সুনামগঞ্জ জেলা। District of Sunamganj

0
317

সুনামগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে সুনামগঞ্জ বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক তথ্যাবলি থেকে অনুমান করা হয় যে, সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র অঞ্চল প্রাচীন কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। জনৈক মোঘল সিপাহি সুনামুদ্দির নামে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সুনামগঞ্জকে মহকুমায় এবং ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে জেলায় উন্নীত করা হয়।
নামকরণ

সুনামদি’ নামক জনৈক মোগল সিপাহীর নামানুসারে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ‘সুনামদি’ (সুনাম উদ্দিনের আঞ্চলিক রূপ) নামক উক্ত মোগল সৈন্যের কোন এক যুদ্ধে বীরোচিত কৃতিত্বের জন্য সম্রাট কর্তৃক সুনামদিকে এখানে কিছু ভূমি পুরস্কার হিসাবে দান করা হয়। তার দানস্বরূপ প্রাপ্ত ভূমিতে তারই নামে সুনামগঞ্জ বাজারটি স্থাপিত হয়েছিল। এভাবে সুনামগঞ্জ নামের ও স্থানের উৎপত্তি হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে।

ইতিহাস

প্রাচীনকাল থেকে বহু ভাষাভাষী জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছে সার্বভৌম বাংলাদেশের বর্তমান সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ অঞ্চল । পৌরাণিক যুগে প্রাচীন কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সুনামগঞ্জ । সুনামগঞ্জের লাউড় পর্বতে কামরূপ রাজ্যের উপরাজধানী স্থাপন করেছিলেন রাজা ভগদত্ত । রাজা ভগদত্তের শাসনামলে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলাসহ বাংলাদেশের ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলার মধ্যবর্তী অঞ্চল লাউড় রাজ্যের অধীন শাসিত হত । লাউড়ের গড়ের ভগ্নাবশেষ আজও অত্র অঞ্চলে বিদ্যমান, যা রাজা ভগদত্তের বাড়ি বলে জনশ্রুতিতে ব্যক্ত ।লাউড় রাজ্যের চতুসীমা ছিল পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ, পূর্বে জৈন্তিয়া, উত্তরে কামরূপ সীমান্ত ও দক্ষিণে বর্তমানে ব্রাম্মণবাড়িয়া পর্যন্ত। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই লাউড় রাজ্যের প্রাচীন নিদর্শন হাওলি প্রকৃতপক্ষে ছিল রাজবাড়ী। এ রাজ্যে স্থপতি রাজা ভগদত্তের ১৯ জন বংশধর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য স্থাপন করে। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচীন লাউড় রাজ্য কামরূপ রাজ্য থেকে আলাদা হয়। দশম শতক থেকে স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন শুরু হয় । মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের পক্ষে লড়তে গিয়ে নিহত হন রাজা ভগদত্ত। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা বিজয় মাণিক্য লাউড় রাজ্য শাসন করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে তিনি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরেও রাজ্য স্থাপন করেন। এ সময় বঙ্গের ব্রাহ্মণরা বল্লাল সেনের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্যে এসে আশ্রয় নেন। বিজয় মাণিক্যের পর কারা লাউড় শাসন করে তা এখনো অজানা। তেরশত শতাব্দীর পর চৌদ্দ’শ সালের প্রথমার্ধে কাত্যায়ন গোত্রিয় দিব্য সিংহ নামে নৃপতি লাউড়ে রাজত্ব করেন। তখন লাউড়ের রাজধানী নবগ্রামে স্থানান্তর হ্য়। এ সময় লাউড় এবং জগন্নাথপুর রাজ্য অনেক জ্ঞানী পুরুষের আবির্ভাবে প্রফুল্লিত হয়েছিল। রাজ্যের রাজমন্ত্রী কুবেরাচার্য ছিলেন একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি। যার জ্ঞানের চর্চা ভারতবর্ষের অন্যতম বিদ্যাপীঠ নবদ্বীপ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ছিল। এছাড়া উক্ত রাজ্যের নবগ্রামে মাধবেন্দ্রপুরী নামে আরেক জন জ্ঞানী সাধু পুরুষ বসবাস করতেন। এই মাদেবন্দ্রপুরির কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে লাউড়ের যুবরাজ রমানাথ বা রামা ও মন্ত্রীতনয় অদ্বৈত্যেচার্য সারা ভারতবর্ষে স্মরণীয় হয়ে আছেন। রমানাথ সিংহ উপযুক্ত হলে রাজা দিব্য সিংহ রাজ্যভার তার পুত্র রমানাথকে দিয়ে, শান্তি সাধনায় তিনি তার মন্ত্রীতনয় অদ্বৈত্যের আখড়া শান্তিপুরে চলে যান। সেখানে থেকে অদ্বৈত্যের উপদেশে বৈষ্ণবীধর্ম গ্রহণ করেন এবং সাহিত্য চর্চায় মনোযুগী হয়ে বাংলা ভাষায় বিঞ্চুভক্তি শাস্ত্র গ্রন্থ সহ আরও কয়েকটি গ্রন্থের অনুবাদ করেন। অতপর অদ্বৈত্য বাল্যলিলা গ্রন্থ রচনা করে কৃষ্ণদাস নামে আখ্যাত হন। রাজা দিব্য সিংহের পুত্র রামানাথ সিংহের তিন পুত্র ছিল। এই তিন পুত্রের মধ্যে একজন কাশীবাসি হন এবং এক পুত্রকে লাউড়ের রাজ সিংহাসনে বসিয়ে; রামানাথ সিংহ তার অন্য পুত্র কেশবের সাথে জগন্নাথপুরে আসেন। প্রাচীন ইতিহাসে লাউড় রাজ্য সব সময় স্বাধীন ছিল বলে জানা যায়। সৈয়দ মূর্তজা আলী তার রচিত ‘হযরত শাহ্জালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তার জ্ঞাতিভাই জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এর জের ধরেই বিজয় সিংহ গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। প্রায় পনেরো’শ শতকে হবিগঞ্জ জেলার ভাটি অঞ্চলে বানিয়াচং রাজ্য স্থাপিত হয়। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কেশব একজন বণিক ছিলেন। তিনি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিলেন এবং কালী নামের দেবির পূজা নির্বাহের লক্ষ্যে দৈব বাণীতে শুকনো ভূমির সন্ধান প্রাপ্ত হয়ে সেখানে অবতরণ করে দেবি পূজা সমাধান করে দৈব বাণী মতে সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। এক সময় শ্রীহট্টের উত্তর সীমা হতে ভেড়ামোহনা নদী পর্যন্ত বানিয়াচং রাজ্য বিস্তৃত ছিল। প্রায় শতের’শ শতকের শেষের দিকে গোবিন্দ খাঁ কর্তৃক শ্রীহট্ট ভূমির প্রাচীন রাজ্য “লাউড়” ইহার অধিকার ভূক্ত হয়। যাহা মূলত তৎকালে জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজ্ বংশের অধিকারে আসার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজ্ বংশ তাদের অধিকার হারায় এবং ইহার জের ধরে দুই রাজ্যের মধ্যে হতা-হতীর কারণ জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজ্ বংশ ধংশ হয়। ঐ সময়ে বানিয়াচং রাজা গোবিন্দ খাঁ দিল্লীর সম্রাটদের দ্বারা মুসলমান হয়ে, হাবিব খাঁ নাম ধারণ করে দেশে ফিরেন। শতরে’শ শতকের পরে লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মোঘলরা এর নিয়ন্ত্রক হন । যার ভিত্তিতে সুনাম উদ্দিন নামে জনৈক মোঘল সিপাহী এ অঞ্চলে একটি গঞ্জ বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। পরে উপজেলা, মহকুমা ও জেলা শহরে রুপান্তরিত হয়। বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার নাম ছিল বনগাঁও। ১৮৭৭ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠত হয়। ১৯৮৪ সালে জেলায় রুপান্তরিত হয়। জেলায় মোট ৮১টি ইউনিয়ন এবং ২৭৭৩টি গ্রাম আছে। জেলার প্রথম হাইস্কুল সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৭ সাল সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায়, দ্বিতীয় হাইস্কুল দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৫ সালে দিরাই উপজেলায়, তৃতীয় হাইস্কুল ব্রজন্নাথ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৯ সালে জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁওয়ে। ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ।

দর্শনীয় স্থান
টাঙ্গুয়ার হাওর,শনির হাওর,যাদুকাটা নদী,শিমুল বাগান,বারিকের টিলা,নীলাদ্রী লেক(শহিদ সিরাজ লেক),পণাতীর্থ,শ্রী অদৈত্য আচার্য মন্ডপ,শাহ আরফিন মাজার ইত্যাদি।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে