গোত্র কী? বিবাহের ক্ষেত্রে সনাতন ধর্মে গোত্রের গুরুত্ব কতটুকু?

0
474

গোত্র কী?

ব্রহ্মা থেকে যেসকল ঋষিদের উৎপত্তি হয়েছে, তাদের থেকেই বিভিন্ন গোত্রের প্রবর্তন হয়েছে। সেই ঋষিদের থেকে যে বংশানুক্রমিক ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে, ত-ই গোত্র নামে পরিচিত। সেসমস্ত ঋষির নামানুসারেই সেই সেই গোত্র পরিচিতি লাভ করে আসছে। পাণিণির সূত্রানুসারে (৪/১/৬২) “অপত্যং পৌত্রপ্রভৃতি গোত্রম্” অর্থাৎ, পৌত্র প্রভৃতির অপত্যগণের নাম গোত্র। গোত্র প্রসঙ্গে বৌধায়নের মত নিম্নরূপ-
বিশ্বামিত্রো জমদগ্নিভরদ্বাজোত্থ গৌতমঃ।
অত্রিবশিষ্ঠঃ কশ্যপ ইত্যেতে সপ্তঋষয়।
সপ্তানাং ঋষিনামগস্ত্যাষ্টমানাং যদপত্যং তদগোত্রম্।।

অর্থাৎ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ, কশ্যপ ও অগস্ত্য- এই আটজন মুনির পুত্র ও পৌত্র প্রভৃতি অপত্যগণের মধ্যে যিনি ঋষি হতে পেরেছেন, তিনিই তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গোত্র অর্থাৎ, তাঁর নামেই সেই বংশীয়গণের গোত্র চলে। অতএব, বিশ্বামিত্রের অপত্য দেবরাত প্রভৃতিকে বিশ্বামিত্রের গোত্র বলে এবং জমদগ্নির অপত্য মার্কন্ডেয় প্রভৃতিকে জমদগ্নির গোত্র বলে। আশ্বলায়নশ্রৌতসূত্রের নারায়ণকৃত বৃত্তিকে লিখিত আছে যে, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি আটজন ঋষির অপত্যদের তাদের গোত্র বলে জানবে। যেমন জমদগ্নি ঋষির গোত্র বৎস প্রভৃতি, গৌতমের অরণ্যাদি, ভরদ্বাজের দক্ষ, গর্গ প্রভৃতি। (বিশ্বকোষ)
বিবাহের ক্ষেত্রে গোত্রের গুরুত্ব কতটুকু

প্রথমে বর্ণের বিষয়টাতে আসা যাক –

অনেকেই বর্ণের বিষয়টাকে ভুল বুঝে। এটা ঠিক করা যাক। শাস্ত্র কী বলে এই বিষয়ে দেখি তাহলে-

ঋগ্বেদের ৩য় মণ্ডলের রচয়িতা (বক্তা নয়) ছিলেন গাদীর নন্দন বিশ্বামিত্র। গাদী ছিলেন একজন রাজা, যিনি বর্ণ প্রথানুশারে একজন ক্ষত্রিয়। কিন্তু বিশ্বামিত্র ছিলেন ঋষি তথা ব্রাহ্মণ। তো এখানেই প্রমাণিত হয় একজন ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ হতে পারে।

শূদ্রের পুত্র রত্নাকর ব্রহ্মজ্ঞানে ঋষি বাল্মিকী(রামায়ণ রচয়িতা) তথা একজন ব্রাহ্মণে যেমন পরিণত হয়েছিলেন। তেমনি ব্রাহ্মণ কূলে জন্ম হওয়া ঋষি পরশুরাম(বিষ্ণুর অবতার) হয়েছিলেন ক্ষত্রিয়।

শ্রীমদভগবদগীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন –
“চতুর্বর্ণ ময়া সৃষ্টম্ গুণ কর্মণ বিভাগস”
অর্থাৎ, আমি(পুরুষ পরমেশ্বর রূপে) নিজেই সৃষ্টি করেছি, মানুষের কর্মগুণের ভিত্তিতে।

বর্ণ বিভাজন –
১. ব্রাহ্মণ : শ্রীমদভগবদগীতা ১৮/৪২ –
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।।
অর্থাৎ, অন্তকারণ নিগ্রহ করা, ইন্দ্রিয়কে দমন করা, ধর্মপালন এবং তার জন্য কষ্ট করা, বাহির এবং ভেতর থেকে শুদ্ধ থাকা, অন্যদের অপরাধ ক্ষমা করা, মন, ইন্দ্রিয় ও শরীরকে সরল রাখা, বেদ-শাস্ত্র ও ঈশ্বরের শ্রদ্ধা ও অধ্যয়ন করা অধ্যাপনা করা, পরমাত্মাকে অনুভব করা ব্রাহ্মণের কাজ।
সহজ ভাষায় – বিজ্ঞানী, পুরোহিত, জ্যোতিষী, চিকিৎসক সকলেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্রাহ্মণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
২. ক্ষত্রিয় : শ্রীমদভগবদগীতা ১৮/৪৩ –
শৌর্য়ং তেজো দৃতির্দাক্ষ্যং য়ুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্।
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্।।
অর্থাৎ, শুরবীরতা, তেজ, ধৈর্য, চতুরতা আর যুদ্ধ, দান আর রাজ্যপাট এইসব ক্ষত্রিয়ের কাজ।
বলতে গেলে, যারা রাজকার্য করে, রাজকার্যে সাহায্য করে, সেনাবাহিনী এবং দান করে তারা ক্ষত্রিয়।
৩. বৈশ্য ও শূদ্র : শ্রীমদভগবদগীতা ১৮/৪৪ –
কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্।
পরিচর্য়াত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্।।
অর্থাৎ, কৃষিকাজ, গো-পালন, বাণিজ্য বৈশ্যের কাজ। পরিচর্যাত্মক কাজ শূদ্রের সাধারণ কর্ম।
যা বুঝাতে চাইছে, কৃষক, ব্যবসায়ী, পশুপালক সকলেই বৈশ্য। আমাদের নিত্যদিনের কাজে যারা সাহায্য করে তারা শূদ্র।

আর, শ্রীমদভগবদগীতা ১৮/৪৫ শ্লোকে এটা বলা আছে-

স্বে স্বে কর্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ।

স্বকর্মনিরতঃ সিদ্ধিং য়থা বিন্দতি তচ্ছৃণু।।

অর্থাৎ, নিজ নিজ কর্মে নিরত মানুষ সিদ্ধিলাভ করে থাকে। যেই প্রকারে মানুষ তার নিজের কাজের অনুযায়ী সিদ্ধি লাভ করে তা শুন।
শাস্ত্র এটাও বলে,
জন্ম জায়তে শূদ্রঃ
সংস্কারঃ দ্বিজ উচ্চতে
বেদঃ পঠনাৎ ভবেত বিপ্র
ব্রহ্ম জ্ঞানেতী ইতি ব্রাহ্মণ।
অর্থাৎ, জন্ম মূহুর্তে সকলেই শূদ্র, সংস্কার দ্বারা দ্বিজ, জ্ঞান লাভে বিপ্র আর ব্রহ্মজ্ঞানে হয় ব্রাহ্মণ।
তো এই ক্ষেত্রে আপনার পিতা বা পিতামহ কি করে তার কোন মহত্ব নেই। পিতা ব্রাহ্মণ হলেও আপনি জন্মের পর শূদ্র। অনেকেই আমার কথায় বিরোধ করবে, কিন্তু সত্যি তো এটাই।
এবার নিজেই চিন্তা করে দেখুন, আপনার বাবা যুদ্ধ করতো বলে আপনাকে যুদ্ধে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? যে বেদ জানেনা সে কেমনে পূজা করবে?
যুক্তি একজন শাস্ত্রের একটি বড়ো অংশ, শাস্ত্র নিজেই বলে –
য়ুক্তিহীন বিচারেন ধর্মহানী জায়তে।
অর্থাৎ, যুক্তিহীন বিচার ধর্মহানী করে।

এবার গোত্র(অবিচ্ছিন্ন পুরুষ পরম্পরা) –

পাণিনীয় শাস্ত্রে উল্লেখ আছে –
অপত্যাম পৌত্রপ্রভৃতি গোত্রম্।
অর্থাৎ, অপত্য (সন্তান), পৌত্র এবং এভাবে চলতে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে হয় গোত্র।
আর্যগণ অনেক আগেই এই গোত্র সৃষ্টি করেছিল, মূলত বিবাহের এবং বংশ পরিচয়ের জন্য। এবং স্বগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ করেছেন, কারণ –
১. স্বগোত্রে বিবাহ মানে নিজের ভাই-বোনদের মধ্যে বিবাহ।
২. স্বগোত্রে বিবাহে বংশধর বিকলাঙ্গ হয়, এমনকি প্রতিবন্ধী বা মৃত সন্তানের জন্মও হতে পারে।
৩. বংশগত রোগ প্রকটভাবে দেখা দিতে পারে।
৪. বংশ ধ্বংস হয়ে যায়।

ব্যাখ্যা – বিজ্ঞান মতে প্রতিবার কোষ বিভাজনে Chromosome-এর শেষাংশে কিছু ক্ষয় দেখা দেয়। এবং যা বিরাট ক্ষয়ের সৃষ্টি করে যখন একজন ব্যক্তি বড় হতে থাকে। এবং ভাই বোনের মধ্যে তার রূপ প্রায় একই থাকে। জননের সময় Crossing-Over প্রক্রিয়ায় যা ঠিক হতে পারে যদি তা নতুন Gene-এর সঙ্গে পরিবর্তন করে। কিন্তু সেই Gene যদি একই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তাতে লাভ হয় না। যেই ক্ষয় সেই ক্ষয়ই রয়ে যায়। এবং এরকম চলতে থাকলে, এক পর্যায়ে তা বিরাট রূপ ধারণ করে। এবং Gene নষ্ট করে ফেলে। তাতে মানুষের মৃত শিশু তথা দুর্বল শিশুর জন্ম হয়। এবং এরা বেশিদিন বাঁচতে পারে না।

পরিশেষে বলা যায়, সনাতন শাস্ত্রমতে বিবাহের ক্ষেত্রে ভিন্ন গোত্রে বিবাহই শাস্ত্র এবং বিজ্ঞান সম্মত এতে কোন সন্দেহ নেই।আমাদের সাধু,শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সহ বিভিন্ন মহাপুরুষগণ ও তাই বলে গেছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে