যে কারণে জাতীয়করণ দেশবাসীর জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে

0
210

যে কারণে জাতীয়করণ দেশবাসীর জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড হলেও এই শিক্ষাই শিক্ষকদের এখন কারাদন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে স্ত্রী-পুত্র সংসার নিয়ে এখন তারা কারাদন্ড ভোগ করছেন। এই শিক্ষাই তাদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। না হলে দেশের একজন দিনমজুর যেখানে মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা মাসে কামাই করতে পারেন সেখানে একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা! দিন -রাত স্বপ্ন দেখে সন্তানকে মানুষ করা মা -বাবারা শেষ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে পাচ্ছেননা কোন সহযোগিতা! পাবেন কিভাবে, সন্তান নিজেই তো এখন তার সংসার নিয়ে এক প্রকার কারাদন্ড ভোগ করে যাচ্ছেন! হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, বাস্তবে শিকের জালে আবদ্ধ কারাদন্ড না হলেও এ যেন এক অদৃশ্য কারাদন্ডে হাত- পা বাঁধা এক অবস্থা শিক্ষকদের। না পারছেন স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে, না পারছেন সন্তানের ভরণপোষণ করতে, না পারছেন বৃদ্ধ মা-বাবার মন রাখতে। দেশ যখন স্মার্ট বাংলাদেশ হবার স্বপ্ন দেখছে শিক্ষকদের তখন অভাবের অনটনে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে বাঁধা এক গিনিপিগ জীবন যাপন করছেন। কথায় আছে ‘পেটের ক্ষুধায় আইন মানে’ শিক্ষকদের বেলায়ও হয়েছে তাই। তাই তো তারা লজ্জা, স্মরমের মাথা খেয়ে, স্কুলে তালা ঝুলিয়ে গত ১১ জুলাই থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ব্যানারে ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছেন। বার বার মাউশি থেকে নোটিশ দিলেও কাজ হচ্ছে না, স্কুলে না ফিরে তারা এই অবস্থান ধর্মঘট পালন করে যাচ্ছেন। এই যখন অবস্থা তখন এই শিক্ষকদের নিয়ে দু-চারটি কথা আর না লিখলেই হচ্ছে না। তাহলে চলুন বন্ধুরা এই বিষয়ে একটু বিস্তারিত জেনে আসি।

নেপোলিওন বলেছিলেন ‘তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেবো’ এ থেকেই বুঝা যায় দেশ গঠনে শিক্ষার কি গুরুত্ব। অথচ এই শিক্ষা বাস্তবায়নের মূল কারিগর শিক্ষকরা আজ বঞ্চিত, লাঞ্চিত, অপমানিত। শিক্ষকদের সাথে আজকাল যে কেউ সমন্ধ করতে চায়না, এই লজ্জাটা আসলে কার, জাতির বিবেকের কাছে তা প্রশ্ন রইলো। এবার দেখে আসি তাদের সাথে বৈষম্যের কিছু ফিরিস্তি-

১। বেতন স্কেল সরকারি স্কুলে শুরু হয় ১৬০০০ টাকা দিয়ে আর বেসরকারি স্কুলে ১২৫০০ টাকা দিয়ে।
২। বাড়ি ভাড়া সরকারি স্কুলে ৪৫/৫০% আর বেসরকারি স্কুলে মাত্র ১০০০ টাকা।
৩। মেডিকেল ভাতা সরকারি স্কুলে ১৫০০ টাকা, বেসরকারি স্কুলে মাত্র ৫০০ টাকা।
৪। সরকারি স্কুলে শিক্ষকের বেতন থেকে কোন টাকা কর্তন হয় না, অথচ বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন থেকে ১০% টাকা কেটে নেয়া হয়।
৫। বেতন সরকারি শিক্ষকরা ২/৩ তারিখ পেয়ে যান, বেসরকারিতে ১২/১৪ তারিখে আসে।
৬। সরকারিতে শ্রান্তিবিনোদন ভাতা আছে বেসরকারিতে এসব কিছুই নেই।
৭। সরকারিতে শিক্ষকদের বিদেশে ট্রেণিং এর সুযোগ দেয়া হয় বেসরকারিতে তা নেই।
৮। অবসরকালিন ভাতা অবসরের সাথে সাথেই অল্পকিছু দিনের ভিতরই পাওয়া যায়, বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকের ভাতা ৪/৫ বছর লেগে যায়, কেউ কেউ না পেয়ে মারাও যায়।
৯। সরকারিতে পেনশন ভাতা আমরণ পর্যন্ত, পুরুষ হলে তার স্ত্রী ও আমরণ পর্যন্ত পায় অথচ বেসরকারিতে এক বছরেরও এমন সুবিধা নেই।

এই হচ্ছে বৈষম্যের সামান্য ফিরিস্তি। আরো অনেক বৈষম্য রয়েছে যা লিখলে কয়েক পাতা লেগে যাবে তাই আর লিখলামনা। এই পাহাড়সম বৈষম্য নিয়ে নিয়ে আশায় বুক বেঁধে বেসরকারি শিক্ষকদের আজকে স্বাধীনতার ৫২ বছর, আর কত?

আর এই জাতীয়করণটা কি শুধুই শিক্ষকদের জন্যই দরকার, আর কারোই কি দরকার নেই?চলুন এ বিষয়ে জেনে আসি। প্রতিটা বেসরকারি স্কুলের বেতন হু হু করে বাড়ছে, ইতোমধ্যে তা ৩০০/৪০০ টাকাতে উন্নীত হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে তা ৮০০/১০০০ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। কোন পিতার ৩ টি বাচ্চা হলে তার হাজারের উপরে মাসিক টাকা গুণতে হচ্ছে। এখন আপনারাই বলুন দেশের বর্তমান আর্ত-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন অভিভাবকের কি এই ব্যায়ভার বহন করা সম্ভব? তাই তো আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের স্কুল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে শিশু শ্রমে লাগাচ্ছে, অপরদিকে স্কুলগুলোও হচ্ছে শিক্ষার্থীশূন্য। এটা কি দেশের জন্য ভালো কিছু ভয়ে আনবে? তাছাড়া বিভিন্ন স্কুলের ফান্ডে অনেক টাকা থাকে যা ঐ সব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তার অনুগামীদের নিয়ে লুটপাটে ব্যস্ত থাকে, যেকারণে স্কুলগুলোতে চলে কেবল গ্রুপিং, কোন্দল,মারামারি, দলাদলি যা বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে প্রায়ই দেখা যায়। শিক্ষকরা যদি এইভাবে নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে লিপ্ত থাকে সেই শিক্ষক কিভাবে বাচ্চা মানুষ করবে? এছাড়াও বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির লোকরা পর্যন্ত ঐ স্কুল ফান্ডে লোভ করে শিক্ষকদের করেন লাঞ্চিত। এহেন পরিস্থিতিতে এই স্কুলগুলো সকল ফান্ড সরকারের কোষাগারে নিয়ে জাতীয়করণ তথা সরকারিকরণ একবারে জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রিয় অভিভাবকদের বলি আপনারা একবার ভাবুন তো একটা স্বাধীন দেশে কেন আপনার বাচ্চার পড়ালেখা টাকায় কিনে নিতে হবে? এটা মৌলিক অধিকারের একটা। এটাই যদি সরকার আপনাকে ফ্রি দিতে না পারে তাহলে আপনি যে ট্যাক্স দিচ্ছেন নিয়মিত তার বিনিময়ে আপনারা কি রাষ্ট্রীয় সুবিধাটা পাচ্ছেন বলেন তো? তাই আর কালক্ষেপণ না করে এগিয়ে আসুন আপনারাও। নিশ্চিত করুন নিজের অধিকার। ধনীর বাচ্চা সরকারি সার্টিফিকেট নিবে আর আপনার বাচ্চা বেসরকারি সার্টিফিকেট নিবে তা হতে পারেনা। কাজেই জাতীয়করণ এখন আর কেবল শিক্ষকদের জন্য নয়, পুরো দেশবাসীর জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়া বেসরকারি শিক্ষকদের অযোগ্য, ঘটনাচক্রে শিক্ষক এসব বলে উনার অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন তাই আমরা লজ্জিত। মাননীয় মন্ত্রীকে বলবো একটু ভেবে দেখুনতো দেশের ৯৭ ভাগ শিক্ষা পরিচালনা করছে বেসরকারি শিক্ষকরা, দেশের নামী দামী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়ছে এমপিওভুক্ত স্কুলের ছাত্ররা, সচিব, মন্ত্রী , ডিআইজি হচ্ছে তাদের সন্তানেরা, তাহলে তারা অযোগ্য শিক্ষক হলো কিভাবে? আর নিয়োগ প্রক্রিয়ার কথা বলছেন আমার নিজের দেখা অনেককে দেখেছি দুই দুইবার এনটিআরসিএর পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে পারেনি এমনো আছে সেই চাকরিপ্রার্থী হয়েছে বিসিএস ক্যাডার সেইক্ষেত্রে আপনি বেসরকারি শিক্ষকদের কিভাবে বলবেন অযোগ্য ? শিক্ষকতাকে ভালোবেসে ঢাবি, শাবি সহ দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশি করা মেধাবীরা শিক্ষকতায় এলো বলে আপনি তাদেরকে এমনভাবে হেয় করবেন? তাই আপনাকে অনুরোধ করবো প্লিজ এসব বলে বলে নিজেকে আর অর্বাচীন প্রমাণ করবেন না। একই কারিকুলাম, একই সিলেবাস পড়ানোর সামর্থ থাকা কোন শিক্ষক কোনক্রমেই কম মেধার অধিকারী হতে পারেনা। তাই বলবো এক দেশে দুই নীতি আর কোনভাবেই চলতে পারেনা।

সবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ অনুরোধ থাকবে, আপনি আমাদের শেষ আশ্রয় স্থল,মানবতার মা জননী। আপনার দিকে চেয়ে আছে দেশের গোটা শিক্ষক সমাজ। আমাদের মহান নেতা, এই দেশের জন্মদাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য কন্যা আপনি। জাতির জনক যেহেতু যুদ্ধবিদ্ধস্ত নবগঠিত দেশে এক ঘোষণায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করেছিলেন, আশাকরি এবার আপনিও পারবেন মাত্র ২০ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ তথা সরকারিকরণ করতে। শীগ্রই জাতীয়করণের ঘোষণা আসবে আমরা এই আশায় বুক বেঁধে রইলাম। শুভকামনা আপনার জন্য।

লেখক

জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে