সনাতন ধর্মে পশুবলী বনাম জীবে প্রেম

0
289

সনাতন ধর্মে পশু বলি বনাম জীবে প্রেম!
দেবী দূর্গা, মা কালী, মনসা কেউই পশু বলি গ্রহণ করেন না।

শুভ শক্তিকে কখনো বলি দেওয়া হয় না।
বলি অশুভ শক্তিকেই দেওয়া হয়।
যারা কালো বিদ্যা, যাদু, বান টোনা করেন তারা পশু বলি দিয়ে অশুভ শক্তিকে বশে আনেন।

তাহলে এই অশুভ শক্তিকে তুষ্ট করার জন্য কারা বলিপ্রথার প্রচার প্রচলন করেছিলো?

দেবীপূজোয় বলির বিষয়ে মহাকাব্য মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে – সুরাপান, মৎস্য, পশুমাংস লোভে দুষ্টজনেরা বলিপ্রথার প্রচলন করেছে।
কিন্তু প্রধান ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বেদ গ্রন্থে দেবীপূজায় বলির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পদ্মপুরানে বলা হয়েছে –
যেসব তামসিক ব্যক্তি দেবীর উদ্দেশ্যে জীবহত্যা করে, তাদের অনন্তকাল নরকবাস হয়।

বেদে যেসব ঋষি পশু বলি দিতেন তাঁদের পশুর প্রাণদান করার ক্ষমতা ছিলো।আপনি, আমি পশুর প্রাণ দান কি করতে পারি?
বেদে যেকোন প্রকারে মাংস আদি উৎসর্গ নিষিদ্ধ রয়েছে। কারণ ঈশ্বর রক্ত পিপাসু নন। তাহার সন্তুষ্টির জন্য কোন পশু হত্যার প্রয়োজন নেই।
তাহার উপাসনা আমরা করি কেবল আত্মশুদ্ধির জন্য।
পশু হত্যার মধ্য দিয়ে কি আত্মশুদ্ধি সম্ভব?

যজ্ঞের মহিমা বর্ণনার জন্য পিতামহ ভীষ্ম
যুধিষ্ঠির কে এক উপ্যাখান শোনান।

উপাখ্যান টি মহাভারতের শান্তি পর্বের ২৭২ নং অধ্যায়ে এসেছে।
সেই উপখ্যানে এক ব্রাহ্মণ যিনি কি না যজ্ঞে পশু বলি দেবার কথা চিন্তা মাত্রেই তার সমস্ত তপস্যা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।

আমরা জানি মহাপুরুষ
শ্রী গৌতম বুদ্ধ শুধু মাত্র একটা মাত্র তীরবিদ্ধ হাঁসের প্রাণ বাঁচার জন্য পুরো রাজ্য, সিংহাসন হাঁসের প্রাণের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন।
তিনি জানতেন পুরো রাজ্যের চেয়ে হাঁসের প্রাণ বাঁচানো গুরুত্বপূর্ণ, প্রাণ বা জীবকে রক্ষা করাই প্রকৃত ধর্ম।
তিনি অহিংসার বানী প্রচার করে গেছেন পৃথিবীতে।

জীবহত্যা আর যাই হোক, পূজো নয়,তামসিকতা, উদ্দামতা,পাশবিকতার। হত্যা মানুষের মনে হিংসার জন্ম দেয়, মনকে নিষ্ঠুর ও রুক্ষ করে,অন্তরের শান্তি নষ্ট করে দেয়।

হত্যার মাধ্যমে কি পরমেশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়?
রক্ত কি নিবেদন করার জিনিস?

পশু বলি বা প্রাণী বা পাখি হত্যার বিরুদ্ধে সনাতন ধর্মের কিছু ঘটনা

পদ্মপুরাণে আছেঃ
নিহতস্য পশোর্যজ্ঞে স্বর্গ প্রাপ্তির্যদীষ্যতে।
স্বপিতা যজমানেন কিংবা তত্র ন হন্যতে।।
৩৬৭- সৃষ্টিখণ্ড ১৭শ অধ্যায়।
অর্থঃ
যজ্ঞে নিহত হলে যদি পশু স্বর্গ প্রাপ্তি হয়, তবে যজমান কেন স্বীয় পিতাকে এ যজ্ঞে নিহত করে না।

১। একদা লঙ্কাধিপতি রাবণ শত নৃপতিকে আবদ্ধ করে মা কালীদেবীর অর্চ্চনা (যজ্ঞ) করবার মনস্থ করলে মানব দরদী ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাদেরকে অবমুক্ত করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন।

২। জরাসন্ধের আটককৃত সহস্র নৃপতিদের মা কালীর সন্তুষ্টি লক্ষ্যে বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে শ্রীকৃষ্ণ
সে প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন।

৩। অপুত্রক রাজা বিম্বিসার পুত্র লাভের আশায় সহস্র ছাগ বলি দেওয়ার মনস্থ করলে মানব প্রেমী তথাগত বুদ্ধদেব রাজার উদ্দেশ্যে অন্যভাবে পূরণ করে ছাগগুলোকে মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেন।
এবং রাজাকে বলেন- একটা মাত্র পুত্র সন্তানের জন্য আপনি সহস্র প্রাণকে হত্যা করছেন?
মা দুর্গা কি রাক্ষসী?
মা কিভাবে সন্তানের রক্ত পান করতে পারেন।
গৌতম বুদ্ধ দূর্গা প্রতিমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা মাত্রই দূর্গা প্রতিমাটি আপনা – আপনিই দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিলো।

৪। গৌতম বুদ্ধ তাঁর পঞ্চশীলা বাণীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করেছেন –
প্রাণী হত্যা হতে বিরত থাকিবে।

৫। পঞ্চ পান্ডবদের পিতা পান্ডু একদা বনে শিকারে গিয়ে এক হরিণ দম্পতিকে মৈথুন অবস্থায় তীর নিক্ষেপ করলে, তীর বিদ্ধ হয়ে তৎক্ষনাৎ হরিণ দম্পতি ও অভিশাপ দিলেন পান্ডুকে।
তোমার ও এই অবস্থায় মৃত্যু হবে।

৬। ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শতপুত্রের মৃত্যুর কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের
কাছে জানতে চাইলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন- যে ৫১ জন্মের আগে খেলার ছলে ১০০ টা প্রজাপতিকে ধরে তুমি মালা তৈরী করে গলায় ব্যবহার করায় তাদের মৃত্যু হয়। এই অপরাধে নিজ সন্তানদের মৃত্যু ঘটেছে এবং শতপুত্রের শোক সইতে হলো।
গান্ধারী তুমি পূন্যবান বিধায় একশ জন্মে শোক বা শাস্তি ভোগ না করে একজন্মেই একশত জন্মের পুত্র শোক থেকে তুমি মুক্তি পেলে।

৭। মহর্ষি কৌশিকের সাতপুত্র গর্গমুনির আশ্রমে গরু চরাতেন।
একবার অনেক দূরে গরু চরাতে গিয়ে সঙ্গে নেওয়া সকল খাদ্য সমাপ্ত হলে, ছোট ভাই একটা গরু হত্যা করে তার মাংস খেয়ে বাঁচতে চাইলেন।
বড় ভাই তখন তাকে বললোঃ অন্তত আগে গরুটাকে পিতৃপুরুষের নামে উৎসর্গ (শ্রাদ্ধ) করে নাও।
গো হত্যার অপরাধে সকলকে নরক ভোগের পর দর্শানদেশে ব্যাধ, কালঞ্জর পর্বতে মৃগ, শরদ্বীপে চক্রবাক পাখী এবং মানস সরোবরে হংস হয়ে জন্মেছিলেন।
শ্রাদ্ধ কার্য করার ফলে তারা জাতিস্মর হয়ে আসতে পেরেছিলেন।
তাই প্রতি জন্মে তারা কোন ক্ষতি করতো না।
পরে কুরুক্ষেত্রে দেবজ্ঞ ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

৮। পূজায় পশু বলি দান যে শাস্ত্রসম্মত নয়, তা প্রমাণ করে নবদ্বীপ, কাশী, ভট্টপল্লী ও হরিদ্বারের পন্ডিতমন্ডলী কয়েক বৎসর পূর্বে এক ব্যবস্থাপত্র প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলো।

বিষ্ণু মন্ত্রোপাসক এবং শক্তি মন্ত্রোপাসক স্বাত্বিকাধিকারীগণ পশুঘাত পূর্বক বলিদানের পরিবর্তে কুষ্মাণ্ড ইক্ষুদানের মাধ্যমে পূজা করিতে পারেন।
পার্ব্বতী বলিয়াছেন – যাহারা আমার (দেবীর) অচ্চর্নার সন্তুষ্টি বিধানে প্রাণী হত্যায় তৎপর হয়।
সেই পূজা আমি অপবিত্র মনে করি। আমার নাম করিয়া অযথা যজ্ঞে যে পশু হত্যা করে সে কোথাও গিয়ে পাপ হইতে নিস্কৃতি লাভ করিতে পারিবে না।

প্রবাসী, আশ্বিন ১৩১০।।

‘মহাভারত’ এর অমৃত-বাণী-

দ্রৌপদী’কে দেয়া উপদেশ-

স্বয়ংকে জেনে ফেলো যদি তুমি নিজেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে-

প্রত্যেক আত্মাই পরমাত্মার রূপের আলোকে গঠিত হয়। কিন্তু সেটা মানুষ অনুধাবণ করতে পারেনা।
ছাইয়ে ঢাকা আগুন যেমন দেখা যায় না, অজ্ঞানে আচ্ছন্ন ব্যক্তি ও আত্মাকে চিনতে পারেনা।

যে স্বয়ংকেই চিনতে পারেনা,
সে অন্যকে চিনবে কিভাবে ?
আর অন্যরাও তো একইভাবে স্বয়ংকে চেনে না।
নিজেকে জানার জন্য সবচেয়ে বড় কর্ম হলো মানুষের ধর্মকে ধারণ করা এবং এর প্রতিষ্ঠায় আপ্রাণ চেষ্টা করা।

ধর্ম কি?
ধর্মকে বুঝতে হলে ধর্মের ভিত্তিমূল কি তা জানত হবে।
আর তা হলো-
১. জ্ঞান
২. প্রেম ৩. ন্যায়
৪. সমর্পণ ৫. ধৈর্য্য।
মানুষের জন্ম হয়েছে এই পাঁচটি ভিত্তিমূলকে কে অর্জন করবার জন্যে।

বিশ্বসংসারে একজন মানুষ তখনই প্রকৃত ধর্মকে সংস্থাপন করতে পারবে তখন, যখন এই পাঁচটি গুণ মানুষ অর্জন করতে পারবে।
কারণ…..
জ্ঞান বুদ্ধিকে স্থির রাখে।
ধৈর্য্য মনকে স্থির রাখে।
প্রেম হৃদয়কে স্থির রাখে।
সমর্পণ শরীরের সমস্ত আবেগকে শান্ত করে শরীরকে স্থির রাখে।
ন্যায় আত্মাকে স্থির রাখে।
এরূপে…..
মন, বুদ্ধি, হৃদয়, শরীর, আত্মা যখন শান্ত ও স্থির হয়ে যায়,
তখন মানুষ করুণায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।
একেই ধর্ম বলে।
‘করুণা’ হলো ধর্মেরই প্রধান ভিত্তিমূল।

পরমাত্মায় সকল জীবের মাঝে আত্মা রপে বিরাজ করেন…

সনাতন ধর্ম প্রাচীন পবিত্র এবং আধ্যত্বিক চেতনার ধর্ম।
যেখানে প্রকৃতিকে স্তুতি করা হয়েছে।
প্রকৃতির জয়গান করা হয়েছে।
প্রকৃতি মানুষকে জীব বা কোন প্রাণী হত্যা করা অধিকার দেয়নি।
প্রকৃতির নিয়ম সমস্ত জীবের স্বাভাবিক মৃত্যু।
মানুষ সামাজিক অনুষ্ঠান বা খাদ্যের জন্যই প্রতিদিন হাজার হাজার পশু পাখি জবাই করছে।
কিন্তু ধর্মের নামে বলিকে বৈধতা দিতে চাওয়া মারাত্মক ও ভয়াবহ।
তাই সত্যকে জানার জন্য, প্রকৃত সত্যকে
জানার চেষ্টা করতে হবে।
সনাতন ধর্মের গভীরতায় প্রবেশ করুক,
বেদ পড়ুন, উপনিষদ পড়ুন, মহাভারত পড়ুন,
গীতা পড়ুন, বিশ্লেষণ করুন, জানুন-
জ্ঞানের গভীরতা তথা সনাতন ধর্মের সাগরে ডুব দিন,
প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন…
সনাতন ধর্ম বলি বা হত্যাকে কোনরূপ, আংশিক বা কোনভাবে বলিকে সমর্থন করে না।

একটি মানবিক দেশ বা পৃথিবী রচনার জন্য আমাদের মানবিক হতে হবে।
পশু বলি বা হত্যা মানবিক পৃথিবী সৃষ্টির অন্তরায়।
জয় প্রেম।
জয় হোক মানুষের,
জয় হোক মানবিকতার,
জয় হোক প্রকৃতির…
লেখা সংগৃহিত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে