অসুর মর্দিনী দেবী দুর্গা এবং অকাল বোধন

0
91

অসুর মর্দিনী দেবী দুর্গা এবং অকাল বোধন

সপ্তশতী চন্ডীতে দেখা যায়, দেবতারাও দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য কীর্তন করেছেন। ভক্তিভাবে একাগ্রচিত্তে তার বন্দনা করেছেন। চন্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ের ৩৪ ও ৭৩ শ্লোকে দেবী দুর্গা দেবগণ কর্তৃক শক্তিরূপে, শান্তিরূপে এবং মাতৃরূপে বন্দিত হয়েছেন।

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু শন্তি রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥

যে দেবী শক্তি রূপে, শান্তি রূপে এবং মাতৃরূপে সর্বত্র (জড় ও প্রাণীতে) বিরাজিত, তাকে আমরা ভক্তিভাবে বারবার নমস্কার করছি।

তিথি অনুযায়ী ষষ্ঠীতে শায়নকালে শারদীয়া দুর্গা দেবীর বোধন, দেবীর আগমন ও অধিবাস। সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন ও কল্পারম্ভ এবং সপ্তমী বিহিত পূজারম্ভ। অষ্টমীতে মহাষ্টমী পূজা, অষ্টমী নবমী সন্ধীলগ্নে সন্ধী পূজা। নবমীতে মহানবমী কল্পারম্ভ। বিজয়া দশমী শ্রীশ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর দশমী বিহিত পূজা সমাপনান্তে বিসর্জনের মাধ্যমে কুলাচারানুসারে বিজয়াদশমীকৃত্য।

দেবী দুর্গার আবির্ভাবের কারণ

শুভশক্তির দ্বারা অসুরকে-অন্যায়কে-অত্যাচারকে-অশুভকে পরাভূত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যুগে যুগে। শক্তির দেবীর হাতে ভয়ংকর অসুরদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শান্তি ও কল্যাণ। বিভিন্ন পুরাণে, বিভিন্ন উপাখ্যানে আমরা এ কথার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। যেমন, মার্কন্ডয়ে পুরাণের শ্রীশ্রী চণ্ডী অংশে আমরা দেখি দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছেন। কিংবা দেবী অম্বিকারূপে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই ভয়ংকর দৈত্যকে নিধন করে শান্তি স্থাপন করেছেন।

দেবতারা যখন সহজেই অসুরদের কাছে পরাজিত হন, তখন তাদের লজ্জা লুকোবার আর জায়গাই যেন থাকে না। পুরাকালে একাধিকবার দেবতারা ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সরে গিয়েছিলেন নিজ নিজ কর্তব্য থেকে। আর তখন দেবতাদের এই ঔদাসীন্য আর ভোগতন্ময়তার সুযোগে অসুরেরা দখল করে নিয়েছিল স্বর্গরাজ্য। দেবতারা দেবরাজ ইন্দ্রসহ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। দৃষ্টান্তরূপ বলা যায়, একবার দেবরাজ ইন্দ্রের ঔদাসীন্য ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে মহিষাসুর নামে এক অসুর দেবতাদের স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত করে স্বর্গ ও মর্ত্যরে অধীশ্বর হয়ে বসেছিল।রাজ্যহারা দেবতারা তখন ব্রহ্মা ও শিবকে অগ্রবর্তী করে গেলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু ও শিব আগত দেবতাদের ভর্ৎসনা করলেন এবং ভেঙে না পড়ে সবার শক্তিকে একত্র-সংহত করে অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন। সব দেবতার মিলিত শক্তি থেকে আর্বিভূত হলেন দেবী দুর্গা। এই যে ‘সকল দেবতার শক্তির সম্মিলন’- এর মধ্যেই রয়েছে দুর্গাপূজার তাৎপর্য। দুর্গতি থেকে ত্রাণের জন্য দেবতাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রমূর্ত রূপে প্রকাশ পায় দেবী দুর্গার প্রতীকে। আর দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন বলে মহাদেবীর একনাম দুর্গা।

কখনও তিনি মহামায়া, কখনও বা ঊমা। কখনও আবার মহিষাসুরমর্দিনী। এমনই বহু নামে মর্তে পূজিত হন দেবী দূর্গা। শক্তির আধার দেবী দুর্গাকে আরাধনার মাধ্যমেই প্রতিবছর শারদীয়া উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি। মৃণ্ময়ীর পুজো থেকে পেটপুজো, আলোর রোশনাই, বাহারি পোশাক কোনটারই কমতি থাকে না চারদিনের সার্বজনীন এই উৎসবে। আর এই উৎসব ঘিরে রয়েছে নানা মতবাদ নানা মতামত।

ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের ১২৫ সূক্ত সূক্ত ‘দেবীসূক্ত’। বৈদিক এ সূক্তে আদ্যাশক্তি মহামায়ার মহিমা বর্ণিত হয়েছে। আটটি ঋগ্বেদীয় দেবীসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্ট্রী ঋষি হলেন অম্ভৃণ মহর্ষির কন্যা বাক্। তিনি ধ্যানযোগে সমাধি অবস্থায় নিজের মধ্যেই আদ্যাশক্তি মহামায়াকে উপলব্ধি করে এ মন্ত্রটি দর্শন করেছিলেন। সূক্তের মন্ত্রগুলোতে উপলব্ধি করা যায় যে, অম্ভৃণ মহর্ষির কন্যা বাক্ জগতের পরমেশ্বরী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এ অবস্থানেই সাধকের মুক্তি ঘটে। এ সূক্তে শুধু দ্বিতীয় মন্ত্রটিই জগতীছন্দে রচিত, অন্য অবশিষ্ট সাতটি মন্ত্রই ত্রিষ্টুচ্ছন্দে রচিত। পরব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি জগন্মাতার প্রীতির জন্য এ সূক্তটির বিনিয়োগ করা হয়।সপ্তশতী শ্রীচণ্ডী পাঠ করার পরে দেবীসূক্ত-পাঠের বিধান রয়েছে।

অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরা-
ম্যহমাদিত্যেরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভ-
র্ম্যহমিদ্ৰাগ্নী অহমশ্বিনোভা॥

“আমি একাদশ রুদ্ররূপে, অষ্টবসুরূপে, দ্বাদশ আদিত্যরূপে এবং সর্বদেবরূপে জগতে বিচরণ করি।আমি মিত্র ও বরুণ, উভয় দেবতাকে ধারণ করি। আমি ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে ধারণ করি। ”

দেবী শত্রু বিনাশকারী। তিনি অমৃতের প্রতীক চন্দ্রকে ধারণ করে রাত্রিকে আলোকিত করেন।তিনি ত্বষ্টা বা বিশ্বকর্মা নামে জগতের কর্ম প্রবাহকে সচল রাখেন। তিনি পূষা হয়ে জীবকে পরিপোষণ করেন। ভগ বা জগতের সকল ঐশ্বর্যকে তিনি ধারণ করে আছেন। যজ্ঞ বা পূজায় যজমান উত্তম হবিঃ এবং সোমরস দেবগণকে বিধিপূর্বক শ্রদ্ধার সাথে সমর্পণ করেন। সেই দেবতাগণের তর্পণকারী উত্তম হবিঃ, সোমরস এবং পূজার নৈবেদ্য সেই সকলই আদ্যাশক্তি মহামায়ার কাছে যায়। তিনিই পরম সন্তুষ্ট হয়ে যজমানকে যজ্ঞফলরূপ ধন সম্পদ প্রদান করেন।

অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসুনাং
চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা
ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্ ॥

“আমি রাষ্ট্রী অর্থাৎ সমগ্র জগতের ঈশ্বরী। আমি উপাসকগণের ধন প্রদাত্রী। আমি পরব্রহ্মকে আত্মস্বরূপে অভিন্নরূপে প্রত্যক্ষ জেনেছি। আমি যজ্ঞিয় দেবতাগণের প্রধানা। জগৎপ্রপঞ্চরূপে আমি অনন্তভাবে অবস্থান করি এবং জীবাত্মা হয়ে জীবের মধ্যে প্রবিষ্টা। আমাকেই সর্বদেশে সুরনরাদি যজমানগণ বিবিধভাবে আরাধনা করে।”(আদ্যা শক্তি দুর্গা- কুশল বরণ চক্রবর্তী)

দেবী দুর্গার অকাল বোধন

দুর্গা পূজা আগেকার দিনে চৈত্র মাসে হতো।এখনো বিবিন্ন জায়গায় হয়ে থাকে।সেই পূজাটিকে অনেকে বাসন্তী পূজা বলেও জেনে থাকে।তবে বর্তমানকালে শরৎকালে আশ্বিন মাসে ‌চিরা‌চিরত দূর্গাপূজো হয়ে থাকে তাই এই উৎসবের আর এক নাম শারদীয়া। কথিত আছে রাবনের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার আগে দেবী দূর্গাকে তুষ্ট করতে অকালে (অর্থাৎ চৈত্র মাসে নয়) শরৎকালেই দেবীকে আহব্বান করেন অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র। অন্যসময়ে বা অকালে দেবীর বোধন হয় বলে এই পূজা অকাল বোধন নামেই পরিচিত। ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে পুজো করলে দেবী প্রসন্ন হবেন একথা জানতেন রাম। আর তাই নীলপদ্মের সন্ধানে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান তিনি। কিন্তু ১০৭টি পদ্ম খুঁজে পান নি তিনি। বাকি একটি পদ্মের ঘাটতি মেটাতে নিজের একটি চোখ দেবীর কাছে সমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন রাম। এহেন শ্রদ্ধায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী রামের সম্মুখে প্রকট হয়ে আশীর্বাদ দেন। যুদ্ধ শুরু হয় সপ্তমীতে। ভয়াবহ যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রামের হাতে মৃত্যু হয় রাবণের। দশমীর দিন রাবণের শবদাহ করা হয়।রাজা রাম চন্দ্রের অকাল বোধন এবং বোধনের সফলতার ইতিহাসকে স্মরণে রাখতেই সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ প্রতিবছর শরতেই দেবীকে আহ্বান করে পূজা সম্পন্ন করেন।প্রতিবছরের ন্যায় এবার ও বিশ্বের সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ শারদ উৎসবে মেতে উঠবেন।দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের মতই মর্তলোকের অসুরদের বধ করে পৃথিবী মনুষ্য বসবাসের উপযোগী করে যাবেন এই প্রত্যাশা রেখেই লেখাটি শেষ করছি।শুভকামনা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য।

লেখক-

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল,প্রিন্ট পত্রিকা,শ্রী শ্রী চন্ডী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে