“আমি বলে যাই বলে যাই জনগণের ঠাই—
অনেকদিন আগের কথা
শুনে ঘোরে যায় মাথা
ইতিহাসের পাতা সাক্ষী আছে তাই,
অখণ্ড পাক-ভারত ছিল
কেমনে ভারত খণ্ড হইল
তার বিবরণ কিছু বলে যাই….”
—কবিয়াল বিমল চন্দ্র কর
এমন বহু পঙক্তি/স্তবকের রচিয়তা সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জের ভাটির জনপদের অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব কবিয়াল বিমল চন্দ্র কর সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার জাঞ্জাইল নামক গ্রামে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ০৭ মে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিপিন চন্দ্র কর এবং মাতার নাম সুভাষিনী কর। তিন ভাই বোনের মধ্যে তিনি অগ্রজ। তার পিতা পরিবার সমেত নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার চকপাড়া গ্রামে শিফট করলে তিনি সেখানের একটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৬২/৬৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তার পিতা সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের কদমতলী নামক গ্রামে শিফট করেন এবং সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তিনি জামালগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে পারিবারিক নানাবিধ সমস্যা ও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানলেও জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ও সংস্কৃতির প্রতি টান—যা ছাত্র জীবন থেকেই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল—তাকে নিয়ে যায় অন্য জগতে, ভবের জগৎ থেকে ভাবের জগতে। একই ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের (মহাজন বাড়ি) আরেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব ওস্তাদ ক্ষীরোদ চন্দ্র কর -এর নিকট হতে হারমোনিয়াম, তবলা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র এবং সংগীত শিক্ষায় তালিম নেন। তিনি গ্রামীণ, বৈদিক-পৌরাণিক সংস্কৃতির বিবিধ ক্ষেত্র যেমন—রামায়ণ, পদ্মপুরাণ, কীর্তন, বাউল, নৃত্যগীত, গীতিনাট্য (ঢপযাত্রা), যাত্রাপালা ইত্যাদি ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি যাত্রা দল গঠন করে ওস্তাদ ও ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালের ১৭ জানুয়ারির নির্বাচনে একই ইউনিয়নের নয়াহালট গ্রামের (বড়বাড়ি) জনাব আব্দুল মান্নান তালুকদার এর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। জীবিকার তাগিদে সুর ও ছন্দে ক্যানভাসিং এর মাধ্যমে পণ্য ফেরি করে বিক্রি করতেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পরিবারের সাথে ভারতের মৈলম পাহাড়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন এবং সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। সে সময় তার পিতা প্রয়াত হন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশের টানে কদমতলী গ্রামে ফিরে আসেন। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটি পাড়ার মোখলেসুর রহমান ওরফে এখলাছ মিয়ার জমিদারি এস্টেটে নায়েবের কাজ নেন এবং ৮-১০ বছর সে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত জামালগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল লিখক সুনীল পাল চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ঐ সময়ে উপজেলা পর্যায়ে বিচারিক কার্যক্রম চালু হলে তিনি অ্যাডভোকেট সুখময় রায় এবং মোক্তার হেমবাবুর অধীনে কিছুদিন করণিক এর কাজ করেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে তিনি গৃহ শিক্ষক/প্রাইভেট টিউটর হিসেবে প্রায় ১০ বছর শিক্ষকতা করেন। নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দার ছিমটি গ্রামের কবিয়াল নারায়ণ চক্রবর্তী তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পিমনা মানুষের খোঁজে কদমতলী গ্রামে আসেন এবং তাকে কবিগানে প্রশিক্ষণ দেন। কবিগানে তালিম নিয়ে তিনি ২০ বছর যাবত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কবি গান গেয়ে আসছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী/বিপক্ষ কবিয়াল হিসেবে তিনি নেত্রকোনার কবিয়াল নারায়ণ চক্রবর্তী, বাবুল চক্রবর্তী, সুনামগঞ্জের কবিয়াল নির্মল কর, সুরেশ দাস, উপেন্দ্র দাস, সুশীল দাস, সুরেশ মাহিষ্যদাস, নেত্রকোনার কবিয়াল সম্রাট মদনমোহন আচার্য (বর্তমানে প্রয়াত) প্রমুখের সাথে গান গেয়ে আসছেন। দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, পরমতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, নিগুঢ়তত্ত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে তার স্বরচিত নাতিদীর্ঘ পাণ্ডুলিপি রয়েছে। ‘নিকুম্বিলা থেকে রাবণবধ’ নামে স্বরচিত যাত্রাপালা যা বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। ১৯৯৫ সাল থেকে অদ্যাবধি তিনি জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদে করণিক ও গ্রাম আদালতের অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত আছেন। বর্তমানে তিনি সত্তরোর্ধ্ব এবং বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় জর্জরিত। তিনি সকলের আশীর্বাদ চেয়েছেন এবং তার সংস্কৃতিলব্ধ অর্জিত জ্ঞান উপযুক্ত শিষ্যের মাধ্যমে পরম্পরায় রেখে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। [অনুলিখন : প্রদীপ চন্দ্র দত্ত, সরকারি কর্মকর্তা]