হাওরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে হাওর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এখন সময়ের দাবি
জীবন কৃষ্ণ সরকারঃ
এক.
শিরোনামটি দেখে আমার অনেক পাঠক বন্ধুদের মাঝে বিরক্তিও দেখা যেতে পারে আবার অনেকের মনে মৃদু পীড়ার ও সৃষ্টি হতে পারে।যাহোক আমি একজন হাওরপারের সন্তান।হাওরের পোড়া মাটির গন্ধে যার বেড়ে ওঠা। প্রকৃতির মায়াপাশে আবদ্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্ছ ডিগ্রী নিয়েও এখনো হাওরের মূল গর্ভেই যিনি বসবাস করছেন।সেটা কারো দৃষ্টিতে নির্বোধ, বোকা আবার কারো দৃষ্টিতে জগত বেখেয়াল বালকের মতও মনে হতে পারে।ওদের কারো ব্যাপারেই আমার তেমন কিছু বলার নেই,বলতে চাইওনা।সে যাই হোক বাসতো করি হাওরে তাই হাওরের দুঃখ, কষ্ট,চাওয়া পাওয়াগুলোই আমাদের বেশি করে কাঁদায়।তাই বিবেকের তাড়নায় বিভিন্ন সময়ে হাওরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লিখতে বসি।যাহোক আজকের বিষয় “হাওরের জীবনমান উন্নয়নে হাওর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সময়ের দাবি”।নিম্নে এর যথার্থতা তুলে ধরার প্রয়াস করছি।
আগেই বলে নিচ্ছি উল্যেখিত দাবিটি এবারই প্রথম নয় বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখক,গবেষক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক সংগঠক, সংগঠণ তথা হাওরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ব্যাক্তিগত অথবা সাংগঠনিক ভাবে মিডিয়ায় বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন বা তুলে ধরেছেন।এদের সকলের পরিচয় হয়তো আমার জানাও নেই।যাহোক একজন নেহায়েত ক্ষুদ্র লেখক হিসেবে যতটুক জানতে পেরেছি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি।বিস্তারিত জানতে পারলে অবশ্যই তা কোন সময় তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
হাওরের একজন অন্যতম গবেষক,হাওর পারের ধামাইল বাংলাদেশ(হাপাধা)’র কেন্দ্রীয় সভাপতি সজল কান্তি সরকারের সাথে কথা বলে যদ্দুর জানতে পারি গত ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে হাপাধা কর্তৃক আয়োজিত হাওরের অন্যান্য দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল হাওরে হাওর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।আরো জানান,তাহিরপুরের জাতীয় হাওর উৎসবের (২০১৬) আহ্বায়ক ছিলেন সময়ের অন্যতম হাওর সৈনিক, পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি জনাব কাসমির রেজা।তিনিও দাবিটিতে সহমত পোষণ করে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।বিষয়টি বিশদ আলোচনার পর অতিথিদের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.আনোয়ার হোসেন অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ে হাওর বিষয়ক ডিপার্টমেন্ট খোলার ব্যাপারে মুটামুটি একমত পোষণ করেছিলেন যদিও তখনি হাওর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিটিকেই তিনি বাস্তব সম্মত বলেছিলেন। কিন্তু আর্থিক তথা সার্বিক বিবেচনায় ডিপার্টমেন্ট খোলার প্রস্তাবটি তিনি এনেছিলেন।কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় চট্টগ্রামের সমুদ্র এলাকার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান অনুষদ খোলা হলেও ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্বিদ্যালয় স্থাপিত হলেও দেশের অন্যউৎপাদক হিসেবে পরিচিত হাওরবাসীর হালের এই দাবিটি সিকি ভাগও পূরণ হয়নি এখনো।নেত্রকোনায় শেখহাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত হওয়ার পর জনমনে একটা ধারণা ছিল হয়তো এটাতে হাওরের জন্য বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়া হবে।কিন্তু দৃশ্যত তারো কোন ভরসা পাওয়া যাচ্ছেনা।মাঝখানে কতদিন ফাইলপত্র,দৌড়ঝাঁপ করে এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে নিস্তব্দ হয়ে যায় দাবিটি।
গত ২৬/০৩/১৮ তারিখে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার দক্ষিণ বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের বংশীকুন্ডা কলেজ প্রাঙ্গণে জল জনপদ নারী ও শিক্ষা উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত টাঙ্গুয়াপাড়ে স্বাধীনতা উৎসবে তাঁদের পক্ষ থেকে এলাকার বিশিষ্ট বাউল শিল্পী বাবু সুধীর রঞ্জন সরকারের গণ সংগীতের মাধ্যমে হাওরে হাওর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিটি জোড়ালোভাবে পুনরোল্থাপিত হয়।এসময় হাজার হাজার দর্শক শ্রোতার সাথে অনুষ্ঠানে যৌথভাবে অংশ গ্রহন করা হাওর,সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা (হাসুস) কেন্দ্রীয় কমিটিও দাবিটিকে অকুন্ঠ সমর্থণ জানায় এবং দাবিটি জরুরী ভিত্তিতে পূরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আশুদৃষ্টি কামনা করে।
দুই.
হাওরে পর্যটন নয়ঃ
আমরা হাওরের সন্তান।হাওরের মাতৃগর্ভ থেকে আমাদের জন্ম।হাওরের আলো বাতাসে আমাদের বেড়ে ওঠা।তাই আমাদেরকেই বুঝতে হবে হাওরমাতার সুখ,দুঃখ। গুটি কয়েকজন ধনাঢ্য,বিত্তশালীগণের মনোরঞ্জনের জন্য হাওরে পর্যটন কেন্দ্র করা,অবসর সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা, তাও নিরীহ হাওরবাসীর কাঁধের ওপর ভর করে তা কখনই কাম্য হতে পরেনা।তবে বিশ্বায়নের যুগে তাল মেলাতে গিয়ে যদি পর্যটন কেন্দ্র করতেই হয় তবে তা হাওরে নয়, হাওরের পারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ জায়গাগুলোতে করা যেতে পারে।যেমন-শিমুল বাগান,নীলাদ্রী লেক,বারেকের টিলা….ইত্যাদি।তবে মাঝ হাওরে নয়।এতে হাওরের জীববৈচিত্রের উপর আঘাত পড়তে বাধ্য।বিগত দু-বছর পূর্বের তথাকথিত জ্যোৎস্না উৎসব আয়োজনই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।আনন্দ উৎসবের একপর্যায়ে অপসংস্কৃতির চর্চা,অত্যাধিক শব্দে হাওরের মৎস্যরাজিতে আতংক,ড্রিংকসের বোতলের সমাহার,ময়লা-আবর্জনা সব মিলিয়ে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে।এমন পর্যটন তথা প্রমোদ ভ্রমণ আমরা আর চাইনা দ্বিতীয়বার।
তিন.
হাওর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কেন সময়ের দাবি?
বলার অপেক্ষা রাখেনা এদেশের মানুষের মূল সম্বলই হলো ঐ হাওরগুলো।কারণ মৎস্য,পাথর,ধান সুনামগঞ্জ তথা সমগ্র দেশের প্রাণ।এই তিনটি উপাদানই মানব জীবনে অঙ্গা অঙ্গিভাবে জড়িত।মাছে -ভাতে বাঙ্গালির মাছ এবং ভাত না হলে কোন ক্রমেই দু-দন্ড চলেনা।এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।আর দেশের প্রায় সিংহ ভাগ মাছ ও ধান পাওয়া যায় ঐ হাওরগুলোতে।যাদেরকে বলা হয় প্রাকৃতিক সোনা।আর যার ওপর ভর করে আপনি চলবেন তাঁর সুখ, দুখ নিয়ে আপনার একটু ভাবার প্রয়োজন নয় কি?সংগত কারণেই আমিও ব্যক্তিগত ভাবে এই দাবিটির পক্ষে।শুধু পক্ষেই নয় আমি মনে করি যারা এই দাবিটি করছেন আমি তাঁদেরই একজন।সত্য কথা বলতে দ্বিধা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্ছ ডিগ্রী নেয়া আর হাওর সম্পর্কে জানা এক কথা নয়।হাওরের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস,ঐতিহ্য,সাহিত্য, সংস্কৃতি,জীববৈচিত্র,জীবনাচরণ।আরেকটু ফ্রাংকলি যদি বলি (বর্তমাণ প্রেক্ষাপটে) একজন ইঞ্জিনিয়ার বুয়েট পাশ করে আসলেও সে কি জানে জাঙ্গাল শব্দটি কি বা এটা কোথায় থাকে? সে কি জানে বেঁড়ি বাঁধ কি,দুরমুজ কি অথচ এগুলোতে শত শত লক্ষ টাকা বরাদ্দ থাকলেও শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাবে ঐ টাকাগুলো অব্যবহৃতই থেকে যায় বছরের পর বছর। অথচ হাওরবাসীর জন্য ওগুলো খুবই প্রয়োজনীয়।বড় বড় অফিসারগণ কে পাঠানো হয় হাওর পরিদর্শনে তারা কি জানে হাওর এবং বিলের পার্থক্য কি?,দাইড় কি?জান কি?হাওরের কোন ভূমি উর্বর,কোন ভূমি অনুর্বর,কোথায় কোন ধান ভালো জন্মে তারা কি জানে?কয়েকটা বি আর আটাইশ, বি.আর ঊনত্রিশ আর কৃত্রিম উপায়ে উৎপন্ন কিছু ধান ছাড়া হাওরের আজন্ম প্রিয় কিছু ধান যেমন-গচি, বোরো, শাইল, বাঁশফুল, মালা,টেপি,টেপিবোরো, অগ্নিশাইল, রাতাশাইল, বিন্নি, ধুলাবোরো, পাইকিচুরি, খৈয়া বোরো, মালতি, তুলসীমালা, কন্যাশাইল, জাগলী ,বিচি বোরো,ল্যাঠা,
মুরালী,চিংড়ি/চেংরী, আড়াই, ধুমাই, ষাইট্টা, খাসিয়াবিন্নি,ধারাইল,
চিনিগুড়া, বিরইন, কালিয়াজিরা, দুধসাগর, জামাইভোগ, লতিশাইল, বালাম, কার্তিকভোগ, নাগ্রাশাইল, মিহি, আশামুরা। আনাইম্যা,মঙ্গল এসবের কিছুইতো জানেনা।তাহলে এগুলোর জন্য বিশেষ পড়ালেখার দরকার নয় কি??
পাঠানো হয় একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে মাছ এবং পাখি সংরক্ষণ করার জন্য।শ্রদ্ধেয় ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় জানেনা হাওরে কি ধরনের মাছ পাওয়া যায়।যেমন- টাটকিনি, বাগাড়, রিঠা, রাণী, পাঙ্গাস, বামোশ, নাফতানি, চিতল, একথুটি ও চাকা। সংকটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচিয়া, নাপতেকই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়।বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে- গুলশা, ঘইন্যা, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইন, গজার, তারাবাইন, তিতপুঁটি, নামাচান্দা ও কালিবাউশ,চাপিলা,বাগড়া,গুতুম ইত্যাদি।তাহলে তিনি কিভাবে বুঝবেন এই মাছগুলো কোথায়, কখন,কিভাবে থাকবে এবং শিকারিরা শিকার করতে পারে,এবং কিভাবে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছগুলোকে রক্ষা করতে পারবেন?ঠিক তেমনি ভাবে জানেনা পাখির নাম, কোন পাখি কখন কিভাবে বাস করতে পারে এবং শিকারিরা কিভাবে শিকার করে।তাই কিছু না জেনে তো তাঁর পক্ষে কিছুই সংরক্ষণ করা সম্ভব হবেনা বা হচ্ছেওনা।আর এতসব নাজানার জন্য তো এসব অফিসার,ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটগন দায়ী নয়।কারণ তাদের কোর্স প্লানে কোনদিনই এগুলো স্বপ্নেও দেখেন নি।তাহলে তাঁদের দোষেই কি লাভ।তাই এসব বিষয় পাঠ্য তালিকায় রাখতে হলে অবশ্যই একটি হাওরভিত্তিক বিশেষায়িত বিজ্ঞাণ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরি।
হাওরে কখন বৃষ্টি আসতে পারে,বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে,কোন বছর বন্যা অগ্রিম হতে পারে,কোন ধানের ফলন ভালো হতে পারে,কোন ধান আগে কাটা যেতে পারে, কোন ভূমিতে কোন শস্যটি ভালো জন্মাতে পারে,কতটুকু জমিতে কি পরিমাণ সার দিতে হবে বা কতটু সারে ভূমির ক্ষতি হবেনা,ধানের অবস্থা বুঝে কখন কোন সার ব্যাবহার করতে হবে,ধানে পোকায় ধরলে, ব্লাস্ট রোগ হলে তড়িত কি পদক্ষেপ নিতে হবে,মাছে মড়ক ধরলে পানিতে কি ব্যবহার করতে হবে। এতসব তো আর গ্রামের না -শিক্ষিত,অর্ধশিক্ষিত কৃষকের জানার কথাও নয়।এগুলো অবশ্যই সরকারের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকদের জানা উচিত।আর দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরি করতে অবশ্যই বিশেষায়িত হাওর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিকল্প নেই।
চার.
বর্তমান সরকার হাওরবান্ধব সরকার।এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।গত বছর অকাল বন্যায় হাওরডুবির পর মাননীয় প্রধামন্ত্রী সরকারি সহযোগিতায় যেভাবে অসহায় হাওরবাসীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং হাওরের প্রতিটি কোণায় কোণায় পিআইসি গঠণ করে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করেছেন এতে করে হাওরবাসীর মধ্যমণি হয়েই থাকবেন তিনি এবং তাঁর সরকার।তার পরও হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো নাজুক পর্যায়ে রয়েছে।আশা করা যায় এ দিকটাও সরকার শীঘ্রই ভেবে দেখবেন।
আশার কথা হলো সরকার ইতোমধ্যেই সুনামগঞ্জে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন।আমরা সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।তবে আজকের এই বেলায় সমগ্র হাওরবাসীর পক্ষ থেকে আমার জোর দাবি, মাননীয় সরকার অবশ্যই প্রস্থাবিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিশেষায়িত হাওর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রুপে প্রতিষ্ঠা করবেন নতুবা ন্যূনতম পক্ষে চট্রগ্রামের মতো হাওরবিজ্ঞান অনুষদ/বিভাগ খুলে বিশেষ কিছু শিক্ষার্থীদের হলেও হাওর এবং হাওরের জীববৈচিত্র সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিয়ে হাওরবাসীর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ করে হাওরের পাশাপাশি সারা দেশের জীবন মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
লেখকঃ কবি ও কলামিস্ট,
কেন্দ্রীয় সভাপতি,হাওর,সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা(হাসুস) বাংলাদেশ
সম্পাদক,হাওরপিডিয়া