দেবাদিদেব শিব এবং লিঙ্গপূজাঃ একটি শাস্ত্রীয় পর্যালোচনা

0
394

দেবাদিদেব শিব এবং লিঙ্গপূজাঃ একটি শাস্ত্রীয় পর্যালোচনা

হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রমতে দেবতা শিব হলেন দেবাদিদেব।অর্থাৎ শিব আদি দেবতা,দেবতাদের শ্রেষ্ঠ।অনেক জায়গা শিবকে ভগবান বলেও উল্যেখ করেছেন।দেবতা শিবের পূজাকে অনেকে লিঙ্গপূজা বলে অভিহিত করেন।আসুন দেখে নেয়া যাক কে এই শিব,কেনই বা তার পূজা লিঙ্গ পূজা হিসেবে অভিহিত হবে বা লিঙ্গ পূজাটা আসলে কি?

সনাতন বা হিন্দু শাস্ত্রমতে শিব শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ” কল্যাণকারী ” বা ” মঙ্গল। ” ভগবান শিবের পাঁচটি মুখ রয়েছে , এই পাঁচ মুখ দিয়ে তিনি জগতের মঙ্গল করে থাকেন , তাই তিনি কল্যাণকারী বা শিব নামে পরিচিত । পাঁচ মুখ যথাক্রমে বামদেব , কালাগ্নি , দক্ষিনেশ্বর , ঈশান এবং কল্যাণ সুন্দরম্ । আবার কোথাও একে ঈশান , তৎপুরুষ , অঘোর , বামদেব এবং সদ্যোজাত নামেও উল্লেখিত হয়েছে । শিবের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ” চিত্তিশক্তি ” যা সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত । শিবের তৃতীয় অর্থ ” সদাশিব ” । ব্রহ্মের সাকার এবং সগুণ রুপকে বলা হয় সদাশিব । তিনি আনুমানিক সাত হাজার বছর পূর্বে অবতারিত হয়েছেন । পরব্রহ্মের নানা শক্তির নানা অভিব্যাক্তিকে বলা হয়েছে দেবতা কিন্তু শিব এইসব দেবতাদেরও দেবতা । তাই তার এক নাম ” মহাদেব “। যাকে পরব্রহ্ম বলা হয়েছে যিনি নিরাকার এবং নির্গুণ তিনিই ‘ শিব ‘ নামে বিখ্যাত । যা সৃষ্টির মূলতত্ত্ব তাই শিবতত্ত্ব । বিভিন্ন শাস্ত্রে একমাত্র শিবকেই ‘ ঈশ্বর ‘ রূপে মানা হয়েছে । ভগবান শিবই এই সম্পূর্ণ সৃষ্টির অনাদি দেব । যার মহিমা বেদ , পুরাণ , দর্শন , যোগ , তন্ত্র ইত্যাদি সাহিত্যে সর্বত্র বর্ণিত হয়েছে । ভারতের জন মানস যতটুকু বৈষ্ণব ধর্মে প্রভাবিত তার থেকে অনেক বেশি প্রভাবিত শৈবধর্মে । ভগবান শিব যোগী , ভক্ত , তান্ত্রিক , বেদান্তি , কর্মকাণ্ডী , উপাসক এবং দার্শনিক সকলের কাছে পূজনীয় । তিনিই জ্ঞান , কর্ম এবং ভক্তির আদি দেবতা । তিনিই পরমপুরুষ পরমব্রহ্ম । শিব এবং শক্তি মিলেই ব্রহ্ম তাই শিবকে ‘ অর্দ্ধনারীশ্বর ‘ বলা হয় । তার দক্ষিণ অঙ্গ শিব স্বরূপ এবং বাম অঙ্গ শক্তিরূপ । মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর শিবের স্তুতি করেছেন । মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ( 15/11 ) লিখিত হয়েছে — শিবের সমান দেব নেই , শিবের সমান গতি নেই , শিবের সমান দাতা নেই , শিবের সমান বীর নেই । বিশ্ব মুক্তকোষহতে জানা যায় ভগবান শিব সৃষ্টির প্রাক্ষালে শ্রীবিষ্ণু বলেন-

“অহং ভবানয়ঞ্চৈব রুদ্রোহয়ং যো ভবিষ্যতি।
একং রূপং ন ভেদোহস্তি ভেদে চ বন্ধনং ভবেৎ।।
তথাপীহ মদীয়ং শিবরূপং সনাতনম্।
মূলভূতং সদা প্রোক্তং সত্যং জ্ঞানমনন্তকম্।।”(-জ্ঞানসংহিতা)।

অর্থাৎ আমি, তুমি, এই ব্রহ্মা এবং রুদ্র নামে যিনি উৎপন্ন হবেন, এই সকলই এক। এদের মধ্যে কোনো ভেদ নাই, ভেদ থাকলে বন্ধন হত। তথাপি আমার শিবরূপ সনাতন এবং সকলের মূল স্বরূপ বলে কথিত হয়, যা সত্য জ্ঞান ও অনন্ত স্বরূপ।

এজন্য ভগবান বিষ্ণু এবং তার বিভিন্ন অবতারগণ সর্বদা শিব উপাসনাই করতেন। তাই শ্রীকৃষ্ণেরও আরাধ্য ছিলেন পরমেশ্বর শিব। ভগবান শিবের বরেই বিষ্ণু বা কৃষ্ণের ভগবত্বা। তাই হিন্দুধর্মের মূল স্তম্ভ ত্রিশক্তির (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব) মধ্যে শিবই প্রধান । তিনি সমসাময়িক হিন্দুধর্মের তিনটি সর্বাধিক প্রাচীন সম্প্রদায়ের অন্যতম শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতা।এছাড়া শিব স্মার্ত সম্প্রদায়ে পূজিত ঈশ্বরের পাঁচটি প্রধান রূপের (গণেশ, শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও দুর্গা) একটি রূপ।তার বিশেষ রুদ্ররূপ ধ্বংস, সংহার ও প্রলয়ের দেবতা।

সর্বোচ্চ স্তরে শিবকে সর্বোৎকর্ষ, অপরিবর্তনশীল পরম ব্রহ্ম মনে করা হয়।ব্রহ্ম স্বরূপে পরমাত্মা শিব বিন্দুর ন্যায় অর্থাৎ নিরাকার,এই অবস্থায় শিবকে কল্পনাও করা যায়না,তিনি কালচক্র ও সংসারের সকল গুণ-অগুণ এর উর্দ্ধে। শিবের অনেকগুলি সদাশয় ও ভয়ঙ্কর মূর্তিও আছে।সদাশয় রূপে তিনি একজন সর্বজ্ঞ যোগী। তিনি কৈলাস পর্বতে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেন। আবার গৃহস্থ রূপে তিনি পার্বতীর স্বামী। তার দুই পুত্র বর্তমান। এঁরা হলেন গণেশ ও কার্তিক। ভয়ঙ্কর রূপে তাকে প্রায়শই দৈত্যবিনাশী বলে বর্ণনা করা হয়। শিবকে যোগ, ধ্যান ও শিল্পকলার দেবতাও মনে করা হয়। এছাড়াও তিনি চিকিৎসা বিদ্যা ও কৃষিবিদ্যারও আবিষ্কারক।

শিবমূর্তির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল তার তৃতীয় নয়ন, গলায় বাসুকী নাগ, জটায় অর্ধচন্দ্র, জটার উপর থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, অস্ত্র ত্রিশূল ও বাদ্য ডমরু। শিবকে সাধারণত ‘শিবলিঙ্গ’ নামক বিমূর্ত প্রতীকে পূজা করা হয়। সমগ্র হিন্দু সমাজে শিবপূজা প্রচলিত আছে। ভারত, বাংলাদেশ , নেপাল, শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রে ও পাকিস্তানের কিছু অংশে শিবপূজার ব্যাপক প্রচলন লক্ষিত হয়। সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্রসমূহে শিব পূজা কে সর্বশ্রেষ্ঠও সর্বাধিক ফলপ্রদ বলে বর্ণনা করা হয়।

শিবলিঙ্গ কী ?

শিবলিঙ্গ নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা ধারণা আছে যে এইটি ভগবান শিবের জননাঙ্গ কিন্তু ‘শিব লিঙ্গ’ আসলে কি?

লিঙ্গ শব্দের অর্থ সংস্কৃতে ‘চিহ্ন বা প্রতীক’। ব্যাকরণ বইয়ে নিশ্চয় সবাই লিঙ্গ বিষয়টা পড়েছ যা স্ত্রী বা পুরুষ বুঝায়। কিন্তু তোমরা লিঙ্গ দিয়ে যে জননাঙ্গ বুঝাও তা যদি বলি তাহলে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দটা কোথা থেকে আসলো? তাহলে কি স্ত্রীরও কি লিঙ্গ আছে?“না, নেই।” তাই না? তাহলে বাংলা বা হিন্দিতে যে ব্যাকরণগুলো লেখা হয়েছে তাতে লিঙ্গ শব্দটা কেন এই বিষয়ে প্রয়োগ হয়েছে?ব্যবহার হওয়ার কারণ এই যে, এগুলো এখন পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের উপর নির্ভরশীল। সংস্কৃতে প্রত্যেক শব্দ সুগঠিত। এতে প্রত্যেক শব্দের মূল শব্দ বা ধাতু, প্রত্যয় এবং বিভক্তিআদিতে ভাগ করা যায়। এতে লিঙ্গ শব্দ বলতে বুঝানো হয়েছে সেই সব চিহ্নকে অর্থাৎ প্রত্যয়কে বা প্রত্যয়যুক্ত শব্দকে যা স্ত্রী বা পুরুষ চিহ্নিত করে।এই থেকে তো এইটুকু প্রমাণিত হলো যে লিঙ্গ শব্দটা কোন জননাঙ্গকে বুঝায় না।তাহলে লিঙ্গটা কি? কেনই বা এর পূজা করা হয়?

হিন্দুদের ইতিহাস লেখা এমন অনেকগুলো বই আছে যেগুলো ‘পুরাণ’ নামে প্রসিদ্ধ। তার মধ্যে ১৮টি পুরাণ অতি প্রাচীন। ওই অষ্টাদশ মহাপুরাণের মধ্যে অন্যতম ‘লিঙ্গপুরাণ’, যাতে লেখা আছে লিঙ্গের রহস্য ও এর তথ্যাবলি।ওই পুরাণের তৃতীয় অধ্যায়ের একেবারে প্রথমেই এই লিঙ্গের বর্ণনা আছে এইভাবে-“জ্ঞানীগণ নির্গুণ ব্রহ্মকেই লিঙ্গ বলে। মহাদেব সেই নির্গুণ ব্রহ্ম, তার থেকেই অব্যক্ত আবির্ভূত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ লিঙ্গ প্রধান ও প্রকৃতি নামে প্রসিদ্ধ। রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শব্দ বর্জিত পরমেশ্বর শিবই অলিঙ্গ(চিহ্নহীন)। আবার তিনি নিজেই পঞ্চভূত(জল-তরলের প্রতীক, বায়ু-বায়বীয় পদার্থের প্রতীক, পৃথিবী-কঠিন পদার্থের প্রতীক,অগ্নি-শক্তির প্রতীক, আকাশ- অন্তরীক্ষ, শূন্য ও স্থানের প্রতীক ), পঞ্চতন্মাত্র(রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ) সকল গুণ ভূষিত লিঙ্গ রূপ উৎপন্ন হয়েছেন। এবং তার থেকেই সৃষ্টির কারণ শিবস্বরূপ প্রধান দেবত্রয়(সৃষ্টিকর্তা-ব্রহ্মা, পালনকর্তা-বিষ্ণু ও সংহারকর্তা-শিব) আবির্ভূত হয়েছেন।

লেখক

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রবান্ধিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে