শিল্পকলার দেবতা বিশ্বকর্মা, বিশ্বভ্রম্মান্ডের নিপুণ কারিগর

0
179

শিল্পকলার দেবতা বিশ্বকর্মা, বিশ্বভ্রম্মান্ডের নিপুণ কারিগর

সনাতন শাস্ত্রতে বিশ্বভ্রমান্ডের সকল কিছুর স্রষ্টা বা কারিগর তিনি। ব্রহ্মাপুত্র বিশ্বকর্মাই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নকশা তৈরি করেন। ঈশ্বরের প্রাসাদের নির্মাতাও তিনি। দেবতাদের রথ ও অস্ত্রও তৈরি করেছিলেন এই বিশ্বকর্মাই।তিনি স্বর্গের ও কারিগর।যুধিষ্ঠিরের মায়া সভাও তৈরি করছেন তিনি,রাবনের লঙ্কা সহ পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহ নির্মাণ ও করেছিলেন বিশ্বকর্মা। মাহাভারত অনুযায়ী বিশ্বকর্মা হলের শিল্পকলার দেবতা, সকল দেবতার প্রাসাদ, সকল প্রকার অলঙ্কারের নির্মাতা। বিবরণ অনুযায়ী তাঁর চার বাহু, মাথায় রাজার মুকুট, হাতে জলের কলস, বই, দড়ির ফাঁস ও অপর হাতে একটি যন্ত্র।

বিশ্বকর্মার মাতার নাম যোগসিদ্ধা।যোগসিদ্ধা হচ্ছেন দেবগুরু বৃহস্পতির বোন। বৃহস্পতি ও শুক্র দুই ভাই। ব্রহ্মা তনয় কশ্যপ ঋষির ঔরসে অদিতির গর্ভের সন্তান বৃহস্পতি এবং কশ্যপ ঋষির ঔরসে দিতির গর্ভের সন্তান শুক্র। বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু এবং শুক্র অসুরদের গুরু। দেবতা ও অসুর কোন পৃথক জাতি নয়। মহাভারত ও পুরাণ মতে,তারা একই পিতার ঔরসজাত সন্তান। কশ্যপের অপর পত্নী দনুর গর্ভজাত সন্তান দানব।দেবতাদের সন্তান প্রসব একটি জ্যোতি মাত্র। এই জ্যোতি নাভি স্পর্শ হলেই সঙ্গে সঙ্গে সন্তান প্রসব হয়। আর তৎকালীন ব্রাহ্মণদের সন্তান হতে সময় লাগত একমাস এবং ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের সন্তান প্রসব হতে সময় লাগত ১০ মাস ১০ দিন। তবে ব্রাহ্মণদের বর্তমান সন্তান প্রসব প্রক্রিয়া ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের অনুরূপ।

ঋকবেদে উল্লেখ আছে যে,বিশ্বকর্মা সর্বদর্শী ভগবান। তাঁর চক্ষু, মুখমন্ডল, বাহু ও পদদ্বয় সর্বদিক ব্যাপিয়া রয়েছে। বাহু ও পদদ্বয়ের সাহায্যে তিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল অর্থাৎ ত্রিভুবন নির্মাণ করেছেন।বিশ্বকর্মা শিল্প সমূহে প্রকাশক,অলঙ্কারের স্রষ্টা এবং দেবতাদের বিমান ও রথ নির্মাতা। তাঁর অশেষ কৃপায় মানবজাতি শিল্প কলায় পারদর্শিতা লাভ করেছে। উপবেদ, স্থাপত্যবেদ এররচয়িতা এবং চতুঃষষ্ঠী কলার অধিষ্ঠাতা হচ্ছেন বিশ্বকর্মা।

তিনি বৈদিক প্রাসাদ, ভবন, উদ্যান প্রভৃতির নির্মাতা। বিশ্বকর্মা কেবল দেবশিল্পীই নন,দেবতার অস্ত্রাদিও প্রস্তুত করেছেন। সকল আগ্নেয়াস্ত্র তাঁরই নির্মিত।মহাভারত মতে তিনি শিল্পের শ্রেষ্ঠকর্তা, সহস্র শিল্পের আবিষ্কারক এবং সর্বপ্রকার কারুকার্য নির্মাতা।

বিশ্বকর্মা দেবতাদের পুষ্পক রথের নির্মাতা, আগ্নেয়াস্ত্রের স্রষ্টা, শ্রীবিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, লক্ষ্মীর কোষাধ্যক্ষ, কুবেরের কুবের পাস, কার্তিক বল, পঞ্চপান্ডবের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী তৈরি এবং শ্রী ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ জগন্নাথের বিগ্রহ নির্মাতা সহস্র শিল্প বিদ্যার অধিকারী বিশ্বকর্মা যবিষ্ঠ বা অগ্নিরূপে কথিত। তাঁর হস্তীবাহন মূর্তির হাতে মশালও রয়েছে হাতুড়ির সঙ্গে।

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে, যারা জগৎস্রষ্টা বিশ্বকর্মাকে সম্যকরূপে জানেন, তাঁরা মৃত্যুকে অতিক্রম করেন। অর্থাৎ তাঁদের আর মৃত্যুভয় থাকে না।

এষ দেবো বিশ্বকর্মা মহাত্মা
সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।
হৃদা মনীষা মনসাঽভিক্লৃপ্তো
য এতদ্ বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।।
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ:৪.১৭)

“পরমাত্মা এই জগৎরূপে নিজেকে প্রকাশিত করেছেন, তাই বিশ্বের স্রষ্টা বিশ্বকর্মা। তিনিই সেই মহান পুরুষ, তিনিই প্রত্যেক জীবের অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। যাঁরা এই পরমাত্মাকে জানেন তাঁরা মৃত্যুকে অতিক্রম করেন, অর্থাৎ তাঁদের আর মৃত্যুভয় থাকে না।”

বিশ্বকর্মা অসীম পরিব্যাপক, সকল কিছুর প্রতিপালক, সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক, সর্বপ্রধান, সকল কিছুর প্রত্যক্ষকারী ও জাগ্রত ৷ শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতাতেও সকল জীবজগতের স্রষ্টা ‘দক্ষিণা’ নামে অবিহিত করা হয়েছে। মন্ত্রে সকলের স্রষ্টা দক্ষিণা বিশ্বকর্মা এবং প্রজাপতি যে একই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়।দক্ষিণ শব্দের অর্থ প্রসন্ন। তাই পরমেশ্বর সদাশিবকে ‘দক্ষিণামূর্তি’ বলা হয়। যজ্ঞাগ্নির একটি অন্যতম নাম ‘দক্ষিণাগ্নি’।

অয়ং দক্ষিণা বিশ্বকর্মা।
তস্য মনো বৈশ্বকর্মণং।
গ্রীষ্মো মানসস্ত্রিষ্টুব্ গ্রৈষ্মী ত্রিষ্টুভঃ স্বারং। স্বারাদন্তর্যামোঽন্তর্যামাৎ পঞ্চদশঃ।
পঞ্চদশাদ বৃহদ। ভরদ্বাজ ঋষিঃ।
প্রজাপতিগৃহীতয়া ত্বয়া মনো গৃহ্নামি প্রজাভ্যঃ।।
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা: ১৩.৫৫)

“সকলের স্রষ্টা বিশ্বকর্মা। বায়ু, দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে, সেরূপে তোমাকে গ্রহণ করছি। বিশ্বকর্মার অপত্য মনরূপে, মনের অপত্য গ্রীষ্ম ঋতুরূপে, তা থেকে উৎপন্ন ত্রিষ্টুপ ছন্দরূপে, তা থেকে উৎপন্ন সামরূপে, তা থেকে উৎপন্ন অন্তর্যাম গ্রহরূপে, তা থেকে উৎপন্ন পঞ্চদশ স্তোমরূপে, তা থেকে উৎপন্ন বৃহৎ পৃষ্ঠরূপে, তা থেকে উৎপন্ন ভরদ্বাজ ঋষিকে মনরূপে গ্রহণ করছি । প্রজাপতির সৃষ্টি তোমাকে সকল প্রজাদের কল্যাণের জন্য মনে গ্রহণ করছি।”

অথর্ববেদ সংহিতায় ইন্দ্রের স্তোত্র করতে গিয়ে ঋষিরা ইন্দ্ররূপ পরমেশ্বরকেই ‘বিশ্বকর্মা’ এবং ‘ ‘বিশ্বদেবো’ নামে অবিহিত করেছেন। সূক্তে ইন্দ্রদেবকে রক্ষার নিমিত্ত জীবের রক্ষায় সখারূপে আহ্বান জানানো হয়েছে। ইন্দ্রদেবকে গো-ইত্যাদি অভীষ্ট ধনের প্রদাতা বলা হয়েছে। তিনি জনরক্ষক, হরিত-অশ্ববান্, সর্বনিয়ামক। তিনি সূর্যের প্রকাশক, শত্রু-তিরস্কারক, জগতের সৃষ্টা বিশ্বকর্মা। তাঁর মহিমার দ্বারা তিনি দ্যাবা-পৃথিবী জল-পর্বত-বজ্র-বল ও স্বর্গকে ধারণ করেন।

ত্বমিন্দ্রাভিভূরসি ত্বং সূর্যমরোচয়ঃ।
বিশ্বকর্মা বিশ্বদেবো মহাঁ অসি ॥৬
(অথর্ববেদ সংহিতা:২০.৫.২৫.৬)

বিশ্বকর্মাই ইন্দ্র হয়ে অসুর বিনাশ করেন, আবার তিনিই প্রজাপতি হয়ে জগত সৃষ্টি করেন।
বিশ্বকর্মা বৈদিক দেবতা, ঋগবেদের ১০ম মণ্ডলে ৮১ এবং ৮২ সূক্তদ্বয়ে বিশ্বকর্মার উল্লেখ আছে।
ঋগবেদ অনুসারে তিনি সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞ। তার চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পদ সবদিকে পরিব্যাপ্ত। তিনি বাচস্পতি, মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা ও বিধাতা অভিধায় ভূষিত। তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি।

উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সনাতন হিন্দু শাস্ত্রমতে বিশ্বকর্মা এই বিশ্বভ্রম্মান্ডের সকল কিছুর নিপুণ কারিগর,শিল্পকলার দেবতা মূলত তিনিই।প্রতিবছর ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে বিশ্বকর্মা দেবতার পূজা করে থাকেন।বিশ্বকর্মা ঠাকুর সকলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক এই কামনা করেই লেখাটি শেষ করছি।

লেখক

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে