ভাটির হাওর: ‘আশায় বাঁচে চাষা’
–অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার
ভাটির হাওর এক অপরিমেয় সম্পদ ভাণ্ডার। যেমন মিষ্টিমাছ তেমন ধান—রবি শস্য শাক্—সব্জি অন্যান্য অদেখা সম্পদ। আমার হাওরের শাপলা—শালুক সিঙরা হুগলগোটা কেওরালি পদ্মবিচি বেতগোটা শহুরে শিক্ষিত মানুষও ভীষণ পছন্দ করে তবু এনিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি এর কোনো উন্নয়ন চিন্তা করলো না। অথচ আমেরিকায় যে বদ্ পানীয় পেপসি তৈরি হবার পরদিনই আমার গ্রাম্য—বাজার ‘ইটনা’ ‘বেতগঞ্জে’ এসে হাজির হয়ে যায়। গ্রামে যা ছিলো বনবেগুন বা চুকাবাইঙ্গন (টকবেগুন) আজকের টমেটো নামে সুস্বাদু সালাদে পরিণত হয়ে সুধিজনের পাতে শোভা পাচ্ছে। এগুলি নতুন আধুনিক রেসিপি’তে তুলে ধরলে দেশে বিদেশে নিশ্চয়ই আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো। তাতে ভাটির হাওরের বন্য জলজ পানিফল সারাদেশে আদরণীয় হয়ে উঠতো, মর্যাদা বাড়তো হাওরের। আর গোলাপের কথা যদি বলতে হয় তো ইতিহাসই পাল্টে যাবে। এই গোলাপ ছিলো হাওরের গুজাফুল যা পরবর্তীতে উন্নত প্রজাতির সংস্পর্শে গোলাপ হয়েছে। তারপরও গুজাকাঁটার গাছ হাওরের গৃহবধূর উনুনে ঘনস্বরের দুধ জ্বাল দিতে উত্তম জ্বালানি হিসেবে এখনও সমাদৃত। এগুলি ভাটির হাওরের অন্তজ¦র্ালার কথা। কেননা হাওর নিঙড়ে সবাই নেয় কিন্তু দেয় খুব কমই।
যাক্ যা বলছিলাম হাওরের পারিপাশি^র্ক অবস্থার কথা। ২০১৭ সন ভাটির সবগুলি হাওর তলিয়ে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিলো তারপর সান্ত্বনা স্বরূপ প্রকৃতি একনাগারে চার বছর খরাশুকনা বৈশাখ দিয়েছে। কৃষক নির্বিবাদে শুকনো ধান গোলায় তুলতে পেরেছে। তবু মনে একটা ভয়ও অপেক্ষা করছিলো এবছর থেকেই হয়তো আগাম বন্যার উৎপাত শুরু হবে। কেননা একনাগারে চার বছর নিরাপদে ফসল তুলতে পারা ভাটির হাওরের ইতিহাসে খুব কমই লিখা আছে। এবারের বছরটা ছিলো কাতিমারা বছর। অর্থ্যাৎ কার্তিক মাসে বৃষ্টি হলে হাওরের ভবিষ্যৎ অবস্থা আশানুরূপ হয় আর যদি না হয় অনাবৃষ্টি শিলাবৃষ্টি ঝড়—তুূফান আগাম বন্যা ইত্যাদি নানান শঙ্কায় কৃষককে দিনাতিপাত করতে হয়। কার্তিকে বৃষ্টি না হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় অন্তত ২০ দিন আগে জালাচার ভেসে যায়। বাড়তি খরচা করে জালাচারে জলসেচ দিয়ে ভিজিয়ে রেখেও অন্তত ১৫ দিন আগেই জালা বুনতে হয়। তদ্রুপ ক্ষেতে ধান লাগাতে বয়ষ্ক জালা বা চারাই কৃষককে সময়ের আগেই লাগাতে বা রোপন করতে হয়েছে। পরের যে উপসর্গটা উপস্থিত হয়েছে প্রচণ্ড শীত জনজীবন ও মৌশুমী ফসলকে কাবু করে ফেলেছিলো। তাতে ধানগাছকে স্বাভাবিক মাত্রায় বাড়তে বাধাগ্রস্ত করেছে। তারপরই শুরু হলো প্রচণ্ড রোদ ও প্রচণ্ড গরম তাতে ধানগাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে প্রতিহত করেছে। যে কারণে যথাসময়ে ধানক্ষেতে যেটুকু ফলন হবার কথা তা হয়নি। নয়তো স্বাভাবিকভাবে চৈত্রের শেষ সপ্তাহে বোরোধান পুক্ত হয়ে প্রায় পাকার অবস্থায় এসে যায়। এবছর তা হয়নি বরং এতগুলি প্রতিকূলতা কাটাতে ধানে রোগ—বালাই দেখা দিয়েছে। ধান পুক্ত অবস্থায় আগা অর্থ্যাৎ শিষটা পঁচে গিয়ে সাদা রং ধারন করেছে। কৃষি অফিস এটাকে ব্লাস্টরোগ বললেও মোৗখিক পরামর্শ দিয়ে কৃষককে প্রবোধ দিয়েছে কিন্তু মাঠ পযার্ায়ে কোনো কৃষিকমীর্ আসে নাই।
’১৭ সনের হাওর বিপর্যয়ের পর গত ক’বছর প্রতিযোগিতা করে অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিকভাবে পিআইসি বাড়িয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে প্রতিনিয়ত। বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে শত কোটি টাকারও ওপরে। এই বরাদ্দ লোপাট করতে, স্থানীয় আবেগ ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হাওর ভাবনাকে পুঁজি করে হাওরকে পুকুর বানানো হয়েছে বাঁধ দিয়ে। হাওর জনপদের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে অহেতুক প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। প্রকৃতির সঙ্গে শত বছর টিকে থাকা সংগ্রামী কৃষকদের দূরে রেখে ফড়িয়া ও সিু্বধাবাদী গোষ্ঠীকে কাছে টানা হয়েছে। তাই হাওর এখন পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কা সামলাতে পারে না। কেন?
প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে প্রকল্প বাড়িয়ে হাওরের উঁচু বস্তি কান্দা কেটে বাঁধে মাটি দেয়া হয়েছে। হাওরের ঐতিহ্য, হাওরের প্ল্যাটফরম হিসেবে বিবেচিত কান্দাগুলো দ্রুত উজার করা হয়েছে মাটি কেটে কেটে। যার ফলে পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কা সামলানো জাঙ্গাল তার স্বাভাবিক শক্তি ও চরিত্র হারিয়েছে। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের মাটিতে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে পানির ধারণ ক্ষমতা ক্রমশ কমছে। যার ফলে ঢলের পানি চাপ সৃষ্টি করছে হাওরে, ফসলহানি ঘটছে। এছাড়াও ভাটির কথা বিবেচনা না করে উজানের আগ্রাসী উন্নয়ন প্রকল্পও এই আচমকা ঢলের জন্য দায়ী। উজানের উন্নয়ন যজ্ঞ, কয়লা ও পাথর উত্তোলন, পাহাড়ের বন উজারসহ নানা কারণে ঢল এখন দ্রুত নেমে আসছে। বিপর্যয় ডেকে আনছে ভাটিজীবনে।
শুধু বাঁধ দিয়ে হাওরের ফসল রক্ষা করা যাবে না বরং এই বাঁধ হাওরের মৃত্যুঘন্টার জন্যই দায়ী। এ পর্যায়ে এসে হাওরগুলি এখন এক গুচ্ছ হাওরে পরিণত হয়েছে। একটিতে পানি ঢুকলে অন্যটিকে রক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব নয় কারণ পাশের হাওরে বাঁধ থাকায় নিজের হাওরকেও কৃষক নিরাপদ ভাবে কিন্তু ফল হয় বিপরীত ও উল্টো। প্রতিটি হাওরগুচ্ছের এরিয়া কোনোটির ৩০০ বর্গকি:মি: কোনোটির ৪০০/৬০০ আবার কোনোটির ১৫০/২০০ বর্গকি:মি: হয়ে গেছে। প্রতিটির চারদিকে ৩/৪ টি ৫/৬ বা একাধিক বাঁধ রয়েছে এর কোনো একটি বাঁধ ভেঙ্গে গেলে গোটা এলাকার জনমানুষের অস্থিরতা বেড়ে যায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। প্রশাসনের ডাকে অকুস্থলে পৌঁছতে পৌঁছতে এবং ফিরতে ফিরতে নিজের সম্বল আর রক্ষা হবে না ভেবে হয়তো তার পক্ষে অংশগ্রহণই সম্ভব নয়।
হাওরের ভূ—প্রাকৃতিক পরিবেশ ও পরিভাষা সম্পর্কে দূরবর্তী সমতলের পাঠকদের একটু ধারনা দেওয়া দরকার। হাওর এক অসমতল বেসিন। হাওরের উঁচু থেকে নিচু অবধি এক অগাণিতিক ধরনের কাত। তাই হাওরবাসী হাওরের এ ‘কাত’টাকে বলে ‘কাঙলাকাত’ যা অভিজ্ঞজন ছাড়া বুঝেও না বুঝানোও যায় না। সে কাতটা অনেকটা তুলনা রহিত যেমন একটি কাঙলা মাছ শুইয়ে দিলে মাথা থেকে নিচ এবং লেজ থেকে নিচের যে তফাৎ হাওরের অসমতলটাও তেমনই। সুতরাং হাওরের ভূমিকে কোনোরূপ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় ফেলে বিশ্লেষণ করা যায় না ফলে হাওরকে নিয়ে কোনো কার্যকর উন্নয়নও হচ্ছে না। তাই ধানী জমি আবাদে হাওরের কৃষক তার নিজস্ব বুদ্ধি—প্রযুক্তি দিয়ে যথাসম্ভব সোনার থালে পরিণত করেছে। সেইসাথে যদি অধুনিক কোনো প্রকৌশল যুক্ত হতো হাওরের চেহারা অন্যরকম হতে বাধ্য হতো। অন্যদেশ কীভাবে ভাবে জানি না কিন্তু আমার দেশ, রাষ্ট্র এই আদিম ব্যবস্থাকে উন্নত পর্যায়ে নিতে কোনরূপ আধুনিক শিক্ষিত ব্যবস্থার কথা ভাবছে না এটাই সত্য কথা।
হাওর এলাকা অনেক বড় একটি এলাকা যা দেশের প্রায় অষ্টমাংশ, দুই কোটি মানুষের বাস, কমবেশি ছত্রিশ লক্ষ টন ধানের সহজলভ্য ভাণ্ডার হলেও এর প্রাণপাখি বা জিয়নকাঠি সুনামগঞ্জে। কেননা সুনামগঞ্জ দিয়েই সারা ভাটির হাওরে আগাম বন্যার পানি প্রবেশ করে। সুনামগঞ্জের হাওর—বাঁধ—নদী শাসন সুনিয়ন্ত্রিত ও টেকসই হলেই গোটা হাওরবাংলার সুখের জীবন—জীবিকা হাতের মুঠোয় আসবে। তাই সুনামগঞ্জের হাওর নিয়ে আলোচনা করলে সম্পূর্ণ ভাটি এলাকার কথাই ফুটে ওঠে।
সুনামগঞ্জের হাওরে আগাম বন্যার পানিটা আসে দু’দিক থেকে। দুর্গাপুরে গারো পাহাড়ে উৎপন্ন নদী সুমেশ^রী থেকে আসা ঢল, পুবের খাসিয়া পাহাড়ে উৎপন্ন নদী যাদুকাটা, চলতি, খাসিয়ামারা, সুরমা নদী দিয়ে আগাম বন্যার পানি সুনামগঞ্জের ফসলকে গ্রাস করে দক্ষিণে অন্যান্য জেলাকে প্লাবিত করে। অধিকাংশ বছর পুবের পাহাড়ের বৃষ্টিই সুনামগঞ্জকে প্লাবিত করে কদাচিৎ পশ্চিম দিকের গারো পাহাড়ের ঢলও দেখা দেয়। কোনো বছর দুটোই একযোগে আগাম বন্যায় হাওরগুলিকে আক্রমণ করে সেবছর অবস্থা বেগতিক হয়। তবে কোনো বছর সমতলের বৃষ্টিই কাল হয়ে দাঁড়ায় যেমন ২০১৭ সনে প্রায় এমনটাই হয়েছিলো। গত চার বছর একনাগারে নির্বিবাদে প্রকৃতির বদৌলতে কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পেরেছে। যদিও হাওররক্ষা বাঁধ যথারীতি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তদারকি করার তাগিদ ছিলো না যেহেতু পানির উতপাৎ ছিলো না ফলে বাঁধ কতটুকু শক্ত হয়েছে তা পরীক্ষিত হয় নাই। আদৌ পানি আসে নাই আগাম বন্যা হয় নাই তো এসিড টেস্ট তো হলো না বাঁধ কতটুকু শক্ত হয়েছে। কথায় আছে ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’। প্রকৃতির দান অথচ প্রশাসন—পিআইসি’র লোকেরা গাল ফুলিয়ে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করেছে তারাই কৃষকের ফসল ঘরে তুলে দিয়েছে। এবছর হাওররক্ষা বাঁধে ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিলো। বিভিন্ন মহলের হিসাব ষাট ভাগ কাজ হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৮ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বাড়িয়েও কাজ শেষ করে নাই। অনেক বাঁধে মার্চের ৩১ তারিখ বা ২ এপ্রিলও মাটি পড়ে নাই, ঠিক এ সময়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের দিকে একটি নিম্নচাপ দেখা দেয় এবং এটা কিয়দাংশ উত্তর—পূর্বদিকে সরে এসে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশে তার আঁচ লাগে। তখন ক’দিন রাতে একটু বৃষ্টিপাত হয় এবং উত্তরের পাহাড়ের পানি বাংলাদেশের নদীগুলিতে আগাম বন্যার সৃষ্টি করে তাতেই হাওরের দুর্দশা ঘটে। কাজের মান ভালো হয়নি তাই মাত্র দু’তিন দিনের বৃষ্টিতে নদীতে মাত্র চার/পাঁচ ফুট পানি বাড়াতেই মূল বাঁধ ভেঙ্গে প্রায় দশটি হাওরের ক্ষতি করেছে। পাহাড়ি ঢলে পলি পড়ে আর এতদিনের অপরিকল্পিত বাঁধের মাটি বর্ষার ঢেউয়ে ধূয়ে তলানী পড়ে সব নদী—খাল—বিল ভরাট হয়ে চিকনকান্দি থালের মতো হয়ে গেছে। একটু পানিতেই সাগরের মতো দেখায়। এটুকু পানিতেই যদি বাঁধ ধসে বা ভেঙ্গে যেতে পারে তাহলে সহজেই অনুমেয় পাউবো বাঁধের কাজ কী পর্যন্ত করেছে। সমস্যার মূলে কেউ ভাবে না, পলি পড়ে নদী মুুুখগুলি ভরাট হয়ে আটকে গেছে একটু বৃষ্টিতেই পানি ভেসে যায় কোনোদিকে বেরুতে না পেরে হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে ঠাঁই করে নেয়। আজ অবধি তাই চলছে। এই নদীমুখগুলি খুলে দিলেই সাময়িকভাবে হাওরগুলি বেঁচে যাবে তা বুঝানো যায় না। গত ৪ বছরে প্রায় ৪৫০/৫০০ কোটি টাকার কতটুকু হাওররক্ষা বাঁধে ব্যয় হয়েছে আর কতটুকু লুটপাট করেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না। দু’দিন যাবৎ বৃষ্টি হচ্ছে না পানিও কমতে শুরু করেছে। আর যদি বৃষ্টি না হয় মাত্র ১০ টি দিন রোদ দিলে বাকি ১৫ দিনেই কৃষক কাটা—মাড়াই সারতে পারবে। যাক্ বলা যায় ২০২২ সনে হাওরের কৃষক তার আরাধ্য ফসলও ঘরে তুলতে পারবে। সুতরাং এবারের মতো ‘সর্বনাশের কিঞ্চিৎ রক্ষা’ হয়েছে।
দু:খজনক বটে তবে যে হাওরগুলি নষ্ট হয়েছে সেগুলির অধিকাংশই হাওরের আওতার নয় বিধায় কৃষকের হিসাবের বাইরে ‘গুছি আর কাচি’ ধরনের জমি। অর্থ্যাৎ বছরে দিয়ে গেলে খুবই ভালো ধান কৃষক গোলায় তুলতে পারে, না দিয়ে গেলেও আপত্তি নাই। এমন ধরনের কিছু জমি যেমন বিলের চড়ে নদীর চড়ে বাঁধ দিয়ে রক্ষার সুবিধা না থাকলেও দিয়ে গেলে ভালো লাভবান হওয়া যায় এই ভেবে কৃষক ধান লাগায়। পত্রিকান্তরে জানা যায় এই ধরনের তিন হাজার হেক্টরের মতো জমি তলিয়ে গেছে। তাছাড়া নিরেট বাঁঁধ ভেঙ্গেও কিছু জমি নষ্ট হয়েছে যেগুলির হিসাব চাইলে পাউবো দিতে পারবে না। পাউবো সরকারি সংস্থা। সে তার মর্জি মাফিকই কাজ করে থাকে সাধারণ মানুষের কথায় কর্ণপাত করার অভ্যেস নেই। এখন ‘কুকুরে লেজ নাড়ায়, না লেজে কুকুর নাড়ায়’ বলা মুসকিল তবে এটা ঠিক যে ‘ছাগল নাচে খুঁটির জোরে’ এটা অত্যন্ত সত্য ও বাস্তবিক কথা। এই খুঁটি উপড়াতে না পারলে ভাটির হাওরে কাজের কাজ যে হবে না এখন সাধারণ মানুষও বুঝে তবে সাহস নিয়ে দাঁঁড়াতে পারছে না। অন্য এক লেখায় হিসাব করে দেখিয়েছি শুধু সুনামগঞ্জের বত্রিশটি নদী খনন করলে বিশ বিলিয়ন ঘনফুট মাটি উঠে, এই মাটি দিয়ে ৬ ফুট উচ্চতায় ১০০ ফুট প্রশস্ত লম্বালম্বি ভরাট করলে পাঁচ হাজার তিন শ’ তেরো মাইল দীর্ঘ বস্তি তৈরি করা যায়। এখন চিন্তা করুন পলি ভরাট এ্ই নদীগুলি খনন করে মাটিটাকে সম্পদ ভেবে কাজে লাগালে কতকিছু করা যায়। দু:খ হলো কোনো কথা কোনো চিন্তা কাউকে বুুঝানো যায় না তারা নিজের বাইরে কারো কথা শুনতে রাজি নয়।
আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করলে সুনামগঞ্জের মাত্র তিনটি নদীর মুখ খুলে দিলে প্রাথমিক বন্যার ধাক্কাটা সামলানো খুব সম্ভব। তবে বছরের শুকনো সময়ে স্পট নির্ধারণ করে পরের বর্ষায় সামান্য খনন কাজ করলেই তা সম্ভব। এবারে ৪ এপ্রিল সুনামগঞ্জে যখন বাঁধ নিয়ে হৈ—হুল্লোর শুরু হয়। ডিসি সাহেবের ফেইসবুক পোস্টে একটি বাঁধ সতকীর্করণ বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। আমি মোবাইল নাম্বারসহ মন্তব্যে লিখেছিলাম ডিসি সাব আপনার স্পিডবোটে আমাকে নিয়ে চলুন মাত্র ৪ ঘণ্টায় এটুকু পানি সামলাতে যে নদীমুখগুলি খনন করলেই আপাত সমাধান হবে তা দেখাবো, উনি কর্ণপাত করলেন না। পরদিন বৃষ্টি থেমে গেছে তো ‘আমরা সবাই রাজা’ কে আর কার কথা শুনে। কিন্তু যাদের গেছে তার মধ্যে হয়তো কেউ ছিলো তার এটুকুই সম্বল, নিজের জমি নাই তাই পতিত নদীচড়ে একটু ক্ষেত করেছিলো ছ’মাসের খাবারটা হয়ে যেতো তাও গেলো। এখন চিন্তা করতে হবে আগামী দিনের হাওর রক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা নিয়ে। কাম্য নাব্যতায় হাওরের নদী খনন ছাড়া বেড়িবাঁধ দিয়ে হাওরকে কিছুতেই নিরাপদ করা যাবে না। তাও বিশেষ বিশেষ নদীমুখগুলি প্রথমে জরুরী ভিত্তিতে খনন করে দিলে ফোলা পানিটা সরে যেতে পারবে, তাতে আগাম বন্যার ভয় থাকবে না। বাকি প্রবাহিত ও মরা নদী খাল বিলগুলি দু’টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ষাটের দশকের গভীরতায় নিয়ে গেলে আরও তিরিশ বছর হাওর নিরাপদ থাকবে প্রচুর মাছ হবে পঁচিশ ভাগ আবাদী জমি বাড়বে জাতীয় আয় বাড়বে। এত টাকা মাটি কেটে ব্যয় না করে হাওরের ১৪৩ টি বাঁধ বছরে পাঁচটি হারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)’র তত্ত্বাবধানে ‘রাবার ড্যাম’ করে দিতে হবে। হাওরের গোপাটগুলি পাকা করে সাব—মার্জিবল সড়ক করে দিলেও মানুষের ধান গোলায় তুলতে সহজ হবে এবং ধান হাটে ক্রয়কেন্দ্রে নিতে নৌ—পথের অপেক্ষায় থাকতে হবে না। ধন্যবাদ।
এপ্রিল ১০, ২০২২
লেখক— সাবেক সভাপতি, সিপিবি, সুনামগঞ্জ জেলা কমিটি।