মূর্তি পূজা এবং শ্রীমদ্ভাগবত গীতাঃ একটি মৌলিক পর্যালোচনা

0
198

মূর্তি পূজা এবং শ্রীমদ্ভাগবত গীতাঃ একটি মৌলিক পর্যালোচনা

সুপ্রাচীন কাল থেকেই সনাতন ধর্মে দেবতা পূজা তথা মূর্তিপূজা প্রচলন রয়েছে যা এখনো চলমান।বলা চলে সনাতন হিন্দু ধর্মের অস্থিত্বের একটি প্রমাণ হচ্ছে দেব/দেবী পূজা।আমার আজকের আলোচনাটি দেব/দেবী পূজার বিরোদ্ধাচারণ নয় বরং আমরা বিভিন্ন সময় ভগবান আর দেবতাকে একত্রে গুলিয়ে ফেলি সেই জায়গাটি পরিস্কার করার জন্যই আমার আজকের আলোচনা।

একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়েই শুরু করা যাক।গত কিছুদিন আগে আমি একটি সেলুনে চুল কাটতে যাই।সেলুনের মালিক হিন্দু হওয়ায় সেলুনটিতে উনার পছন্দের দেব/দেবীর ছবি রেখেছেন।আমি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর নিশ্চিত হলাম ওখানে নানা দেবতার ছবি থাকলেও অজ্ঞাত কারণে শ্রীকৃষ্ণের কোন ছবি সেখানে নেই।একটু অযাচিত ভাবেই আমি জিজ্ঞেস করলাম দাদা,এখানে এত দেবতার ছবি অথচ শ্রীকৃষ্ণের কোন ছবি নেই কেন? তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন তিনি শিব ভক্ত! অর্থাৎ উনার কাছে শিবই ভগবান,শিবই সব! আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না।

এই হচ্ছে বর্তমান সনাতন হিন্দু সমাজ।আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন সনাতন হিন্দু সমাজ যে আজ গুরুবাদ,দেবতাবাদ সহ বিভিন্ন মতে পথে বিভক্ত তার প্রমাণ সনাতনীদের দিন দিন অধঃপতন।অথচ শাস্ত্রে বলা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।চলুন কিছু শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি দেখে আসি।

শাস্ত্র অনুসারে দেবতারা জীবতত্ত্ব। যে কোন জীব ভগবান থেকে বিশেষ শক্তি প্রাপ্ত হয়ে দেবতাদের আসন গ্রহণ করতে পারেন।কিন্তু ভগবান জীবতত্ত্ব নন, তিনি হচ্ছেন বিষ্ণু তত্ত্ব। দেবতাদের আধিপত্য এই জড়জগতে সীমাবদ্ধ, কিন্তু ভগবানের আধিপত্য বা ঐশ্বরত্বের প্রভাব জড় ও চিন্ময় জগত সর্বত্র ব্যাপ্ত। দেবতারা মানুষকে একমাত্র ভৌতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করতে পারেন, কিন্তু মুক্তি দিতে পারেন না। ভগবান জীবকে মুক্তি প্রদান করতে পারেন। দেবতারা মায়াধীন, কিন্তু ভগবান হচ্ছেন মায়াধীশ। সৃষ্টি ও প্রলয়কালে দেবতাদেরও প্রভাবিত হতে হয়, কিন্তু ভগবান নিত্য বর্তমান এবং তার ধামও নিত্য বর্তমান। এইভাবে ইন্দ্রলোক, চন্দ্রলোক প্রলয়ের সময়ে সব ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। কিন্তু ভগবানের ধাম- বৈকুণ্ঠ, অযোধ্যা, গোলক বৃন্দাবন ইত্যাদি ধ্বংস প্রাপ্ত হবে না। ইন্দ্র, চন্দ্র প্রভৃতি দেবতাগণ প্রকৃতির তিনটি গুণ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, রাম, নারায়ণ প্রভৃতি গুণাতীত। তাদের কার্যকলাপ প্রকৃতির তিনটি গুণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে-

যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৃন্ যান্তি পিতৃব্রতাঃ।
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্যাজিনোহপি মাম্।।
(ভঃগী ৯/২৫)

দেবতাদের উপাসনা করলে দেবলোক যাবে, পিতৃপুরুষদের উপাসনা করলে পিতৃলোক যাবে, ভূত-প্রেতের পূজা করলে ভূতলোক যাবে। কৃষ্ণের উপাসনা করলে কৃষ্ণের ধামে যাবে।

মূর্তি বা দেবতা পূজা সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীগীতার সপ্তম অধ্যায় ২০-২৩ নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে বলেছেনকা

মৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।
(গীতা- ৭/২০)

অনুবাদঃ জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয়।
তাৎপর্যঃ এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে— জড়-জাগতিক মোহে আচ্ছন্ন ব্যক্তিরাই অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা অন্য কারো শরণাগত না হয়ে শুধু পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই শরণাগত হন।।

যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধ্যাম্যহম্।।
(গীতা- ৭/২১)

অনুবাদঃ যে যে স্বকামীভক্ত যে যে দেবতাকে শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করে, আমি তাদের শ্রদ্ধা সেই সেই দেবতার প্রতি স্থির করি।
তাৎপর্যঃ এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন— যে যে ভক্ত যে দেবতাকে শ্রদ্ধাপূর্বক পূজা করে, ভগবান স্বয়ং সেই ভক্তের ভক্তি সেই দেবতার প্রতি স্থির করেন। কারণ ভগবান সব ভক্তকেই স্বাধীনতা দিয়েছেন। ভক্তের অধিকার আছে যে সে কোন দেবতাকে পূজা করবে।
কিন্তু ভগবান এটিও বলেছেন– ভক্ত ইচ্ছামতো যেকোনো দেবতাকে আরাধনা করতে পারে কিন্তু সেই আরাধনা তারাই করে যারা “অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন”।

তবে ভগবান গীতায় এটিও বলেছেন— যে যে ভক্ত তাকে যেভাবে পুজা করে ভগবান সেভাবেই তার পূজা গ্রহন করেন।ভগবান ভক্তকে যেকোনো দেব-দেবীর পূজা করার অধিকার দিয়েছেন।তা নিচের শ্লোকটি পড়লেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে।

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান্ হি
তান্।। (গীতা- ৭/২২)

অনুবাদঃ সেই ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেব-বিগ্রহের পূজায় তৎপর হন এবং সেই দেবতার মাধ্যমে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তু অবশ্যই লাভ করেন।
তাৎপর্য : এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন— ভক্ত যে দেবতারই পূজা করুক না কেন ভক্ত দেবতার নিকট যে “বর” বা “বস্তু” পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই সেই ভক্তের আরাধ্য দেবতার মাধ্যমে ভক্তের ইচ্ছা পূরণ করেন।কারণ পরমেশ্বর ভগবানের অনুমোদন ছাড়া কোনো দেব-দেবীই কাউকে কিছু দিতে পারেন না।দেব-দেবীরা আমাদের বরদান ও আশির্বাদ দিতে পারেন। কিন্তু “মোক্ষ” দিতে পারেন না।
একমাত্র ঈশ্বরই আমাদের “মোক্ষ” দান করতে পারেন।।
চলুন শ্রীগীতার আরো একটি শ্লোক দেখে আসি-

অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তিমামপি।। (গীতা- ৭/২৩)

অনুবাদঃ অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের আরাধনার ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার পরম ধাম প্রাপ্ত হন।
তাৎপর্য : এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বোঝাতে চেয়েছেন অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা যে অন্য দেবতাদের আরাধনা করে সেই দেবতাদের থেকে প্রাপ্ত ফল বা প্রাপ্ত বস্তু অস্থায়ী।

বিষয়টা আরেকটু বিশ্লেষণ করলে বলা যেতে পারে যারা অন্য দেব-দেবীর আরাধনা করে তারা মৃত্যুর পর “দেবলোক” প্রাপ্ত হন। কিন্তু ভগবানের ভক্তরা মৃত্যুর পর “গোলোক” প্রাপ্ত হন। যেমন: যারা শনির উপাসনা করে তারা “শনিলোক” প্রাপ্ত হন। যারা সূর্য উপাসনা করে তারা “সূর্যলোক” প্রাপ্ত হন। যারা শিব উপাসনা করে তারা “শিবলোক” বা “কৈলাস” প্রাপ্ত হন। কিন্তু এগুলো সবই অস্থায়ী। পরে তাকে আবার পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে। আর যদি কেউ একবার “গোলোক” প্রাপ্ত হয় তবে তার আর কখনো পৃথিবীতে জন্ম নিতে হয় না।

এছাড়াও নবম অধ্যায় শ্লোক ২৩ নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরো বলেন

যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্।। (গীতা- ৯/২৩)

অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! যারা অন্য দেবতাদের ভক্ত এবং শ্রদ্ধা সহকারে তাদের পূজা করে, প্রকৃতপক্ষে তারা অবিধি পূর্বক আমারই পূজা করে।

তাৎপর্য : এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বোঝাতে চেয়েছেন যারা অন্য দেবতাদের শ্রদ্ধা সহকারে পূজা করে তারা আসলে শ্রীকৃষ্ণেরই পূজা করে। কিন্তু তা বিধিসম্মত নয়। তাই ভগবান পূর্বের শ্লোকগুলোতে বলেছেন যে ভক্ত অন্য দেবতার পূজা করে সে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি।

উপরোক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হয় যে,দেবতা পূজা তথা মূর্তিপূজা সনাতন ধর্মে স্বীকৃত হলেও শাস্ত্রে তা অল্পবুদ্ধি সম্পন্ন লোকেদের কাজ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।কাজেই পূজা করতে আমাদের বাঁধা নেই তবে আমরা যেনো পূজায় মত্ত হয়ে কখনো ভগবানকে হেয় না করি,বিভিন্ন বাবা, মা’র ভক্ত হয়ে,নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে পরম পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে না যাই।

লেখক

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃ শ্রীমদ্ভাগবদ গীতা,বিভিন্ন পত্রপত্রিকা,বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা, বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় টাইম লাইন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে