ড. গোলাম কাদির : ছিলটি নাগরী লিপি যার হাতে পেয়েছিল প্রাণ

0
114

বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, লিখন এবং পঠন-পাঠনে ব্যবহৃত শক্তিশালী দ্বিতীয় বর্ণমালা সিলেটী নাগরী লিপি। গৌড় বঙ্গের প্রাচ্য-প্রান্ত সিলেটের মতো স্থানে আদলে নগারীর মতো অভিনব লিপিমালার প্রচলন এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনাচারে দীর্ঘকাল ধরে সে লিপির লালন সকলের কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসাকে অবশ্যই জাগ্রত করে।সিলেটী নাগরী লিপি এবং এ লিপিতে রচিত সাহিত্য সিলেট বাসীর নিজস্ব সম্পদ। এ ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে ড. গোলাম কাদিরের শ্রম ও ত্যাগের কথা জাতি অনাগতকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। মনে রাখতে হবে, ঐতিহ্য জাতীয় জীবনে প্রেরণার উৎস। আত্মবিকাশের পাটাতন বা ভিত্তিভূমি। শিকড় দিয়ে গাছ মাটি থেকে রস গ্রহণ করে, পাতা দিয়ে আলো বাতাসের উপাদান সংগ্রহ করে বেড়ে উঠে। ঠিক তেমনিভাবে জাতি ও তার ঐতিহ্য থেকে প্রেরণা রস গ্রহণ করে সামনের দিকে সিনা টান করে এগিয়ে যায়। পৃথিবীতে অনেক ভাষা আছে যার নিজের কোনো লিপি বা বর্ণমালা নেই। ইংরেজী এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ভাষা। আসলে, ইংরেজী ভাষা লেখা হয় রোমান হরফে। শুধু ইংরেজী নয়, ইউরোপের অনেক ভাষা লেখা হয় রোমান হরফে। বহুল প্রচলিত উর্দুভাষারও নিজের কোন লিপি নেই। আরবী বর্ণমালার দ্বারা উর্দু লেখা হয়। এছাড়া ফার্সীভাষা মূলত আর্যভাষা। এ ভাষার চর্চা হয় সেমিটিক আরবী বর্ণমালার সাহায্যে। এসব তথ্য আমরা পাই ভাষা বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে।(তথ্যসূত্রঃ ব্যহত চিন্তা- ড. গোলাম কাদির)

সিলেট অঞ্চলে প্রায় তিনশ’ বছর নাগরী হরফে বা বর্ণমালা দিয়ে সাহিত্য চর্চা হয়েছে। নাগরী লিপির অক্ষর সংখ্যা ৩২টি। স্বরবর্ণ- ৫টি। স্বরচিহ্ন ৫টি। যুক্তাক্ষর ৩ থেকে ৫টি। সিলেটীরা সাহিত্য চর্চা করেছেন ছিলটী নাগরী লিপিতে। বাংলা বর্ণমালায় নয়। প্রকৃতপক্ষে সহজ-সরল হওয়ার কারণে তখন বাংলাভাষা পড়া লেখার জন্য বাংলা লিপির বিকল্প একটি সহজ-সরল বর্ণমালা উদ্ভাবনের প্রয়োজন হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ষোল শতকে সিলেট অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক বাইরের লোক সিলেটে আসেন। তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। নিজেদের জানা লিপিমালার উপাদান নিয়ে তৈরি করেন সিলেটী নাগরী হরফ। এ লিপিতে প্রায় সোয়াশ’ পুস্তক-পুস্তিকা রচিত হয়েছে বলে গবেষকদের অভিমত। অন্যমতে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে সিলেটী নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয়।

ভারতবর্ষের ভাষার একটি জরিপ করেন স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন। তিনিই প্রথম ছিলটী নাগরী বর্ণমালার কথা উল্লেখ করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সিলেট গেজেটিয়ার সম্পাদনা করেন মি. বিসি এ্যালেন। তিনিও ছিলটী নাগরী হরফের কথা উল্লেখ করেন। বিদেশী পন্ডিতদের পক্ষ ধরে ছিলটী নাগরী লিপি ও এ লিপিতে রচিত সাহিত্য বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু আলোচনা করেন শ্রী নগেন্দ্র নাথ বসু, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, ড. সুকুমার সেন, ড. হাসান দানী, অধ্যাপক শিব প্রসন্ন লাহিরী, আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন, চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ, অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী প্রমুখ লেখক গবেষকগণ। তবে বিস্তারিত তথ্যপোত্তসহ তাদের আলোচনায় তেমন একটা ফলপ্রসূ তথ্য পাওয়া যায়নি। ইত্যোমধ্যে অনেক মূল্যবান উপাদান নানা কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায় সংরক্ষণের অভাবে।সিলেটের এই গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে এগিয়ে আসেন গোলাম কাদির। তাঁর গবেষণা কর্মকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন, বিশ্বভারতী, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছিলটী নাগরী লিপিতে রচিত সাহিত্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। ১. রোমান্টিক ২. জীবনী ও জংনামা (যুদ্ধবিষয়ক) ৩. সূফীবাদ ও মারেফাত তত্ত্ব ৪. মুর্শিদী ও মারফতি গান বা রাগ-রাগিনী ৫. ইসলাম ধর্ম বিষয়ক।সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। অতীতে অনেকবার সিলেটের মানচিত্র রদবদল হয়েছে। প্রাচীন সিলেটের সীমা-চৌহদ্দি হিসেবে বলা হয়েছে:উত্তরে কামরূপ রাজ্য। দক্ষিণে সমতট রাজ্য। পূর্বে হেড়েম্ব রাজ্য (কাছাড়)। পশ্চিমে পুন্তুবর্ধন রাজ্য। উৎস \ সিলেট নাগরীর পহেলা কেতাব \ ও দই খুরার রাগ\ ড. অনুরাধা চন্দ\ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়\ ভারত\ দে’জ পাবলিশিং\ কলকাতা\ ৯/২০০৬ খ্রিস্টাব্দ।আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ছিলটী নাগরী বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালার থেকে অনেক সরল। একটি ধ্বনির জন্য একটি হরফ এ নিয়মটি ছিলটী নাগরী সাহিত্যে কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। তাছাড়া গোলাম কাদির নাগরী লিপিতে রচিত অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি তালিকাও দিয়েছেন।ড. গোলাম কাদিরের দেয়া গ্রন্থগুলোর মধ্যে:ভেদসার, তালিব হুছন, চন্দ্রমুখী, খাবর নিশান, শহর চরিত, হাসর তরান, ভেদকায়া, আশিকনামা, ছয়ফুলবেদাত, বাহরাম জহুরা, নূর নাজাত, দইখুরার রাগ, নূর নছিয়ত, হাসর তরান, রাগ শিতালং, রদ্দেকুফুর, বসন্তভমরা প্রভূতি ১২০টি পুঁথি পরিচিত।

গবেষক গোলাম কাদিরের পুরো নাম এসএম গোলাম কাদির (১৯৩৩-২০১১ খ্রিস্টাব্দ)। পিতা মুহাম্মদ উমর আলী। মাতা বেগম বকাউল জাহান। জন্মস্থান- সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার চামরদানি গ্রামে।কর্মজীবনের সবটুকুই কেটেছে অধ্যাপনায়।সিলেটী নাগরী লিপি ভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থটি তাঁকে দেশে-বিদেশে সুনাম ও সুখ্যাতি দিয়েছে। সিলেটী নাগরী লিপি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে তিনি প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। বাংলা একাডেমী ঢাকা তাঁর থিসিস প্রকাশ করে ১/১৯৯৯ খিস্টাব্দে।বিংশ শতাব্দিতে সিলেটের মানুষ সমাজ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় তাঁরা বাংলা পঠন-পাঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে নাগরী চর্চায় স্বপাভাবিক নিয়মে ভাটা পড়ে।একদিন ঐতিহাসিক কারণে যে লিপির উদ্ভব হয়েছিল বিশ শতকে এসে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই নাগরী চর্চা ঐতিহ্য হিসেবে বেঁচে আছে। এ ঐতিহ্যের অনুসন্ধানী ড. গোলাম কাদিরের মতো গুণীজনরা অনাগতকাল সিলেটবাসীর কাছে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক-

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রবান্ধিক

তথ্যসূত্রঃ প্রবন্ধ- সৈয়দ মোস্তফা কামাল,জালালাবাদ লোক সাহিত্য পরিষদ,সিলেট ফেসবুক পেইজ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে