ধর্মপাশা নামের উৎপত্তি

0
290

ধর্মপাশা নামের ব্যুৎপত্তি
শাকিল আহমেদ মুন

সিলেটের বিভাগের অন্তর্গত সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর পূর্ব হাওর-বাওর নদী খাল বিল অধ্যুষিত অঞ্চল ধর্মপাশা। এই ধর্মপাশা হিন্দু ভূ-স্বামীদের অঞ্চল ছিলো। কংস নদের উত্তর পাড়ে গড়ে উঠে হাট-বাজার। সেখান থেকেই কালের পরিক্রমায় বিস্তার ঘটতে শুরু করে। হাওরের মানুষের একমাত্র ভরসার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠে এই ধর্মপাশা।

ধর্মপাশা উপজেলার, সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নে অবস্থিত প্রায় ৩০০ বছর আগের মোগল আমলের সুখাইড় জমিদার বাড়িটি ভাটি বাংলার রাজমহল হিসেবে বহুল পরিচিত, যা কালের বিবর্তনে এখনো ধর্মপাশা উপজেলার বুকে কালের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আছে। তাছাড়া রাজাপুর জমিদার বাড়ি, সেলবরষ জমিদার তোঁতা মিঞার জামে মসজিদ ও মহিষখলা কালীমন্দির পাঁচ’শ বছরের ইতিহাস নিয়ে ধর্মপাশার বুকে কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে ।ব্রিটিশ শাসনামলের জমিদারী প্রথা ভেঙ্গে যাওয়ার পর ১৯৪২ সালে ধর্মপাশাকে থানায় রূপান্তর করা হয় এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে।

কালের বিবর্তনে এই ধর্মপাশা নতুন রূপে আবির্ভাব ঘটেছে ।আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে চৌদিকে। আধুনিকতায় নামে পুরোনো ধরমপাশা নামটিও পরিবর্তন এসেছে।

‘‘ধরমপাশা পাখির বাসা
মা করে’না পুতের আশা’’

লোকশ্রুতিতে এই প্রবাদ বাক্যটি বহুল প্রচলিন আছে ধরমপাশায়।যদি আমরা এই প্রবাদটি শত বছরের পুরোনো, তা যদি বিশ্লেষন করি । তাতে পাওয়া যায়, ‘ধরমপাশা’ শব্দটি ভাঙ্গলে দুটি শব্দ পাই প্রথমটি ‘ধরম’ হাওরাঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দ যার অর্থ হলো ‘বেড়া’ হাওরের মাটির ঘরে পার্টিশান বা ঘরের ভিতরে রুম তৈরী করার জন্য এক ধরণের বাঁশ বেত দিয়ে নকশি করে বেড়া তৈরি করা হয় যাকে ধরম বলে আখ্যায়িত করা হয়। ‘পাশা’ হলো আঞ্চলিক অর্থে পাশে বা পাশাপাশিকে বুঝায়। তাহলে সার্বিক অর্থ হলো বেড়ার পাশাপাশি। প্রবাদটির প্রথম লাইনে আরো দুটি শব্দ আছে ‘পাখির বাসা’ পাখি বলতে এখানে মানুষকেই বুঝানো হয়েছে। আর ‘বাসা’ হলো ঘর। দ্বিতীয় লাইনে ‘মা’ হলো জননী জন্মধাত্রী ‘করে’না’ মানে চায় না। ‘পুত’ শব্দটি আঞ্চলিক শব্দ পুত বলতে এখানে ছেলে বা পুত্র সন্তানকে নিদিষ্টি করে বুঝানো হয়েছে। আর প্রবাদটির দ্বিতীয় লাইনের সর্বশেষ শব্দ ‘আশা’ হলো চাওয়া পাওয়াকে বুঝিয়েছে।

সামগ্রিক অর্থে যদি আমরা এই প্রবাদটিকে ব্যুৎপত্তি গত ভাবে বিশ্লেষন করে পাই।বেড়ার ওপাশে যে পুত্র চলে যায় তার জন্য জন্মধাত্রী তার কাছে কোনো চাওয়া পাওয়া করেন না। মানে হলো, জন্মধাত্রী মা তাঁর সন্তানকে বুকের কাছে রেখেই বড় করেন। কিন্তু যখন বড় হতে থাকে এক সময় বিয়ে করান তখন আর মায়ের সাথে থাকতে চায় না। পৃথক হয়ে যায় ঘরে আরেকটি বেড়া উঠে যায়।

আবার অনেকে এই প্রবাদটিকে অন্য অর্থেও বিশ্লেষন করেন। ধর্মপাশা থানা পরবর্তীতে উপজেলায় রূপান্তর হওয়ার জন্য অবকাঠামো ভাবে অনেক উন্নতি সাধিত হয়। এই অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কনস্টেকশান কাজ গুলো করতে বিভিন্ন জেলা থেকে ইঞ্জিনিয়ার কাজের শ্রমিক ধর্মপাশার এসেছে। তারা আর ফিরে যায় নি বরং ধর্মপাশার বুকে থেকে গিয়েছে ঘরজামাই হয়ে। যার কারণে এই প্রবাদটি নানান জনে নানান ভাবে ব্যখ্যা দিয়ে থাকেন।

এখন আসা যাক ‘ধরমপাশা’ আর ‘ধর্মপাশা’ একই শব্দ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পঠিত হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে। যদি আমরা সরোজমিনে ধর্মপাশার মানুষের কাছে যাই তাদের মুখে ধর্মপাশা শব্দটি উচ্চারণে ধ পরে ম এর উপর রেফ ব্যবহার করে ধর্ম ব্যবহার করে ধর্মপাশা উচ্চারণ করছেন নিহাত শিক্ষিত শ্রেনী পেশার মানুষ।আর অন্য দিকে ধ এর পরে র এর ব্যবহার করে উচ্চারণ করছেন ধর্মপাশার সর্বস্তরের জনসাধারণ।

যদি আরো দেখি, ধর্মপাশা নামে কিন্তু একটি গ্রাম আছে। এই গ্রামের নামেই থানা উপজেলার নামকরণ হয়েছে। কংস ব্রীজ পেরিয়ে ধর্মপাশা গ্রামে যেতে হাতের বাঁ পাশে ধর্মপাশা মডেল থানা এখানে ধর্মপাশা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ঠিক থানার বিপরীত পাশে ধরমপাশা উপজেলা পোস্ট অফিস এখানে ধর্মপাশা শব্দটি ধরমপাশা করে লিখা আছে। দুটি সরকারী প্রতিষ্টানের ধর্মপাশা লেখার ভিন্নতা। জাতীয় গণমাধ্যম দৈনিক প্রথম আলো ব্যতিত আর কোনো পত্রিকায় ধরমপাশা লিখে না। প্রথম আলোই ধরমপাশা লিখে পুরোনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যটুকু এখনো ধরে রেখেছে আপামোর জনসাধারণের মতো। তবে ধরমপাশার চেয়ে ধর্মপাশা শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত লেখ্যরূপে, লোকের মুখে মুখে এখানো সেই ধরমপাশা শব্দই রয়ে গেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে