সৌন্দর্যে, সম্পদে অপরুপ সম্মিলন টাঙ্গুয়া

0
419

সম্পদে সৌন্দর্যে অপরুপ এক সম্মিলন টাঙ্গুয়া

জীবন কৃষ্ণ সরকার

এক.
অপরুপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি আমাদের টাঙ্গুয়া।বর্ষায় কলকল ধ্বণি,আফালের শোঁ শোঁ শব্দে শিহরিত টাঙ্গুয়া পারের এক সন্তান হিসেবে ছোট বেলা থেকেই এক স্বর্গীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই আমি আজকের শহুরের ব্যাস্ত পরিবেশে যখনই মনে পড়ে শৈশবের দিনগুলিতে তখনই হারিয়ে যাই এক অনাবিল আনন্দ সাগরে যে সাগরে সাঁতাড়িয়ে হাবু ডুবু খেলা যায় কিন্তু কিনারা পাওয়া যায়না। বলছিলাম সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ’র দ্বিতীয় বৃহত্তম হাওর টাঙ্গুয়া পরের কথা।একদিকে যেমন মৎস সম্পদ অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুদিক থেকেই টাঙ্গুয়া তার নিজস্বতা করে নিয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বুকে। তাই চলুন না আজ সেই অপরুপ টাঙ্গুয়া সম্পর্কে দু চার লাইন জেনে আসি?

দুই.
টাঙ্গুয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রধান কারণ গাছগাছালি।এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২০০ প্রজাতির ও বেশি গাছালি রয়েছে।তন্মধ্যে হিজল, করচ সবচেয়ে বেশি।অন্যান্য গাছের মধ্যে বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া, সিংড়া, শালুক, শাপলা, গুইজ্জাকাঁটা, উকল,রেইনট্রি,পদ্ম,বুনোগোলাপ ইত্যাদি।এসব গাছ-গাছড়া থেকে জ্বালানি কাঠ, আসবাব পত্র সহ গৃহসামগ্রী ও শৌখিন শোপিস তৈরির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করা যায়।
বর্ষাকালে নীলসাদা মেঘেদের সাথে প্রকৃতির ডাকে জেগে উঠে টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠা পানির জলভুমির মধ্যে অন্যতম।পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। পাহাড় থেকে প্রায় ৩০টিরও বেশি ঝর্ণা এসে মিলিত হয়েছে টাঙ্গুয়ায়। টাঙ্গুয়ার স্বচ্ছ জলদেশে বাহারি প্রজাতির মাছের খেলা, হাওরের আকাশ জুড়ে রঙবেরঙের পাখিদের ভেসে থাকা আর এলাকা জুড়ে দৃষ্টি নন্দন উদ্ভিদের সারি টাঙ্গুয়ার হাওরকে করেছে বৈচিত্রময়।টাঙ্গুয়ার হাওরের এই অপরুপ সৌন্দর্যের অবাধ বিচরণ প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।

ইউনেস্কো টাঙ্গুয়ার হাওরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দিয়েছে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের বিশেষত্বের কারণে। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হিসেবে ২০ জানুয়ারী ২০০০ সালে তালিকাভুক্তি হয়।

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি অংশ হলো পাখি।এখানে নানা জাতের প্রায় ২০৮ প্রজাতির(পাখিশুমারী-২০১৯) পাখির সন্ধান পাওয়া যায়।
স্থানীয় জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর।পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওরে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট।
বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল (বাংলাদেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো)। প্রতি বছরই টাঙ্গুয়ায় সমগ্র দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিরল কয়েক জাতের পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুঁতিহাস এবং কালোলেজ জৌরালি (ইংরেজি: Black-tailed godwit)। বাংলাদেশে দৃশ্যমান আটটি বেয়ারের ভুঁতিহাসের পাঁচটিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ায়। বিরল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আরো আছে কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাছমুরাল, লালবুক গুরগুরি, পাতি লালপা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দি প্রভৃতি।

পাখি ছাড়াও কিছু সরিসৃপ এবং উভচর প্রাণীরাও টাঙ্গুয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবে ভূমিকা রাখে।এদের মধ্যে ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৪ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর আবাস এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর। বিলুপ্ত কাছিমের মধ্যে রয়েছে হলুদ কাছিম, কড়ি কাইট্টা ও পুরা কাইট্টা।

তিন. টাঙ্গুয়ার সম্পদ

টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশি মাছের আধার বা‘মাদার ফিশারিজ’। এটি দেশি মাছের অন্যতম প্রজননক্ষেত্র।

হাওরে ২০০ প্রজাতির মাছ আছে। হাওরে মাছের মজুত আছে ৬ হাজার ৭০১ মেট্রিক টন। এখানে বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে আছে চিতল, মহাশোল, নানিদ, সরপুঁটি, বাগাড় ও রিটা। বেশি পাওয়া যায় রুই, গইন্যা, কাতলা, কালবাউশ, শোল, গজার, টাকি, মেনি, বোয়াল ট্যাংরা ইত্যাদি।এই হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে ছিল মহাশোল। মাছটির দুটো প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Tortor এবং Torputitora, টাঙ্গুয়ার হাওরে দুই প্রজাতিই পাওয়া যেত।

টাঙ্গুয়ার হাওর দেখার পাশাপাশি আরো যা যা দেখতে পারেনঃ

টাঙ্গুয়ার হাওর, বারেকের টিলা, টেকেরঘাট এবং বরছরা, যাদুকাটা নদী, অদৈত মহাপ্রভুর বাড়ি, চুনাপাথরের লেক।

সুনামগঞ্জ রিভারভিউ, হাছন রাজার বাড়ি এবং সমাধি, নারায়ণ তলা, ইন্ডিয়ার বর্ডার বাজার, শাহ আরেফিনের মাজার, গৈরারং জমিদার বাড়ি ও বাউল সম্রাট আবদুল করিমের বাড়ি।
তাই পর্যটকদের মুখে মুখে আজ সৌন্দর্যে,সম্পদে অপরুপ সম্মেলন হলো টাঙ্গুয়ার হাওর।

৪. যাতায়াত ব্যবস্থাঃ

ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ শ্যামলী, ইউনিক ও এনা পরিবহনে। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট রিকশায়। সাহেববাজার থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে যেতে পারেন। আবার ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জগামী হাওর এক্সপ্রেসে মোহনগঞ্জ। মোহনগঞ্জ থেকে ধর্মপাশা হয়েও লঞ্চ, ট্রলার, মোটরসাইকেল বা স্পিডবোর্ডে টাঙ্গুয়ার হাওর দেখতে যাওয়া যায়।

ঢাকা থেকে রাতে শ্যামলী আর এনা সরাসরি সুনামগঞ্জ ভাড়া ৬৫০/৭০০ টাকা। ভোর ৬টায় আব্দুজ জহুর সেতুর ওপর নেমে প্রতিজন ১২০/১৫০ টাকা ভাড়ায় ট্যাক্সি/সিএনজি বা মোটরসাইকেলে সরাসরি তাহির পুর চলে যেতে পারবেন। তাহিরপুর থেকে একদিনের জন্য চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা নৌকা ভাড়া করে নিজের সুবিধামত যে কোন সময়ের জন্য নিতে পারবেন। টেকেরঘাট এবং বারিক্কাটিলা হোটেলে খেতে পারবেন।

রাত্রিযাপন : বেসরকারীভাবে টাঙ্গুয়ার হাওরে রাতে থাকার মতো হোটেল নেই। তবে তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউসে থাকা যায়। হাওর ঘুরে রাতে তাহিরপুর বাজারে হোটেলে থাকা যাবে অথবা সুনামগঞ্জ সদর চলে আসলে হোটেলে থাকতে আর সমস্যা হবেনা।

পরিশেষে এটুকুই বলবো হাওরকন্যা সুনামগঞ্জের গর্ব টাঙ্গুয়ার পরিবেশ সংরক্ষণে দায়িত্বশীল সকলের সুদৃষ্টি থাকুক।টাঙ্গুয়ার সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক।

লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক
প্রতিষ্ঠাতা প্রধান, হাসুস বাংলাদেশ

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া,প্রথম আলো,হাওরের হালচাল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে