নমশুদ্র সস্প্রদায়ের আদি-অন্ত

0
550

নমশুদ্র সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

সুদূর অতীত থেকে বর্ণ হিন্দু রাজা, জমিদার, ব্রাহ্মণ ও অভিজাতগণ নমশূদ্রদের নীচুজাত, রাক্ষস, চণ্ডাল প্রভৃতি অশােভনীয় নামে আখ্যায়িত করে আসছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নমশূদ্ররা নীচুজাত নয়, বরং অভিজাত কুলীন। কবির ভাষায়,

নহে আশরাফ যার আছে শুধু বংশের পরিচয়
সেই আশরাফ জীবন যাহার পুণ্য কর্মময়।

সমাজের কিছু মানুষ আছেন যারা অভিজাত ও অনভিজাত ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে শােষণ ও অপমান করে নিজেরা আত্মপ্রসাদ লাভ করে তারাই প্রকৃত নীচুজাত। প্রাচীন গ্রন্থ শক্তি সঙ্গমের বর্ণনা অনুসারে নমশূদ্রগণ মহামুনি কাশ্যপের বংশধর।কাশ্যপ মুনির পুত্র নমস মুনির দুই পুত্র কীর্তিবান ও উরুবান ছিলেন বড়ই উদার। সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের মানবিক মূল্যবােধ জাগ্রত করে সেই সুপ্রাচীন ভারতবর্ষে যেখানে ৭০০০ এর উর্ধ্বে জাত বর্ণের অস্তিত্ব ছিল, সেখানে একটি সমাজতান্ত্রিক সাম্যর সমাজ গঠনের মানসে নমস মুনির দুই পুত্র ছিলেন আত্মনিবেদিত। কিন্তু বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থায় তাদের পক্ষে জাত নির্বিশেষে কল্যাণ করা সম্ভব ছিল না। তাই নমস মুনির পুত্রদ্বয় মনােকষ্টে পার্শবর্তী শূদ্র রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে তারা শূদ্র রাজকন্যাদের বিবাহ করে শূদ্র রাজ্যে বসবাস করতে থাকেন। নমস মুণির পুত্রদ্বয়ের ঔরসে শূদ্র রাজকন্যাদের গর্ভজাত সন্তান এবং তাদের বংশধরগণই অধুনা নমশূদ্র বলে পরিচিত। মনুসংহিতার সূত্রমতে, নমশূদ্রগণ পারশব বিপ্র। ব্রাহ্মণ নামের সাথে শূদ্র যুক্ত হয়ে নমশূদ্র নাম হয়েছে।

নমশূদ্র গণের মহিমান্বিত স্বরূপ ও উচ্চমূল্যবােধকে প্রতিহত করবার মানসে কিছু স্বার্থান্ধ ব্যক্তি নমশূদ্রদের নীচুজাত আখ্যায়িত করে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। এ ধারার ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বল্লাল সেন অন্যতম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বল্লাল সেন একজন লম্পট অত্যাচারী ও অসৎ চরিত্রের রাজা ছিলেন। যতদূর জানা যায় তাঁর সহস্রাধিক রক্ষিতা ও উপপত্নী ছিলাে। পদ্মিনী নামে এক বেশ্যা ছিলেন বল্লান সেনের উপপত্নীদিগের সর্দার। পদ্মিনী ভৌমি একাদশী ব্রতে রাজ্যের সম্রান্ত ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করেন। কিছু ব্রাহ্মণ পদ্মিনীর নিমন্ত্রণ গ্রহণে অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে বল্লাল সেন নিমন্ত্রণ গ্রহণে অনিচ্ছুক ব্রাহ্মণদের শূলে চড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেয়। সম্মান, ধর্ম ও প্রাণ রক্ষার্থে নদীয়ার নবদ্বীপ, পােড়াবাড়ি ও তৎসংলগ্ন এলাকার অভিজাত ব্রাহ্মণগণ পৈতা পরিত্যাগপূর্বক পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের জঙ্গলময় জলাভূমিতে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। নদীয়ায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তাদের থাকলেও বল্লাল সেনের ভয়ে তারা আর ফিরে না গিয়ে অত্র অঞ্চলে বসতবাড়ি গড়ে তােলে।

দীর্ঘদিনের বসতবাটি, সহায় সম্পদ, পেশা ও চেনা পরিবেশ ছেড়ে বিপদসঙ্কুল জঙ্গলময় উপকূলীয় পরিবেশে অভিজাত ব্রাহ্মণগণের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। নতুন স্থানে আদিবাসীদের সাথে তাদের খাপ খাইয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয় এবং শিক্ষা-দীক্ষার অভাবে এই জঙ্গলময় পরিবেশে তারা আর্থসামাজিক দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে। নৃতত্ত্ববিদ রিজলি হার্টন, গেটে, পণ্ডিত রামচন্দ্র ভট্টাচার্য, পণ্ডিত দিগীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, ডাঃ সতীনাথ বিদ্যারত্ব, সুকৃতিরঞ্জন প্রমুখ মনীষীর বিবরণমতে, শিক্ষার অভাব ও কৃষিকাজ অবলম্বন করার কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে অনগ্রসর সম্প্রদায়ে পরিণত হলেও, তাদের মতাে নমশূদ্রগণ অভিজাত বর্ণসম্প্রদায়।

নমশুদ্র ও দেবল ব্রাহ্মণ

দেবল ব্রাহ্মণদের পরিচয়ের আগে, দেবল কী বা কোথায় এটা জানা প্রয়ােজন। অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী আধুনিক করাচী বন্দর নগরের অদূরে আরব সাগরের তীরবর্তী দেবল একটি সুপ্রাচীন পােতাশ্রয় বা সমুদ্র বন্দর। মধ্যযুগে দেবল সিন্ধু প্রদেশের একটি প্রধান সমুদ্র বন্দর ছিল। দেবল তথা সিন্ধু অঞ্চলের তৎকালীন শাসনকর্তা ছিলেন রাজা দাহির। ব্রাহ্মণ বংশীয় রাজা দাহিরের পূর্ণ নাম হলাে দাহির সেন। তার পিতা ছিলেন আলােরের শাসনকর্তা। ৭১২ খ্রি. আরবদের দ্বারা সিন্ধু বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত আলাের অঞ্চল ব্রাহ্মণ বংশীয় রাজাদের শাসনাধীনে ছিল। কাজী ঈসমাইল রচিত ‘চাচনামা’ গ্রন্থে আলাের তথা সিন্ধু অঞ্চলের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে।

এখন বিষয়টি হচ্ছে নমশূদ্রদের সাথে এই দেবল ব্রাহ্মণদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায় বাংলার রাজা বল্লাল সেন পদ্মিনী নাম্মি এক পরমা সুন্দরী বেশ্যাকে বিবাহ করেন। তখনকার সমাজে অসবর্ণ বিবাহ অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিল। তাই বিবাহ পরবর্তী কালে পদ্মিনী নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্যে এক একাদশী ব্রত পালনের আয়ােজন করেন। এই ভৌমি একাদশী পালন উপলক্ষে রাজদরবারের ব্রাহ্মণ ভােজনের আয়ােজন করেন।

সেই অনুসারে রাজা দেবল ব্রাহ্মণদেরকে নিমন্ত্রণ করেন। কাহ্নকুঞ্জ থেকে আগত দেবল ব্রাহ্মণগণ রাজা বল্লাল সেন প্রদেয়, তদীয় পত্নী পদ্মিনীর একাদশী পালনে অন্ন ভােজনের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে দেবল ব্রাহ্মণগণ রাজরােষে নিপতিত হয়ে বিতাড়িত হন। এই ব্রাহ্মণগণ বাংলার ভােবা, নালা, জলাভূমি তথা নিভৃত বনজঙ্গল ও চরাঞ্চলে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। ঐতিহাসিকদের মতে বল্লাল সেন কর্তৃক বিতাড়িত ঐ ব্রাহ্মণগণের উত্তরসূরিরাই অধুনা নমশূদ্র বলে পরিচিত। এই হলাে দেবল ব্রাহ্মণদের বাংলায় আগমনের মােটামুটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

নমস্ মুনি এবং আজকের নমশূদ্র সম্প্রদায়

নমস্ মুনি এক সুপ্রাচীন ঋষি। তিনি কাশ্যপ কুলেরই একজন। বর্তমান মানবাত্তরে সপ্তঋষির অন্যতম নমস মুনিও একজন। অর্থাৎ বর্তমান মানবাত্তরে সপ্তঋষির তালিকা নিরূপ নমস, আত্রী বৈশিষ্ট্য বিশ্বমিত্র, গৌতম, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ। এই মহান পৌরাণিক ঋষি নমস্ মুনিই হচ্ছেন বাংলা ভাষাভাষী নমশূদ্র গােষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা এবং এই পৌরাণিক ঋষি থেকেই নমশূত্রের উৎপত্তি। স্যার হার্বাট হােপ রিজলে ছিলেন একজন ব্রিটিশ Ethnographer। ১৮৫১ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে প্রশাসক হিসাবে ভারতবর্ষে কর্মরত ছিলেন। তিনি বাংলা জাতি, উপজাতি নিয়ে The Tribes and Castes of Bengal (২য় খণ্ড) নামক গ্রন্থে গবেষণা করেছিলেন। তাঁর গবেষণায় তিনি নমশূদ্রের উৎপত্তি বিষয়ে নমস্ মুনির যােগসূত্র আবিষ্কার করেছেন। ১৮৯১ সালে তিনি প্রকাশ করেন যে নমস্ মুনিই নমশূদ্রের পৌরাণিক পূর্বপুরুষ। তিনি এভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন— নমস্য সম্মানীয় শুত্র অথবা যেভাবে তাদেরকে প্রচার করা হয়েছে, নমস্থ সৃজ (সজই হতে নমস) নমস্যজ বা নমস্য সৃজন > নমস্য সৃজ > নমস্যজ। নমশূদ্রগণ বিশ্বাস করেন, তাদের কুল সম্পর্ক রয়েছে ঠিক এভাবেই মারিচি > কাশ্যপ > নমস্ > কীর্তিবান এবং উরুবান বা অরিবান (ইন্দো-ইরানীয় ভাষায় বরুণ)।

মুনির নমস্-এর দুই পুত্র কীর্তিবান এবং উরুবান যাদের থেকেই নমদের মধ্যে প্রধানত যে দুটি শাখা ‘শেফালী ও ধানী’-এর উৎপত্তি হয়। পরবর্তী প্রধান এই দুটি শাখা থেকে কালক্রমে আরও ৩টি উপশাখার উৎপত্তি হয় যথা,

১. প্রামাণিক : নমশ্রেণি বল্লাল সেনের রােষানলে পতিত হলে শ্রোত্রীয় নাপিতেরা যার নবশায়কের অন্তর্গত, নমসের ক্ষৌরকর্ম বন্ধ করে দেয়। ফলে উক্ত কাজের জন্যে নমদের মধ্যে থেকে ‘প্রামাণিক’ (বিশ্বস্ত) শাখার উৎপত্তি হয়। প্রামাণিক যাদেরকে গ্রাম্য কথায় পরমাণিক বলা হয়, শেফালীও ধনী শাখার অন্তর্গত।
২. মৎস্যজীবী শেফালী ও ধানী শাখার মধ্যে থেকে কিছু লােক মাছধরা ও মাছের ব্যবসাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করলে এই শাখার উদ্ভব হয় এরা সাধারণত জেলে বা জালিয়া ও বড়াল নামে পরিচিত।

৩. মগুয়ান পূর্বকালে আরাকান রাজ্য থেকে আগত ‘মগ’ নামক এক শ্রেণির লােক নিবঙ্গে তথা পটুয়াখালি, বরিশাল, খুলনায় বসতি স্থাপন করে মৎস্যব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে ওঠে এই মগদের সঙ্গে যে সকল মম যােগ দেয়, তারা মগুয়ানম নামে পরিচিতি পায়। নমদের মূল পেশা কৃষিকাজ বা হালচাষ, তাই নমরা হালিয়া নামেও অভিহিত।

বিনয়তােষ ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক সম্পাদিত ‘শক্তিসঙ্গম তন্ত্র’ নামক সুপ্রাচীন সংস্কৃত তন্ত্র গ্রন্থের প্রাণতােষী অধ্যায়ে ‘হর-পার্বতী সংবাদ’-এ হর ও পার্বতীর কথােপকথনের মধ্যদিয়ে নমশূদ্র জাতির উৎপত্তি ও বংশবিস্তারের যে বিবরণ পাওয়া যায় তার বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ-

পার্বতীঃ হে দেব, ঐ যে দুজন কাকার ব্যক্তি তােমার সঙ্গে শুশানে-মশানে ঘুরে বেড়ায় ও তােমার পরিচর্যা করে, তারা কারা? ঐরূপ হীন ব্যক্তিদের তুমি এত প্রশ্রয় দাও কেন?

শিবঃ দেবী! তারা হীন নয়। তারা পরহিত-ব্রতে উৎসাহী দুজন গৃহত্যাগী ব্রাহ্মণ, নাম আপসার ও নৈব আমি তাদের বড় ভালােবাসি। তারা বহু ক্লেশ ও শ্রম স্বীকার করে দুইটি ব্রাহ্মণ শিশুকে বাঁচিয়ে তুলেছে।

পার্বতীঃ হে দেব! কোন ব্রাহ্মণ শিশুস্বয়কে তারা বাঁচিয়ে তুলল।

শিবঃ মহামুনি কশ্যপ, যিনি ব্রহ্মান্দন মারিচির পুত্র, তার ঔরসে প্রধা নামক স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন মুনিবর নমস্। বাল্যকাল থেকেই নমস্ ছিলেন ধ্যান-যােগাদিতে মগ্ন। আপসার ও নৈধ্রুব, যাদের আমি আমার নিকট আশ্রয় দিয়েছি, তারা ঐ কশ্যপ মুনির প্রিয় শিষ্য এবং মুনির নমসের যজ্ঞসঙ্গী। কালক্রমে ব্রহ্মার মানসপুত্র রুচির পরমা সুন্দরী নন্দিনী সুলােচনা সতীকে বিবাহ করে মুনিবর নমস্ তার যজ্ঞ সঙ্গী আপসারও নৈধ্রুব সহযােগে পরমসুখে মথুরায় বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু সংসারের আকর্ষণ মুনির নমসকে বেশিদিন বেঁধে রাখতে পারে না সুলােচনা সতী যখন ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা, তখন যজ্ঞসঙ্গী আপসার ও নৈধ্রুব’র উপরে স্ত্রীর দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পণ করে নমস্ মুনি তপস্যার উদ্দেশে গৃহত্যাগী হন এবং চতুর্দশ বছরের মধ্যে তার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন না।

পার্বতীঃ অতি চমৎকার কথা কিন্তু ঐরুপ দুগ্ধপােষ্য শিশুদের তারা কেমন করে বাঁচিয়ে রাখল দেব?

শিবঃ সেই জন্যেই তাে দেবী; অপসার ও নৈধ্রুব আমার নিকট এত প্রিয় তারা অতি দরিদ্র মুনিপুত্র প্রতিপালন করবার মতাে সঙ্গতি তাদের ছিল না। তাই কখনাে সর্পখেলা দেখিয়ে, কখনাে ভিক্ষাবৃত্তি করে অর্জিত অর্থে বহু ক্লেশে তারা শিশুকে বাঁচিয়ে রাখে এবং তাদের নানাজ্ঞানে জ্ঞানী করে তােলে।

পার্বতীঃ কিন্তু হে দেব! কীর্তিবান ও উরুবানকে পরিত্যাগ করে তারা তােমার নিকট আশ্রয় লইল কেন?

শিবঃ বিধির নির্বন্ধ বৈকাইবে কে! তপস্যার তরে নমস্ মুনি সেই যে গৃহত্যাগী হন, চতুর্দশ বছরের মধ্যে আর প্রত্যাবর্তন করেন না। অতঃপর চতুর্দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে অকস্মাৎ কোন একদিন মুনিবর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে সুদর্শন সদাচারী পুত্রদ্বয়কে দেখে অত্যন্ত প্রীত হলাে। পুত্রদ্বয়ের বয়স যখন কিঞ্চদধিক চতুর্দশ বছর, অথচ তখনাে তাদের উপনয়ন হয়নি। নমস মুনি তখন পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারের জন্য ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হন। কিন্তু বয়ঃসীমা চতুর্দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় কেহই উপনয়ন সংস্কারে স্বীকৃত হন না। পুত্রদের উপনয়ন সংস্কারে ব্যর্থ হয়ে মুনিবর নমস্ মনে অত্যন্ত দুঃখ পান এবং পুত্রদের সদ্গতি কামনায় নির্জন পর্বতকান্দারে শ্রী হরির আরাধনায় নিমগ্ন থাকতে পুনরায় গৃহত্যাগী হন। পিতৃদেবের এই অকস্মাৎ অন্তর্ধানে কীর্তিবান ও উরুবান অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে এবং পিতৃদেবের প্রজাগমন না হওয়ায় পিতার সন্ধান অভিলাষে তারাও গৃহত্যাগী হয়। মথুরার শূন্য গৃহ তখন আপসার ও নৈবের নিকট দুঃসহ হয়ে ওঠে। মনের দুঃখ নিবারণের জন্যে তখন তারা আমার নিকট এসে আশ্রয় নেয় এবং এরপর থেকে তারা আমার কাছেই আছে।

পার্বতীঃ কীর্তিবান ও উরুন কোথায় গেল, দেব?

শিবঃ পিতার সন্ধান অভিলাষে গৃহত্যাগী হয়ে বহু জনপদ পরিভ্রমণ করতে করতে পরিশেষে শিলিগুড়ি অঞ্চলে গিয়ে সীমন্ত নামক জনৈক শুদ্র রাজার রাজ্যে উপনীত হয়। রাজা সীমন্ত এই সুদর্শন যুবকদ্বয়কে সমাদরে আশ্রয় দেন এবং কন্যা পরমাসুন্দরী শিপিকা ও সপত্রিকাকে তাদের সাথে বিবাহ দেন।

পার্বতীঃ অত্যন্ত আনন্দের কথা। তারপর কী হলাে?

শিবঃ জ্যেষ্ঠপুত্র কীর্তিবাণের স্ত্রী হয় জ্যেষ্ঠকন্যা শিপিকা এবং উরুবানের স্ত্রী হয় কন্যা সপত্রিকা। সীমন্ত রাজার জামাতা হয়ে, রাজ্যের বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে এবং সুপবিত্র কৃষিকাজকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে কীর্তিবান ও উরুবান আনন্দে সেই রাজ্যে বসবাস করতে থাকে। কালক্রমে তাদের ঘরে পাঁচপুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করে ।

পার্বতীঃ তাদের সন্তানাদির নাম কী দেব?

শিবঃ কীর্তিবানের তিন পুত্র—অভিরাম, নন্দরাম ও লালাদ এবং দুই কন্যা – অমলা ও বিমলা। উরুবানের দুই পুত্র সঞ্জয় ও বীরলাল এবং এক কন্যা মালতী কালক্রমে তাদের সন্তানরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে অসমঞ্জের পুত্র-কন্যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং ক্রমান্বয়ে তাদের বংশবিস্তার লাভ করে।

পার্বতীঃ অসমঞ্জ কে, প্রভু?

শিবঃ অযােধ্যার সূর্যবংশের সুবিখ্যাত রাজা সগরের জ্যেষ্ঠ পুত্র অসমঞ্জ। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ভগবদ্ভক্ত। রাজপুত্র হওয়া রাজকার্যের প্রতি কোনােরূপ আকর্ষণ তার ছিল না। ফলে রাজা সগর তাকে রাজপুরী হতে বহিষ্কার করে দেন। পিতৃবিতাড়িত অসমঞ্জ সস্ত্রীক গৃহত্যাগী হয়ে ক্রমে সীমন্ত রাজার রাজ্যে গিয়ে পুনরায় গৃহবাস শুরু করেন। তাদের গৃহে ক্রমে পাচকন্যা ও তিনপুত্র জনুগ্রহণ করে। কন্যাদের নাম : শ্যামা, মা, বামা, চিত্রা ও রাসেশ্বরী। পুত্রদের নাম বেত্র, বস্ত্র ও বীরজ। পুত্র-কন্যাদের পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করাবার পর কীর্তিবান, উরুবান ও অসমঞ্জ পরস্পরের সন্নিকটে অবস্থান করে সানন্দে নিজ নিজ সংসার ধর্ম প্রতিপালন করতে থাকে।

পার্বতীঃ হে দেব! সন্তানদের সদ্গতি কামনায় নমস্ মুনি সেই যে তপস্যা করতে বাহির হন, তাঁর সে তপস্যায় সুফল কী হয়?

শিবঃ হ্যাঁ দেবী! নমসের আরাধনায় সুফল হয়। সন্তানদের শুভ কামনায় একাগ্রচিত্তে তিনি পূৰ্বক্ষের যে একনিষ্ঠ আরাধনা করেন, তাতে সন্তষ্ট হয়ে পরমদেব নারায়ণ একদিন ভক্তর নমসের সামনে আবির্ভূত হন এবং ভক্তকে বর প্রার্থনা করতে বলেন ভক্ত নমস তখন তাঁর নিকট একে একে তিনটির প্রার্থনা করেন।

পার্বতীঃ কী কী বর তিনি প্রার্থনা করেন?

শিবঃ নমসের প্রথম প্রার্থনা আমার পুত্রদের বংশ যেন প্রকৃত ব্রাহ্মণসম হয়! দ্বিতীয় প্রার্থনা আমার পুত্রদের বংশ যেন আমার নামেই খ্যাত হয়। তৃতীয় প্রার্থনা আমার নাম যেন কালজয়ী হয়।

পার্বতীঃ নমসের প্রার্থনা কি পূর্ণ হয় দেব?

শিবঃ হ্যাঁ দেবী! দেবােত্তম নারায়ণ বাঞ্ছাকল্পতরু। ব্রহ্মোপাসক নমসের সাধনায় প্রীত হয়ে তাকে আশীর্বাদ করে বললেন ‘তথাস্তু’। নারায়ণের প্রথম বর ‘তােমার বংশ তােমার নামেই খ্যাত হবে। তােমার সন্তানেরা শূদ্রা বিয়ে করেছে, তজ্জন্য তােমার নমস্ নামে শুদ্র যুক্ত হয়ে এই বংশ ‘নমশূদ্র’ নামে খ্যাত হবে নারায়ণের তৃতীয় বর ‘তােমার নাম কালজয়ী হবে তােমার ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র মহিমা ও কীর্তি গৌরবে তােমার নামের মহিমা জগতে ক্রমােজ্জ্বল হবে। এইভাবে নমসের মনস্কামনা পূর্ণ করে নারায়ণ অন্তর্হিত হলেন।
পার্বতীঃ হে দেব! বরপ্রাপ্তির সংবাদ তিনি কি তার সন্তানদের অবগত করান?

শিবঃ হ্যাঁ দেবী! সেই কথা বলবার জন্যেই তাে মুনির নমস্ তার পুত্রদের নিকট ছুটে যান । মুনিবর সকলকে ডেকে সস্নেহে আশীর্বাদ করে বরপ্রাপ্তির সকল কথা তাদের নিকট ব্যক্ত করেন। আরও বলেন যে, কেবল সংসার নিয়ে মত্ত থাকিও না। পাপ, দোষ, হীনতাদি বর্জন করে উচ্চ আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করিও। সংসারধর্ম প্রতিপালনের মধ্যে দিয়ে সর্বদা ব্রহ্মের উপাসনা করিও। তবেই শান্তি লাভ করবে।

পার্বতীঃ তারপর কী হল, দেব?

শিবঃ জ্যেষ্ঠপুত্র কীর্তিবানের আলয়ে হিল শেফালী ফুলের প্রাচুর্য আর কনিষ্ঠপুত্র উদ্যানের আবাসে ছিল ধান্যাদির প্রাচুর্য। তা দেখে নমস মুনি জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্রকে যথাক্রমে ‘শেফালী’ ও ‘ধানী’ আখ্যা প্রদান করেন।

পার্বতীঃ হে দেব, অসমঞ্জের বংশে এইরূপ কোনাে খ্যাতি হয় কি?

শিবঃ হ্যাঁ দেবী, হয় । অসমঞ্জের পুত্র ‘পদ্মকান্তি’ ছিল যশস্বী ও খ্যাতিমান । এই পক্ষের বংশধরেরা পরে ‘পােদ্দ’ বা ‘পােদ’ খ্যাতি প্রাপ্ত হয়। অসমঞ্জের জ্যেষ্ঠপুত্র নামে খ্যাত হয়। বেত্র-ক্ষত্র ও ‘পােল’ জাতি একই বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় জাতি, সূর্যবংশীয় রাজপুত্র অসমঞ্জের বংশধর।

পার্বতীঃ হে দেব, জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নমস্ মুনি কি তার সন্তানদের নিকটেই অতিবাহিত করেন?

শিবঃ না। মুনিবর নমস্ ছিলেন নির্জন সাধনায় অভ্যস্ত। সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়ার পরে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নির্জন পর্বত করে অবস্থিতিকার যা ঈশ্বরােপাসনায় অতিবাহিত করবার অভিলাষে মুনিবর নমস্ একদিন পুত্র-পৌত্রগণকে সঙ্গেহে আশীর্বল করে হরিগুণগান কীর্তন করিতে করতে পুনরায় বনে গমন করেন।

পার্বতীঃ ‘শক্তি সঙ্গমতম্ভ’ গ্রন্থের প্রাণতােষী অধ্যায়ে ‘হের-পার্বতী সংবাদ’ সমাপ্ত।

সংক্ষেপে নমশুদ্র সম্প্রদায়ের বংশপরিক্রমা-

ব্রহ্মা – ব্রহ্মার পুত্র মারিচ- মরিচের পুত্র মহামুনি কাশ্যপ – কাশ্যপের পুত্র মহামুনি নমস- নমসের পুত্র কীর্তিবান,উরুবান- নমশুদ্র/নমস্বেজ বা নম সম্প্রদায়।

সবশেষে এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায় নমশুদ্র সম্প্রদায় সনাতন ধর্মের কোন অযাচিত বা অবহেলিত জাতি গোষ্ঠী নয় বরং সাক্ষাত মুনী শ্রেষ্ঠ কাশ্যপ মুনীর বংশধররাই হলো আজকের নমশুদ্র সম্প্রদায়।

তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ,পত্র-পত্রিকা,নবজাগারণ ডটকম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে