রমা দাস।।মুক্তিযদ্ধা রমা দাস

0
183

গোয়েন্দাগিরি করে পাকিস্তানি আর্মিদের যাবতীয় তথ্য আর গতিবিধি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধা রমা দাস…..
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কাজ শুরু করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রমা দাস৷ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নয় নম্বর সেক্টরের মহিলা মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি৷ ১৯৪৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর বরিশালের গৌরনদী থানায় জন্ম রমা দাসের৷ বাবা নগেন্দ্রনাথ দাস এবং মা অঞ্জলী দাস৷ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স পড়ছিলেন রমা দাস৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই তাঁর লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়৷ ফলে প্রায় প্রতিদিনই কলাভবন, কার্জন হল, শহীদ মিনার চত্বরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চত্বরের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন তিনি৷ ফেব্রুয়ারি ও মাচের্র দিনগুলোতে তাঁরা দলবেঁধে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতেন৷ এছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও দেয়াল লিখনে অংশ নিতেন৷ যাইহোক, মাস্টার্সের লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দেশে মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলন বেগবান হলে উনার মৌখিক পরীক্ষার তারিখ পাল্টে যায়৷ ফলে রমা দাস ২১শে মার্চ নিজ বাড়ি ঝালকাঠি চলে আসেন৷ কিন্তু কিছুদিন পরই ঝালকাঠিতে হামলা চালায় পাক হানাদার বাহিনী৷ ঝালকাঠিতে প্রায় সর্বত্রই আগুন ধরিয়ে দেয় তারা, অবাধে চলে নিরীহ বাঙালীদের হত্যা, মা বোনদের ধর্ষণ আর লুটতরাজ।
বাধ্য হয়ে আশ্রয়ের জন্য কামারকাঠি গ্রামের মামার বাড়ি চলে যায় রমা দাস সহ পরিবারের সবাই। এরপর কয়েক মাস ধরে এখান থেকে ওখানে পালিয়ে বেড়াতে হয়৷ কিন্তু পাশাপাশি পেয়ারাবাগানে ক্যাপ্টেন বেগ এর নেতৃত্বে মাদ্রা প্রশিক্ষণ শিবিরে রমা দাস অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তিনি ভারত চলে যান৷ পেয়ারাবাগান থেকে বাগদা সীমান্তে পৌঁছতে তাদের সাত দিন সময় লাগে৷ ভারত গিয়ে প্রথমে টালিগঞ্জে মামার বাড়িতে উঠেন। এসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো শুনে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হোন৷ এদিকে, যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগে উনার স্বামী পার্থ সারথি দাসের সাথে বিয়ের জন্য পারিবারিকভাবে আশীর্বাদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছিল৷ এসময় রমা দাস খবর পান যে, উনার হবু স্বামী ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন বশিরহাটের হাসনাবাদের অন্তর্গত টাকি ক্যাম্পে রয়েছেন৷ রমা দাস তখন ছোট ভাইকে নিয়ে টাকি ক্যাম্পে চলে যান৷ সেখানে গিয়ে ক্যাপ্টেন বেগ এবং পরে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের সাথে দেখা করেন৷ মেজর জলিল উনাকে ঐ সেক্টরের মহিলা মুক্তিবাহিনীর প্রধান করে দিলেন৷ তখন তাদের সেই দলকে একটি দোতলা ভবনের উপরে বিশেষ জায়গা দেয়া হলো৷ সেখানে ৪০ থেকে ৪৫ জন মেয়ে নিয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেন তারা৷ সেখানে যশোর সেনানিবাসে কর্মরত সুবেদার মেজর মাজেদ এসে রমা দাসের নেতৃত্বাধীন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের দলটিকে প্রশিক্ষণ দিতেন৷ সেখানে তারা অস্ত্র চালনা এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন৷ ঐ শিবির থেকে খুলনা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, কালিগঞ্জ, ভোমরা, দেবহাটাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তান আর্মিদের গতিবিধির উপর সুকৌশলে গোয়েন্দাগিরি এবং সেই তথ্য গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল মূল কাজ। এছাড়া দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কথিকা পাঠ করতেন রমা দাস৷

এরপর দেশ স্বাধীন হলেও খুলনায় মেজর জলিলের নেতৃত্বে গঠিত শিবিরে থেকে বিভিন্ন কাজ করেছেন তিনি৷ সেখানে প্রায় দেড়মাস অবস্থান করে মুক্তিবাহিনীতে থাকা মেয়েদের আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ করে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন৷ শেষ পর্যন্ত দু’টি মেয়েকে সাথে করে ঝালকাঠিতে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান৷ এমনকি তাদের একজনের পিতামাতা কিংবা স্বজনদের খোঁজ না পাওয়ায় প্রায় এক বছর নিজ বাড়িতে রেখেছিলেন৷ পরে তাঁকে সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে কাজ শিখিয়ে আত্মনির্ভরশীল করেছেন রমা দাস৷ দেশ স্বাধীনের পর ভারতে ভাল চাকুরির প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এ যোদ্ধা। বলেছিলেন– ‘আমি আমার নিজের দেশে ফিরে যাব।’ পরবর্তীতে ঝালকাঠি গার্লস স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন দীর্ঘ ৫৮ বছর। যুদ্ধ শেষ হলে কালিঘাটে কোন উৎসব ছাড়াই মালাবদল করে মন্ত্র পড়ে অধ্যাপক পার্থ শারথি দাসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রমা দাস।
রমা দাসের মতো এরকম হাজারো মুক্তিযোদ্ধা মায়েদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে জানাই শ্রদ্ধা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে