির গুরুত্ব কতটুকু।এর প্রমাণ প্রতিবছর দেশ বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী এসে এখানে জড়ো হোন বিভিন্ন মাঙলিক কর্ম সাধনের জন্য।সরকারের উচিত তীর্থটির উন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়া এবং তীর্থ স্নান চলাকালিন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখা।

লেখক

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রবান্ধিক

তথ্যসূত্রঃ দৈনিক জালালাবাদ,সিলেটের ডায়রি,দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর,সুরমা মেইল,বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা,বিভিন্ন ধর্মীয় ফেসবুক গ্রুপ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে