হাওরে হাওর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সময়ের দাবি
জীবন কৃষ্ণ সরকার
বলার অপেক্ষা রাখেনা এদেশের মানুষের মূল সম্বলই হলো ঐ হাওরগুলো।কারণ মৎস্য,পাথর,ধান সুনামগঞ্জ তথা সমগ্র দেশের প্রাণ।এই তিনটি উপাদানই মানব জীবনে অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িত।মাছে -ভাতে বাঙ্গালির মাছ এবং ভাত না হলে কোন ক্রমেই দু-দন্ড চলেনা।এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।আর দেশের প্রায় সিংহ ভাগ মাছ ও ধান পাওয়া যায় ঐ হাওরগুলোতে।যাদেরকে বলা হয় প্রাকৃতিক সোনা।আর যার ওপর ভর করে আপনি চলবেন তাঁর সুখ, দুখ নিয়ে আপনার একটু ভাবার প্রয়োজন নয় কি?সংগত কারণেই আমিও ব্যক্তিগত ভাবে এই দাবিটির পক্ষে।শুধু পক্ষেই নয় আমি মনে করি যারা এই দাবিটি করছেন আমি তাঁদেরই একজন।সত্য কথা বলতে দ্বিধা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেয়া আর হাওর সম্পর্কে জানা এক কথা নয়।হাওরের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস,ঐতিহ্য,সাহিত্য, সংস্কৃতি,জীববৈচিত্র,জীবনাচরণ।আরেকটু ফ্রাংকলি যদি বলি (বর্তমাণ প্রেক্ষাপটে) একজন ইঞ্জিনিয়ার বুয়েট পাশ করে আসলেও সে কি জানে জাঙ্গাল শব্দটি কি বা এটা কোথায় থাকে? সে কি জানে বেঁড়ি বাঁধ কি,দুরমুজ কি অথচ এগুলোতে শত শত লক্ষ টাকা বরাদ্দ থাকলেও শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাবে ঐ টাকাগুলো অব্যবহৃতই থেকে যায় বছরের পর বছর। অথচ হাওরবাসীর জন্য ওগুলো খুবই প্রয়োজনীয়।বড় বড় অফিসারগণ কে পাঠানো হয় হাওর পরিদর্শনে তারা কি জানে হাওর এবং বিলের পার্থক্য কি?,দাইড় কি?জান কি?হাওরের কোন ভূমি উর্বর,কোন ভূমি অনুর্বর,কোথায় কোন ধান ভালো জন্মে তারা কি জানে?কয়েকটা বি.আর আটাশ, বি.আর ঊনত্রিশ আর কৃত্রিম উপায়ে উৎপন্ন কিছু ধান ছাড়া হাওরের আজন্ম প্রিয় কিছু ধান যেমন-গচি, বোরো, শাইল, বাঁশফুল, মালা,টেপি,টেপিবোরো, অগ্নিশাইল, রাতাশাইল, বিন্নি, ধুলাবোরো, পাইকিচুরি, খৈয়া বোরো, মালতি, তুলসীমালা, কন্যাশাইল, জাগলী ,বিচি বোরো,ল্যাঠা,
মুরালী,চিংড়ি/চেংরী, আড়াই, ধুমাই, ষাইট্টা, খাসিয়াবিন্নি,ধারাইল,
চিনিগুড়া, বিরইন, কালিয়াজিরা, দুধসাগর, জামাইভোগ, লতিশাইল, বালাম, কার্তিকভোগ, নাগ্রাশাইল, মিহি, আশামুরা। আনাইম্যা,মঙ্গল এসবের কিছুইতো জানেনা।তাহলে এগুলোর জন্য বিশেষ পড়ালেখার দরকার নয় কি??
পাঠানো হয় একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে মাছ এবং পাখি সংরক্ষণ করার জন্য।শ্রদ্ধেয় ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় জানেনা হাওরে কি ধরনের মাছ পাওয়া যায়।যেমন- টাটকিনি, বাগাড়, রিঠা, রাণী, পাঙ্গাস, বামোশ, নাফতানি, চিতল, একথুটি ও চাকা। সংকটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচিয়া, নাপতেকই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়।বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে- গুলশা, ঘইন্যা, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইন, গজার, তারাবাইন, তিতপুঁটি, নামাচান্দা ও কালিবাউশ,চাপিলা,বাগড়া,গুতুম ইত্যাদি।তাহলে তিনি কিভাবে বুঝবেন এই মাছগুলো কোথায়, কখন,কিভাবে থাকবে এবং শিকারিরা শিকার করতে পারে,এবং কিভাবে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছগুলোকে রক্ষা করতে পারবেন?ঠিক তেমনি ভাবে জানেনা পাখির নাম, কোন পাখি কখন কিভাবে বাস করতে পারে এবং শিকারিরা কিভাবে শিকার করে।তাই কিছু না জেনে তো তাঁর পক্ষে কিছুই সংরক্ষণ করা সম্ভব হবেনা বা হচ্ছেওনা।আর এতসব না জানার জন্য তো এসব অফিসার,ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটগন দায়ী নয়।কারণ তাদের কোর্স প্ল্যানে কোনদিনই এগুলো স্বপ্নেও দেখেন নি।তাহলে তাঁদের দোষেই কি লাভ।তাই এসব বিষয় পাঠ্য তালিকায় রাখতে হলে অবশ্যই একটি হাওরভিত্তিক বিশেষায়িত বিজ্ঞাণ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরি।
হাওরে কখন বৃষ্টি হতে পারে,বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে,কোন বছর বন্যা অগ্রিম হতে পারে,কোন ধানের ফলন ভালো হতে পারে,কোন ধান আগে কাটা যেতে পারে, কোন ভূমিতে কোন শস্যটি ভালো জন্মাতে পারে,কতটুকু জমিতে কি পরিমাণ সার দিতে হবে বা কতটু সারে ভূমির ক্ষতি হবেনা,ধানের অবস্থা বুঝে কখন কোন সার ব্যাবহার করতে হবে,ধানে পোকায় ধরলে, ব্লাস্ট রোগ হলে তড়িত কি পদক্ষেপ নিতে হবে,মাছে মড়ক ধরলে পানিতে কি ব্যবহার করতে হবে। এতসব তো আর গ্রামের না -শিক্ষিত,অর্ধশিক্ষিত কৃষকের জানার কথাও নয়।এগুলো অবশ্যই সরকারের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের জানা উচিত।আর দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরি করতে অবশ্যই বিশেষায়িত হাওর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিকল্প নেই।
বর্তমান সরকার হাওরবান্ধব সরকার।এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।গত বছর(২০১৭) অকাল বন্যায় হাওরডুবির পর মাননীয় প্রধামন্ত্রী সরকারি সহযোগিতায় যেভাবে অসহায় হাওরবাসীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং হাওরের প্রতিটি কোণায় কোণায় পিআইসি গঠণ করে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করেছেন এতে করে হাওরবাসীর মধ্যমণি হয়েই থাকবেন তিনি এবং তাঁর সরকার।তার পরও হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো নাজুক পর্যায়ে রয়েছে।আশা করা যায় এ দিকটাও সরকার শীঘ্রই ভেবে দেখবেন।
আশার কথা হলো সরকার ইতোমধ্যেই সুনামগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন এবং ইতোমধ্যেই বাস্তবায়নও শুরু করেছেন। আমরা সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।তবে আজকের এই বেলায় সমগ্র হাওরবাসীর পক্ষ থেকে আমার জোর দাবি, মাননীয় সরকার অবশ্যই প্রস্থাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিশেষায়িত হাওর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রুপে প্রতিষ্ঠা করবেন নতুবা ন্যূনতম পক্ষে চট্রগ্রামের মতো হাওরবিজ্ঞান অনুষদ/বিভাগ খুলে বিশেষ কিছু শিক্ষার্থীদের হলেও হাওর এবং হাওরের জীববৈচিত্র সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিয়ে হাওরবাসীর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ করে হাওরের পাশাপাশি সারা দেশের জীবন মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক
সভাপতি,হাওর সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা(হাসুস) বাংলাদেশ