যত মত তত পথ হলেও ভগবান একজনই

0
260

যত মত তত পথ হলেও ভগবান একজনই

সনাতন ধর্মকে বলা হয় পৃথিবীর আদি ধর্ম।এটা আমার কথা নয় গুগল চাপলেও তথ্যটির সত্যতা পেয়ে যাবেন।প্রশ্ন হলো যে ধর্মটি সবার আগে পৃথিবীতে আদিষ্ট হলো সেই ধর্মটি কেন আজ বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে।এর অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ সনাতন হিন্দু ধর্মের বহুত্ববাদ তথা “যতমত তত পথ” নীতি। এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে সনাতনীরা আজ বহুধা বিভক্ত হয়ে অন্ধের মতই হাতের কাছেই লাঠি থাকা সত্ত্বেও তা খোঁজে পাচ্ছে না কেউই।প্রিয় পাঠক চলুন আজ এ বিষয়ে একটু বিশদ জানার চেষ্টা করি।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সনাতন ধর্মীয় একজন মহান সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ যিনি কালী সাধক ছিলেন,তিনি “যত মত তত পথ” বাণীটি দিয়েছিলেন।তিনি ব্যক্তিজীবনে কালী সাধনা করলেও বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন ধর্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেছিলেন,যার দরুণ তিনি একটা সময় উপলদ্ধি করেছিলেন স্রষ্টায় বিশ্বাস ঠিক থাকলে বিভিন্ন সাধন পথেও সাফল্য লাভ করা যায়।যার ফল স্বরুপ তিনি বলেছিলেন “যত মত তত পথ”। দূঃখ জনক হলেও সত্য, যে অর্থে বাণীটি তিনি দিয়েছিলেন আমরা বুঝলাম তার উল্টো! উঁনি করতে চাইলেন সর্ব ধর্মের সমন্বয়,আর আমরা হলাম নিজ ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন মতে বিভাজিত! যার খেসারত আজ ঘরে ঘরে ভগবান তৈরী করছি।যে যার মত করে সনাতন ধর্মকে বিভাজন করছি যার ফলস্বরুপ সৃষ্টির আদি ধর্ম সনাতন আজ তলানিতে ঠেকতে যাচ্ছে,নিকট ভবিষ্যতে তার অস্থিত্ব নিয়েও হুমকী দেখা দিচ্ছে।

আমরা ধর্ম চর্চা করতে বিভিন্ন সাধক গুরু যেমন শ্রী চৈতন্য দেব, শ্রী অনুকুল ঠাকুর,শ্রী রামকৃষ্ণ,শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী,শ্রী রাম ঠাকুর সহ আরো অনেক সাধকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারি,তাদের আদর্শ গ্রহণ করতে পারি,তাদের শ্রদ্ধাভরে পূজন,ভজন করতে পারি।তাই বলে তাদেরকে কি আমরা ভগবান বলে চালিয়ে দিতে পারি? না, মোটেও না।ভগবান একজনই। তিনি হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণ।যিনি সমস্থ সনাতন শাস্ত্রের প্রাণ পুরুষ,সর্বাকর্ষক তিনিই তো ভগবান। আসুন ভগবান সম্পর্কে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সমূহ কি বলে একটু জেনে আসি-

ব্রহ্মসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকেই ব্রহ্মাজী স্বয়ং বলেছেন,

ঈশ্বরঃ পরম: কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দ সর্বকারণকারণম্,।।

অর্থাৎ সচ্চিদানন্দময় শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোবিন্দ নামে পরিচিত, তিনিই পরম ঈশ্বর, তিনিই অনাদির আদি এবং তিনিই সমস্ত কারণের পরম কারণ।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৩/২৮) বলা হয়েছে,

এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্।
ইন্দ্রারিব্যাকুলং লোকং মৃড়য়ন্তি যুগে যুগে।।

অর্থাৎ,শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান, সমস্ত অবতারগণ তাঁরই অংশ বা কলা। যুগে যুগে দৈত্য পীড়িত ভুবনকে ইনিই পরিত্রাণের দ্বারা সুখ দিয়ে থাকেন।
অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর প্রেরিত কোনো দূত বা কোনো অবতার নন বরং তিনি স্বয়ংই ঈশ্বর এবং সমস্ত অবতারগণ তাঁরই অংশ,অর্থাৎ, তিনিই সমস্ত অবতারের অবতারী। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তিনি নিজেও ঠিক তাই বলেছেন; তিনি বলেছেন (গীতা ১০/২, ১০/৮, ৯/২৪, ৭/৬-৭),

আমিই সমস্ত দেবদেবীদের উৎস, জড় ও চেতন জগতের সবকিছুর উৎস আমিই, সবকিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়, আমার উর্ধ্বে কিঞ্চিৎ বস্তুও নেই, আমিই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু। যারা আমার চিন্ময়স্বরূপ জানেনা তারা পুন:পুন সংসার সমুদ্রে অধঃপতিত হয়। আমিই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও লয়ের কারণ। হে ধনঞ্জয়, আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ পরমার্থ তত্ত্ব আর কিছু নেই।
এরপর ব্রাহ্মসংহিতায় ( ৫/৩৫) ব্রহ্মাজী আরও বলেছেন,

শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপত এক তত্ত্ব হয়েও তাঁর অচিন্তশক্তির মাধ্যমে তিনি অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তাঁর মধ্যেই বর্তমান এবং তিনি যুগপৎ সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণুতেও পূর্ণরূপে অবস্থিত। সেই অনাদিরাদি গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।

তিনি আরও বলেছেন,প্রভাবশালী এঁরই প্রভা ব্রহ্ম, কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে যাঁর ক্ষিতি, অপ, প্রভৃতি বিভূতি পরিব্যাপ্ত এবং যিনি নিষ্কল, অর্থাৎ, অখণ্ড, অনন্ত ও অশেষভূত; সেই অনাদিরাদি গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।অর্থাৎ, উপনিষদে যাঁকে নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে সেই নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই অঙ্গকান্তি। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতেও ঠিক একই কথা বলা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের দ্বাদশ অধ্যায়ের একাদশ শ্লোকে বলা হয়েছে,ইনিই হচ্ছেন সেই পরম ব্যাক্তি, যাঁকে মহান মুনিঋষিরা নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম বলে জানেন এবং সাধারণ মানুষেরা জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি বলেই মনে করেন।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১৪/২৭) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেও বলেছেন যে, তিনিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা, এমনকি উপনিষদে ঈশ্বরের যে বিরাট রূপের উল্লেখ রয়েছে, সেই বিরাট রূপের আশ্রয়ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। কারণ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুনকে তাঁর বিরাট রূপ দর্শন করিয়েছিলেন। এসব ছাড়াও, অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে (পূর্ব-১৯) বলা হয়েছে,“একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনিই আরাধ্য। তিনি এক হয়েও অনন্ত রূপ ও অবতারের মাধ্যমে প্রকাশিত হন।”

অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় সাধন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যত মত তত পথ হলেও ভগবান একজনই,আর তিনি হচ্ছেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ। কলি যুগের যুগাবতার শ্রী চৈতন্য দেব বলেছেন “একলা ঈশ্বর কৃষ্ণ,আর সব ভৃত্য”। অর্থাৎ কেবল মাত্র শ্রী কৃষ্ণই ঈশ্বর,আর সব উঁনার অনুগামী।তাই আমরা কেন নানামতে বিভ্রান্ত হবো? আজকে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উগ্র গোষ্ঠী কর্তৃক আক্রান্ত হলেও প্রতিবাদ না হওয়ার অন্যতম এক কারণ বহুত্ববাদ তথা যত মত তত পথ বাণীর অপব্যখ্যার ফসল।একের উপর অন্যের আঘাতে সনাতনী সমাজ নীরব থাকার প্রধান কারণ আমাদের নিজ নিজ গোত্রে নিজ নিজ ভগবান তথা স্রষ্টা কল্পনায় ব্যাস্ততা! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় যদিও তিনি বলেছেন ধর্মের অধঃপতনে তিনি বার বার আসবেন,কিন্তু সেই আসা যে মনুষ্য রুপ ধারণ নয় সেটা এই জাতিকে কে বুঝাবে? তিনি অধর্ম বিনাশ করার জন্য যে কারো মাধ্যমে বা কোন অলৌকিক শক্তির মাধ্যমেও তা করতে পারেন সেই বোধটুকু না রেখে এই শ্লোকটিকেও আমরা ভগবান সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছি যা খেলায় আত্মঘাতী গোল দেবারই নামান্তর।তাই প্রিয় সনাতনী সমাজকে অনুরোধ করবো প্লিজ এসব খেলা বন্ধ করুন,এবং আমার নিচের লেখাটির সাথে সহমত পোষণ করে সবাই একই ছায়তলে আসুন,প্রিয় সনাতন ধর্মকে রক্ষায় এগিয়ে আসুন এবং একই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করুন-

“একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম্।
একো দেবো দেবকীপুত্র এব।
একো মন্ত্রস্য নামানি যানি
কর্মাপ্যেকং তস্য দেবস্য সেবা।।৭।।
বর্তমান জগতে মানুষ আকুলভাবে আকাঙ্ক্ষা করছে একটি শাস্ত্রের, একক ভগবানের, একটি ধর্মের এবং একটি বৃত্তির। তাই, একং শাস্ত্রং দেবকীপুত্রগীতম্- সারা পৃথীবীর মানুষের জন্য সেই একক শাস্ত্র হোক ভগবদগীতা। একো মন্ত্রস্তস্য নামানি-একক মন্ত্র, একক প্রার্থনা, একক স্তোত্র হোক তাঁর নাম কীর্তন।”

লেখক-

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃ শ্রীমদ্ভগবদ গীতা,ব্রহ্ম সংহিতা,বিভিন্ন পত্রপত্রিকা,বিভিন্ন অনলাইন পোর্ট্ল,বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় টাইমলাইন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে