আত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক কিরুপ?

0
1002

প্রশ্ন: জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধ কেমন?

উত্তর: একটি লাঠিকে জলের উপরিভাগে আড়াআড়িভাবে রাখলে মনে হয় জলরাশি দু’টি অংশে ভাগ হয়ে গেছে। তেমনি অখণ্ড আত্মাও মায়া উপাধির জন্য দু’টি ব’লে মনে হয়। বাস্তবিকপক্ষে আত্মা এক অখণ্ড।
একই অখণ্ড আত্মা বদ্ধ হয়ে জীব, বন্ধন মুক্ত হ’লে শিব।
জল আর জলের বুদ্‌বুদ্‌ আলাদা নয়, একই জল। বুদ্‌বুদ্‌ জলে তৈরী হয়ে কিছুক্ষণ ভেসে থেকে আবার জলে মিশে যায়। সেইরকম জীবাত্মা আর পরমাত্মা এক ও অভিন্ন, পার্থক্য শুধু পরিমাণে। জীবাত্মা সসীম, ক্ষুদ্র, মায়াধীন, আর পরমাত্মা অসীম ও মায়াধীশ। একটি অধীন, অপরটি স্বাধীন।
পরশমণির ছোঁয়া না লাগা পর্যন্ত অল্পমূল্যের ধাতু মূল্যবান সোনায় রূপান্তরিত হয় না। সেইরকম ঈশ্বরের কৃপা লাভ না করা পর্যন্ত ‘আমিই কর্তা’, এই ভ্রান্তি হবে এবং ততদিন অবশ্যই ‘আমি এই ভাল কাজ করেছি, আমি সেই খারাপ কাজ করেছি’, এই উভয়ের পার্থক্যবোধ অবশ্যই থাকবে। এই দুয়ের ধারণা বা পার্থক্যবোধই ‘মায়া’, যা সৃষ্টিপ্রবাহকে অব্যাহত রেখেছে। তবে মানুষ সত্ত্বগুণ-প্রধান বিদ্যাময়কে আশ্রয় করলে সঠিক পথে চলে তাঁর কাছে পৌঁছতে পারে। যে তাঁকে উপলব্ধি করে, তাঁর সাক্ষাৎ পায়, সে-ই একমাত্র মায়াসমুদ্র অতিক্রম করতে পারে। সে-ই শরীরে থেকেও প্রকৃত মুক্ত হয় যে জানে যে, কর্তা অকর্তা সবই ঈশ্বর।

জীবাত্মা বা মানব-আত্মার সঙ্গে যখন পরমাত্মার বা বিশ্বচৈতন্যের মিলন ঘটে সেই অবস্থাকে কিভাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে? ঠিক বারোটার সময় যেমন ঘড়ির কাঁটা ও মিনিটের কাঁটা দু’টি এক হয়ে যায়, তেমনি জীবাত্মা পরমাত্মায় মিশে এক হয়ে যায়।
ঈশ্বর সকল মানুষের ভিতরেই আছেন, কিন্তু সকল মানুষই ঈশ্বরের মধ্যে বাস করে না আর সেজন্যই তাদের যন্ত্রণাভোগ হয়।
ঈশ্বর ও মানুষের সম্পর্ক
চুম্বকের সঙ্গে লোহার যে সম্পর্ক, ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষেরও সেই সম্পর্ক। তাহ’লে ঈশ্বরের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয় না কেন? তার কারণ হ’ল লোহাতে মাটি লেগে থাকলে তা যেমন চুম্বকের টানে নড়ে না, সেইরকম মায়ার ঘোরে বদ্ধ মানুষ ঈশ্বরের টান অনুভব করতে পারে না। কিন্তু লোহার মাটি-কাদা জলে ধুয়ে গেলে সে যেমন নড়তে পারে তেমনি মানুষও প্রার্থনা ও অনুতাপের নিরবচ্ছিন্ন অশ্রুজলে পৃথিবীতে বদ্ধকারী মায়ার মলিনতা যখন ধুয়ে ফেলে তখন সে ঈশ্বরের দিকে আকৃষ্ট হয়।
জাহাজে চুম্বক-ঘড়ির কাঁটা সর্বদাই উত্তরমুখী হয়ে থাকে, তাই সমুদ্রে তার দিক্‌ভ্রম হয় না। সেইরকম মানুষের হৃদয় যতক্ষণ ঈশ্বরমুখী হয়ে থাকে ততক্ষণ তার সংসার-সমুদ্রে হারিয়ে যাবার ভয় থাকে না।
সমুদ্রে জলের তলায় কোন কোন জায়গায় চুম্বক-পাথরের পাহাড় লুকিয়ে থাকে, তার ওপর দিয়ে জাহাজ গেলে চুম্বক লোহার পেরেকগুলি উপড়ে নিয়ে পাটাতনগুলি বিচ্ছিন্ন ক’রে দেয়, জাহাজ তখন জলমগ্ন হয়। তেমনি ঈশ্বরানুভূতিরূপ চুম্বকের টানে মানবাত্মার পার্থিব সত্তা ও স্বার্থপরতা মুহূর্তে দূর হয়ে মানুষকে অনন্ত ঈশ্বরীয় প্রেমের সাগরে মগ্ন করে।
তেল ছাড়া যেমন প্রদীপ জ্বলে না তেমনি ঈশ্বর ব্যতীত মানুষ বাঁচতে
পারে না।
ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা
সত্যসত্যই তোমাদের বলছি, ঈশ্বরের জন্য যে ব্যাকুল হয় সে তাঁর
দেখা পায়। যার ব্যাকুলতা ও নিষ্ঠা সবচেয়ে বেশী সে সবথেকে তাড়াতাড়ি দর্শন পাবে। সোনার সন্ধানী কৃপণের মতো তোমাদের চিত্তও ঈশ্বরের
জন্য ব্যাকুল হোক।
স্বামী অভেদানন্দের ‘শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক বাণী’ থেকে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে