অবতার,ভগবান ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য

0
753

অবতার ,,ভগবান ,,ঈশ্বর এবং পরমেশ্বর এগুলো কি সব একই ?? অবতার কি ভগবান ?? ভগবান কি ঈশ্বর ?? ঈশ্বর কি পরমেশ্বর ?? অর্থাৎ অবতার কি পরমেশ্বর ??

উত্তর হবে নাহ্ !!অবতার পরমেশ্বর নয়।অনেক পার্থক্য আছে।এই চারটি শব্দ বিশ্লেষন করলেই পাওয়া যাবে।

#অবতারঃ অবতার হলো আবির্ভূত দেবতা বা অবতরণ।কোন দেবতা যদি পঞ্চমহাভুতের সৃষ্ট শরীরে প্রবেশ করেন তাহলে তাকে অবতার বলা হয়।অর্থাৎ জীবদেহধারী ঈশ্বর বা দেবতা।বৈদিক সাহিত্যে অবতার শব্দটি পাওয়া যায় না।তবে বেদ-পরবর্তী সাহিত্যে এটি ক্রিয়াপদ আকারে উল্লিখিত হয়েছে।খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পরে রচিত পৌরাণিক সাহিত্যেই এই শব্দটিকে স্বতন্ত্রভাবে বিশেষ্য পদের আকারে ব্যবহার করা হয়েছে।

ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুসারে,ইন্দ্র একটি রহস্যময় শক্তির বলে ইচ্ছামতো যে কোনো রূপ ধারণ করতে পারেন।ভগবদ্গীতা গ্রন্থে অবতার মতবাদটি বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা হলেও সেখানে অবতার শব্দটি পাওয়া যায়না।অবতার শব্দটির পরিবর্তে অন্যান্য পারিভাষিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গেই অবতার -বাদের বিশেষ সম্পর্ক।যদিও এই মতবাদ কিছু ক্ষেত্রে অন্য কয়েকজন দেবদেবীদের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়।

গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর দশাবতার ও ভাগবত পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর বাইশটি অবতারের বর্ণনা পাওয়া যায়।যদিও শেষোক্ত পুরাণটিতে এও বলা হয়েছে বিষ্ণুর অবতারের সংখ্যা অগণিত।অর্থাৎ কে অবতার তা নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় না।ধারণা করা হয়, দেবগুন সম্পন্ন ব্যাক্তিগন অবতার শব্দে ভূষিত হন।বিভিন্ন গ্রন্থে অবতারের মোট সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়।অবতারের সংখ্যা চার থেকে ঊনচল্লিশ যে কোন একটি সংখ্যা হতে পারে।অবতার দুই প্রকার আংশিক ও পূর্ণাবতার।বিষ্ণু পরিপূর্ণভাবে আভির্ভূত হলে তাকে বলে পূর্ণবতার এবং আংশিক -ভাবে আভির্ভূত হলে তাকে বলে অংশাবতার।

গরুড় পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুর দশ অবতার হলেনঃ
১. মৎস্য, মাছের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ।
২. কূর্ম, কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ।
৩. বরাহ, শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ।
৪. নৃসিংহ, অর্ধনরসিংহ রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ।
৫. বামন, বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ।
৬. পরশুরাম, পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ।
৭. রাম, রামচন্দ্র, অযোধ্যার রাজপুত্রের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ।
৮. কৃষ্ণ, ভ্রাতা বলরামের সাথে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ।ভাগবত পুরাণ অনুসারে বলরাম শেষনাগের অবতার।কোনো কোনো বৈষ্ণব শাস্ত্রে তাঁকে বিষ্ণুর নবম অবতার মনে করা হয়।কারণ,এই সকল গ্রন্থে বুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই।
৯. বুদ্ধ, কলিযুগে অবতীর্ণ হন।
১০. কল্কি, সর্বশেষ অবতার। এই অবতার কলিযুগের অন্তে আবির্ভাব ঘটবে।

এই দশ অবতারের মাঝে পূর্ণ অবতার মানা হয় নৃসিংহ, রাম এবং কৃষ্ণকে।যদিও কৃষ্ণ সর্বোচ্চ আসন লাভ করেছেন।আবার অন্যান্য পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থের মতে চৈতন্য মহাপ্রভু হলেন বিষ্ণুর অন্যতম অবতার।গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুসারে তাঁকে অবতার রূপে পূজা করার বিধান রয়েছে।এই কারণেই চৈতন্য মহাপ্রভুকে গৌরাঙ্গ অবতার নামে অভিহিত করা হয়।এছাড়াও বৈষ্ণব মতে অবতার নিয়ে আরো যে পার্থক্য গুলো রয়েছে তা হলো ,, পুরুষ অবতার, গুণ অবতার, মন্বন্তর অবতার, শাক্ত্যাবেস ও অবেস অবতার।

#ভগবানঃ ভগ শব্দের অর্থ ছয়টি ঐশ্বর্য(ষড়ৈশ্বর্য) এবং বান শব্দের অর্থ যুক্ত বা সমন্বিত।বিষ্ণু পুরাণ মতে ,, (৬.৫.৭৯), যিনি পরম ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয় গুনযুক্তা তিনিই ভগবান।অর্থাৎ যে পুরুষদের মাঝে সমগ্র ঐশ্বর্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য পাওয়া যায় তার নামের পূর্বেই ভগবান শব্দটি উল্লেখ করা যাবে।মহাভারতে বিভিন্ন ঋষী এবং মহাপুরুষদের নামের পূর্বে ভগবান শব্দের উল্লেখ রয়েছে।এছাড়া সংস্কৃত অভিধানে ভগবান এর ভগ শব্দের অর্থ ,,যেখানে শ্রী ,,ঐশ্বর্য ,,বীর্য ,,যশ ,, জ্ঞান ও বৈরাগ্য।অথ্যাৎ তিনিই ভগবান যিনি মানব কল্যাণের জন্য শ্রী দাতা,সকল ঐশ্বর্য দাতা,সকল প্রকার জ্ঞান দাতা,সকল প্রকার বীর্য ও যশ দাতা,যিনি সর্বদা ভোগ বিষয়ে অনাসক্ত বা বৈরাগ্য তিনিই ভগবান।

#ঈশ্বরঃ ঈশ্ ধাতুর উত্তরে বরচ্ প্রত্যয় যোগে ঈশ্বর শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে।ঈশ্ ধাতুর অর্থ শ্রেষ্ঠ বা প্রভূ।যিনি এই জীব-জগতের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা যিনি সকলের প্রভূ,তিনিই ঈশ্বর।আবার যাঁর অষ্টবিধ ঐশ্বর্য আছে,তিনিই ঈশ্বর।অষ্টবিধ ঐশ্বর্য বলতে অণিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিত্ব ও বশিত্ব বোঝায়।সূক্ষ্ম আকার ধারণ করার ক্ষমতাকে অণিমা,শরীরকে স্থুলাকার করার ক্ষমতাকে মহিমা, ইচ্ছা মত ভারী হওয়ার ক্ষমতাকে গরিমা,ইচ্ছা মত লঘু বা হালকা হওয়ার ক্ষমতাকে লঘিমা,সর্বত্র গমন করার ক্ষমতাকে প্রাপ্তি,নিজ ভোগের ইচ্ছা পূর্ণ করার ক্ষমতাকে প্রাকাম্য,প্রভূত্ব করার ক্ষমতাকে ঈশিত্ব এবং সকলকে বশ করার ক্ষমতাকে বশিত্ব বলে।এক,অব্যয় ও অদ্বিতীয়।তিনি অনাদির আদি।এক হয়েও তিনি বহুদা বিভুতিতে প্রকাশ।যেমন তিনি একদিকে সৃষ্টি কর্তা ও স্থিতি কর্তা,অন্যদিকে দিকে তিনি প্রলয়েরও কর্তা।ঈশ্বর হল জাগতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ অবস্থানে অবস্থানকারী কোন অস্তিত্ব।আর্যদের স্মৃতি শাস্ত্রে মূলতঃ ঈশ্বর বিষয়ে এভাবেই ধারণ দেয়া আছে।এই মহাবিশ্বের জীব ও জড় সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রক আছে মনে করা হয়।

#পরমেশ্বরঃ এটিও বিশেষ্য পদ।ঈশ্বরের সমর্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।এছাড়াও সনাতন ধর্মীয় গ্রন্থ সমূহে ঈশ্বর শব্দের স্থানে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে পরমেশ্বর,ব্রহ্ম ও পরমব্রহ্ম।এই সব শব্দও বিশেষ্য পদ।বেদ অনুসারে ঈশ্বর নিরাকার।উনি সর্বভূতেষু। অর্থাৎ এমন কোন স্থান নেই যেখানে উনি নেই।তবে ভক্ত তাকে যেভাবে কল্পনা করেন উনি সেই কল্পনার সাকার রূপ।ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও মহেশ্বর হলো পরমেশ্বরের গুনবাচক শব্দ।অর্থাৎ যখন পরমব্রহ্ম সৃষ্টি করেন তখন উনি ব্রহ্মা।যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু।যখন ধ্বংস করেন তখন রূদ্র বা শিব।এরা আলাদা কোন সত্ত্বা নয়। কিন্তু পৌরাণিক ব্যক্তিগন তাদের রূপ বর্ণনা করে আলাদা আলাদা মতবাদ দিয়েছেন।ব্রহ্মাকে রজ গুন, বিষ্ণুকে সত্ব গুন ও শিবকে তম গুনের প্রতিক মনে করা হয়।এই তিন গুন মিলেই পরমব্রহ্ম।

ব্রহ্মসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে আছে ,, অরূপবদেব হি তৎপ্রধানত্বাৎ।অর্থাৎ ব্রহ্ম নিশ্চিতভাবেই নিরাকার,কারণ তিনি বেদ ও বেদান্তের প্রধান প্রতিপাদ্য বর্ণনীয় বিষয়।পরে বলা হয়েছে- তদব্যক্তমু আহ হি। অর্থাৎ শাস্ত্রে ব্রহ্মকে অব্যক্ত বা ইন্দ্রিয়াতীতও বলে উপদেশ দিয়েছেন।কেন উপনিষদে আছে,সেই ব্রহ্মে চক্ষু গমন করে না অর্থাৎ চক্ষু দ্বারা তাঁকে দেখা যায় না, বাক্য দ্বারা তাকে প্রকাশ করা যায় না এবং মন দ্বারাও তাকে মনন বা চিন্তা করা যায় না।সোজা কথায় ব্রহ্ম চক্ষু, কর্ণ আদি ইন্দ্রিয় ও মনের অগোচর অর্থাৎ ব্রহ্ম নিরাকার।ঈশ উপনিষদে আছে ,,যিনি ব্রহ্ম হতে তৃণ পর্যন্ত সমস্ত ভূত বা বস্তুকে আত্মাতেই দর্শন করেন এবং সমস্ত ভূত বা বস্তুর মধ্যে নিজের আত্মাকেই দর্শন করেন,তিনি এরকম দর্শনের পর কাউকে ঘৃণা করেন না।অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বভূতে বিরাজমান।একমাত্র নিরাকার বস্তুই সর্বভূতে বিরাজিত থাকতে পারে।

বেদান্ত মতে পরমেশ্বর স্বরূপত নির্গুণ,নিরাকার এবং অব্যক্ত হলে ঈশ্বরের সাকার রূপের কল্পনা কেন?এ প্রশ্নের উত্তরে ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে, বৃদ্ধ্যর্থঃ পাদবৎ। অর্থাৎ উৎপাসনার সুবিধার্থে ব্রহ্মের পাদ আদি রূপ কল্পনা করা হয়েছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম চার পাদ ও ষোড়শ-কলা বিশিষ্ট।প্রকাশবান, অনন্তবান, জ্যোতিষ্মান ও আয়তনবান এই হল ব্রহ্মের চার পাদ।প্রতি পাদে চার কলা রয়েছে।প্রকাশবানে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিক নামক কলা,অনন্তবানে পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, দ্যুলোক ও সমুদ্র নামক কলা,জ্যোতিষ্মানে অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র ও বিদ্যুৎ নামক কলা এবং আয়তনবানে প্রাণ চক্ষু, কর্ণ ও মন নামক কলা রয়েছে।ব্রহ্মের এই সাকার রূপ কাল্পনিক ও রূপক কারণ কোন বস্তুর রূপ ঐ রকম থাকতে পারে না।মূলত ব্রহ্মকে সহজ উপায়ে চিন্তা করার জন্য তাঁর রূপের কল্পনা করা হয়েছে।

ব্রহ্মসূত্রে আছে- স্থানবিশেষাৎ, প্রকাশাদিবৎ।অর্থাৎ স্থান বিশেষের জন্য ব্রহ্মের সাকার রূপ কল্পনা করা হয়ে থাকে।যেমন- আকাশ, আলোক প্রভৃতির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।একটি ঘটের মধ্যস্থ আকাশ আর বাইরের আকাশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই,শুধু নাম বা উপাধির পার্থক্য থাকে।তদ্রূপ ঘরের ভেতরের আলো ও বাইরের আলো একই, শুধু পৃথক নাম ও উপাধি দেয়া হয় মাত্র।যখন ঘটের বিনাশ হয় তখন ঘটের ভিতরের ও বাইরের আকাশ এক হয়ে যায়,তেমনি ঘরের বিনাশ হলে ঘরের ভেতরের ও বাইরের আলো এক হয়ে যায়।শুধু নাম বা উপাধির জন্যই নিরাকার ব্রহ্মকে সাকার বলে মনে হয়।জ্ঞানযোগীর নিকট ব্রহ্ম নিরাকার।

তাই অকপটে বলা যায় যে , অবতার বা ভগবান মানেই পরমেশ্বর নয়,পরমেশ্বর পরম স্রষ্টা,সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণকর্তা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে