বাংলা কবিতার ছন্দ
বাংলা কবিতার ‘ছন্দ’ বলতে দুটি লাইনের শেষ শব্দ দুটির মিলকে বুঝা ঠিক নয়। যেমন, ‘আমার’র সাথে ‘তোমার’, ‘খেলা’র সাথে ‘ধূলা’ – এ রকম মিল (যাকে বলা হয় ‘অন্ত্যমিল’) থাকলেই ছন্দের কবিতা হয়েছে বলে মনে করা ঠিক না।ছন্দ বলতে এই অন্ত্যমিলকে বোঝায় না, প্রত্যেক লাইনের প্রত্যেক অংশের তালের মিলটাই হচ্ছে ছন্দ।
বাংলা কবিতার ছন্দের প্রকারভেদ-
১।মাত্রাবৃত্ত
২।অক্ষরবৃত্ত
৩।স্বরবৃত্ত
৪।অমিত্রাক্ষর
একে একে সব প্রকার ছন্দ নিয়েই আজ আলোচনা করবো।প্রথমেই মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনানশুরু করছি।
মাত্রাবৃত্তঃ
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম দু’লাইন দিয়ে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে:
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
যদিও এটা ছড়া নয়, তারপরও ছন্দ বোঝার প্রয়োজনে একটু তালের সাথে উপরের লাইন দুটি পড়ুন। দেখবেন, আপনি মনের অজান্তেই লাইন দুটিকে ভাগ করেছেন এভাবে:
এইখানে তোর/ দাদীর কবর/ ডালিম গাছের/ তলে,
তিরিশ বছর/ ভিজায়ে রেখেছি/ দুই নয়নের/ জলে।
প্রত্যেক ভাগ বা অংশকে বলা হয় পর্ব। ‘কবর’ কবিতার প্রত্যেক লাইনে তিনটি পর্ব ও একটি ‘ভাঙা পর্ব’ আছে। লক্ষ্য করুন, প্রত্যেক পর্বে ছয়টি অক্ষর এবং ভাঙা পর্বে দুটি অক্ষর রয়েছে। কবিদের ভাষায়, এই কবিতায় প্রত্যেক পর্বে ছয় ‘মাত্রা’। এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, জসীম উদ্দীন মাত্রা গুনে গুনে কবিতা লিখেছেন। বড় কবিদের তালজ্ঞান সহজাত। ব্যাকরণ হলো আমাদের মতো আমজনতার জন্য।
অক্ষর ও মাত্রা পুরোপুরি সমার্থক নয়। যুক্তাক্ষর থাকলে তাকে ভেঙে মাত্রা গণনা করতে হবে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার প্রথম দু’লাইন পড়ে দেখুন:
ভূতের মতন/ চেহারা যেমন/ নির্বোধ অতি/ ঘোর,
যা কিছু হারায়/ গিন্নী বলেন/ কেষ্টা ব্যাটাই/ চোর।
এই কবিতায়ও প্রত্যেক পর্বে ছয় মাত্রা। প্রথম লাইনের ‘নির্বোধ অতি’কে আমরা পড়ি ‘নির্-বোধ অতি’। তেমনি দ্বিতীয় লাইনে ‘গিন্-নী বলেন’ বা ‘কেষ্-টা ব্যাটাই’ পড়তে ছয় মাত্রাই দরকার হচ্ছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে সেটাকে ভাঙা যায় না, তাই সেটা এক মাত্রাই পায়। নিচের দু’লাইন পড়ে দেখুন:
ক্রয়ের চাইতে/ বিক্রয়ে বেশি/ টাকা,
তবু ধীরে ধীরে/ হচ্ছে পকেট/ ফাঁকা।
এখানে ‘ক্রয়ের চাইতে’ পর্বটিতে ‘ক্র’ যুক্তাক্ষর হলেও শব্দের প্রথমে হওয়ায় একে ভাঙা যাচ্ছে না। তাই এখানে ‘ক্র’ এক মাত্রা পাচ্ছে। কিন্তু, ‘বিক্রয়ে বেশি’ পর্বে ‘ক্র’ দুই মাত্রা পাচ্ছে, কারণ আমরা পড়ছি ‘বিক্-রয়ে বেশি’।
যুক্তাক্ষর না হলেও ‘ঐ’ (উচ্চারণ ‘ওই’) বা ঐ-কারযুক্ত অক্ষর সাধারণত দুই মাত্রা পায়। ‘ঔ’ বা ঔ-কারযুক্ত অক্ষরের বেলায়ও তাই। যেমন:
খালের ওপারে/ ঐ জামরুল/ গাছে,
মৌটুসি এক/ চুপচাপ বসে/ আছে।
এখানে ‘ঐ জামরুল’ পর্বে ‘ঐ’ দুই মাত্রা পাওয়ায় পর্বটির মোট মাত্রা ছয়। তেমনি, ‘মৌটুসি এক’ পড়তে গিয়ে আমরা ‘মউটুসি এক’ পড়ি বলে এখানেও ‘মৌ’ দুই মাত্রা পাচ্ছে। ‘মৌটুসি’র বদলে যদি ‘চড়ুই’ লেখা হতো, তাহলে ছন্দ বা তাল ঠিক রাখতে লিখতে হতো ‘চড়ুই একটি’।
সংক্ষেপে বলা যায়, শব্দের বানানের বদলে উচ্চারণের উপর ভিত্তি করে মাত্রা নির্ধারিত হয় এবং একটি লাইনের প্রত্যেক পর্বে সমান সংখ্যক মাত্রা থাকে।
উপরের সব কয়টি উদাহরণে প্রত্যেক পর্বে ছয়টি করে মাত্রা রয়েছে। এই সংখ্যাটি ছয় না হয়ে চার, পাঁচ বা সাতও হতে পারে। ‘ছন্দের যাদুকর’ বলে পরিচিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘দূরের পাল্লা’ ছড়াটির প্রথম দু’লাইন পড়ে দেখুন:
ছিপখান/ তিন-দাঁড়,/ তিনজন/ মাল্লা,
চৌপর/ দিন-ভোর/ দ্যায় দূর/ পাল্লা।
এই ছড়াটির প্রতি পর্বে চার মাত্রা। ভাঙা পর্ব (‘মাল্লা’ আর ‘পাল্লা’) তিন মাত্রার। এবার পাঁচ মাত্রা ব্যবহার করে দু’লাইন লেখা যাক:
চলার পথে/ তোমার পেলে/ দেখা
ভিড়ের মাঝে/ হঠাৎ লাগে/ একা।
এবার সাত মাত্রার একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করা যাক:
বেতন নেমে গেছে/ অর্ধেকে,
শান্তি পালিয়েছে/ ঘর থেকে,
মাসের শুরুতেই/ ধার-দেনা –
ক্লান্ত মন আর/ পারছে না।
এই কবিতার প্রতি লাইনে একটি পর্ব ও একটি ভাঙা পর্ব। পর্বটি সাত মাত্রার এবং ভাঙা পর্বটি চার মাত্রার।
এ পর্যন্ত যে ধরণের ছন্দ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, একে বলে ‘মাত্রাবৃত্ত’ ছন্দ, কারণ প্রতিটি পর্বে নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রা থাকে। আমরা দেখেছি, মাত্রার সংখ্যা ৪, ৫, ৬ বা ৭ হতে পারে। বাংলা কবিতার ছন্দ আরও দু ধরণের হতে পারে: ‘অক্ষরবৃত্ত’ আর ‘স্বরবৃত্ত’।
সংক্ষেপে বাংলা কবিতার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ আলোচনা করা হলো। এখন দুটি মজার বিষয় হলো বিশিষ্ট কবিরাও অনেক সময় ছন্দপতন করে কবিতা লিখেছেন।বাংলা সাহিত্যের ছন্দের যাদুকর হিসেবে পরিচিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়া থেকে নিচের দু’লাইন পড়ে দেখুন:
টুকটুক/ তুলতুল/ গা ভেজা/ শিশিরে,
বুলবুল/ মশগুল/ কার গান/ গাহি রে।
ছড়াটি চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা হলেও ‘গা ভেজা’ পর্বটিতে তিন মাত্রা। কিন্তু, ‘গা’ শব্দটি একটু টেনে পড়লে অবশ্য তাল মেলাতে সমস্যা হয়না।
২। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
কবিতার ‘অক্ষর’ সম্পর্কে কিছু কথা
আমরা জানি, ছন্দ মূলতঃ ৩ প্রকার। যথা- স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত। মাত্রা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে ‘অক্ষর’ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা একান্তই জরুরি। সাধারণতঃ আমরা ‘বর্ণ’ বা ‘অক্ষর’ বলতে যাকে চিহ্নিত করি কবিতার ছন্দের অক্ষর কিন্তু সেটি নয়। এখানেই অনেকের প্যাঁচ লেগে যাওয়ার কারণে ছন্দ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা সত্ত্বেও তালগোল পাকিয়ে ফেলতে হয়। সব সময় মনে রাখতে হবে বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণেরই আরেক নাম অক্ষর হলেও কবিতায় ‘অক্ষর’ বলতে আমরা ‘একবারে উচ্চারণযোগ্য শব্দের ক্ষুদ্রতম অংশ’-কে বুঝি। ইংরেজিতে এই অক্ষরকে Syllable বলা হয়। অক্ষর আবার দু ধরনের- মুক্তাক্ষর (Open Syllable) ও বদ্ধাক্ষর (Closed Syllable). উদাহরণ হিসেবে – ‘এই যে পাখি ভোরবেলাতে/ কিচিরমিচির গান করে’ কথাটির মধ্যে ২০টি বর্ণ রয়েছে। কিন্তু ছন্দ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এখানে বদ্ধাক্ষর ও মুক্তাক্ষরসহ মোট অক্ষর রয়েছে- ১৫টি। এখানে অক্ষরগুলোকে আলাদা করে দেখালে এরকম দেখায়- এই/ যে/ পা/ খি/ ভোর/ বে/ লা/ তে/ কি/ চির/ মি/ চির/ গান/ ক/ রে= ১৫টি অক্ষর। অভিধানে ‘অক্ষর’ শব্দটির দুটি অর্থ রয়েছে। একটি ‘বর্ণ’ বা হরফ এবং অন্যটি সিলেবল বা এক প্রয়াসে উচ্চারিত ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি। এ কারণে অক্ষর শব্দটি অনেক সময় অর্থপ্রশ্নে বিঘ্নতার অবতারণা করে। ছন্দবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ‘অক্ষর’ শব্দটিকে এ কারণেই ‘সিলেবল’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হননি। তাঁদের আশংকা এতে করে অর্থবিভ্রাটের সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণ বাংলা এবং সংষ্কৃত ভাষায় ‘বর্ণ’ অর্থে কোথাও কোথাও ‘অক্ষর’ শব্দটির প্রচলণ রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ আবদুল হাই, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, অমূল্যধন মুখোপধ্যায় প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী ও ধ্বনিতাত্ত্বিকগণ ঘোষণা করেছেন- ‘অক্ষর বলতে ছাপার বা লেখার হরফ বললে ভুল হবে’। তাঁদের মতে, ‘নিঃশ্বাসের স্বল্পতম প্রয়াসে উচ্চারিত ধ্বনিসমষ্টির নাম-ই অক্ষর’।
মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর পরিচিতি:
উচ্চারণের সময় যে অক্ষর আটকে যায় না, প্রয়োজনে টেনে উচ্চারণ করা যায় তাকে মুক্তাক্ষর বলে। যেমন- যে, পা, খি… ইত্যাদি। বিপরীতে যে অক্ষর উচ্চারণের সময় আটকে যায় সেটাই- বদ্ধাক্ষর। যেমন- ভোর্, চির্, গান্… ইত্যাদি। (চলবে)
তথ্যসূত্র
বাংলা ছন্দের রূপরেখা।। মাহবুবুল আলম
ছন্দের আসর।। আসাদ বিন হাফিজ
লেখালেখির ব্যাকরণ।। ফারুক নওয়াজ
নিচে অক্ষরবৃত্তের সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা প্রদত্ত হলো-
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা, যুক্তাক্ষর শব্দের প্রথমে ও মাঝে ১ মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে যুক্তাক্ষর ২ মাত্রা।
অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়।
অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা হয়; শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা হয়।
কোন শব্দ এক অক্ষরের হলে, এবং সেই অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, সেই অক্ষরটির মাত্রা ২ হয়।
কোন সমাসবদ্ধ পদের শুরুতে যদি এমন অক্ষর থাকে, যার শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, তবে সেই অক্ষরের মাত্রা ১ বা ২ হতে পারে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখা কবিতার আবৃত্তি ধীরগতি হয়।
হে কবি, নীরব কেন/ফাগুন যে এসেছে ধরায় ৮+১০
বসন্তে বরিয়া তুমি/লবে না কি তব বন্দনায় ৮+১০
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি- ১০
দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি? ১০
(তাহারেই পড়ে মনে; সুফিয়া কামাল)
কবিতাটির মূল পর্ব ৮ ও ১০ মাত্রার। স্তবক দুইটি পর্বের হলেও এক পর্বেরও স্তবক আছে।
এখন, মাত্রা গণনা করলে দেখা যায়,
প্রথম চরণের,
প্রথম পর্ব- হে কবি, নীরব কেন; হে কবি- হে+ক+বি = ৩ মাত্রা (তিনটি অক্ষরের প্রতিটির শেষে স্বরধ্বনি থাকায় প্রতিটি ১ মাত্রা); নীরব- নী+রব = ১+২ = ৩ মাত্রা (শব্দের শেষের অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকায় সেটি ২ মাত্রা); কেন- কে+ন = ১+১ = ২ মাত্রা; মোট ৮ মাত্রা
আবার দ্বিতীয় চরণের,
দ্বিতীয় পর্ব- লবে না কি তব বন্দনায়; লবে- ল+বে = ২ মাত্রা; না কি তব = না+কি+ত+ব = ৪ মাত্রা; বন্দনায়- বন+দ+নায় = ১+১+২ = ৪ মাত্রা (বন- অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলেও অক্ষরটি শব্দের শেষে না থাকায় এর মাত্রা ১ হবে; আবার নায়- অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি- য় থাকায়, এবং অক্ষরটি শব্দের শেষে থাকায় এর মাত্রা হবে ২; মোট ১০ মাত্রা।
৩। স্বরবৃত্ত ছন্দ
স্বরবৃত্ত ছন্দ কাকে বলেঃ
যে ছন্দ পাঠকালে, উচ্চারণ গতিবেগ দ্রুত হয়, শ্বাসঘাত পরে,
পর্বগুলো হয় ছোট কেবল ৪ মাত্রার এবং যে ছন্দে অক্ষর
মানেই ১ মাত্রা ধরা হয়, তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে।
স্বরবৃত্ত ছন্দ জানতে হলে, তার আগে অক্ষর, পর্ব, মাত্রা,
যতি বা ছন্দ-যতি, ও শ্বাসঘাত জানা জরুরী।
মুক্তাক্ষর ও বদ্বাক্ষরঃ যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে
এবং উচ্চারণে বাধাগ্রস্থ হয়না, তখন তাকে মুক্তাক্ষর বলে।
যেমন – কলম= ক + লম। এখানে ” ক ” হচ্ছে মুক্তাক্ষর।
যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তাকে বদ্ধাক্ষর বলে।
যেমন-
কলম = ক + লম। এখানে ” লম” হচ্ছে বদ্ধাক্ষর।
অক্ষরঃ স্বল্পতম প্রয়াসে এক ঝোঁকে শব্দের যে
অংশতুকু উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বলে।
যেমনঃ
কলম = ক + লম = ২ অক্ষর।
চিরজীবি = চি + র +জী + বি = ৪ অক্ষর।
মাত্রাঃ কবিতার প্রতি পংক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং
তাকে উচ্চারনে যে সমইয়ের প্রয়োজন হয়,সেই
উচ্চারনকালের ছোটো ছোট এক-একটা অংশই হল মাত্রা।
বাংলা সাহিত্যে এই মাত্রা সংখ্যা একেক ছন্দে একেক রকম
ব্যবহৃত হয়।
শ্বাসঘাতঃ কবিতা পাঠের সময়, পর্বের প্রথম অক্ষরের
উপর জোর দিয়ে পাঠ করাকেই শ্বাসঘাত বলে। যেমন-
মা কেঁদে কয় / মঞ্জুলী মোর / ঐ তো কচি / মেয়ে =
৪+৪+৪+২ মাত্রা
এখানে ( মা – মন – ঐ ) ৩ টি পর্বের প্রথম অক্ষরে জোর
পরে বেশি।
যতি বা ছন্দ-যতিঃ কোন বাক্য পড়ার সময় শ্বাসগ্রহণের
সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের অন্তর অন্তর যে উচ্চারণ বিরতি
নেয়া হয়, তাকে ছন্দ-যতি বা শ্বাস-যতি বলে।
যতি ২ প্রকার- হ্রস্ব যতি ও দীর্ঘ যতি। অল্পক্ষণ বিরতির জন্য
বাক্যের মাঝখানে হ্রস্ব যতি দেওয়া হয়। এবং বেশিক্ষণ বিরতির
জন্য বাক্যের দীর্ঘ যতি ব্যবহৃত হয়।
যেমনঃ- কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣∣
এখানে, কলস নিয়ের পর হ্রস্ব যতি, সবাই তখনের পর হ্রস্ব
যতি, পাড়ায় গেছে এর পর হ্রস্ব যতি …।। পরেছে।
আবার, কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে —- পুরা
লাইন্টার পর দীর্ঘ যতি পরেছে।
( ∣ = হ্রস্ব যতি ও ∣∣ = দীর্ঘ যতি)
পর্বঃ বাক্য বা পদের এক হ্রস্ব যতি হতে আরেক হ্রস্ব
যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমনঃ
কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣∣-
এখানে একটি চরনে মোট ৪টি পর্ব। ৩টি মুল পর্ব। ১টি অতিপর্ব।
স্বরবৃত্ত ছন্দের গঠন আলোচনাঃ
স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্যঃ
স্বরবৃত্তের মূল বিষয়টিই আবর্তিত হয় দুটি সিলেবল বা
দলকে (মুক্ত ও বদ্ধ দল) ঘিরে।
– স্বরবৃত্ত দ্রুত লয়ের ছন্দ।
– এই ছন্দের মূলপর্ব বা পূর্ণপর্ব চার মাত্রাবিশিষ্ট।
– মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষর উভয়ই একমাত্রা বিশিষ্ট।
– পর্বগুলো ছোট ৪ মাত্রা বিশিষ্ট।
– প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষর শ্বাসাঘাতযুক্ত।
উদারহনঃ
বাঁ শ বাগানের ∣ মা থার উপর ∣ চাঁ দ উঠেছে ∣ ও ই ∣∣
এখানে –
~~বাঁশ-১ মাত্রা + বা – ১ মাত্রা + গা – ১ মাত্রা + নের – ১ মাত্রা = ৪
মাত্রা এবং ৪ অক্ষর।
~~ বাঁশ বাগানের ∣ মাথার উপর ∣ চাঁদ উঠেছে ∣ ওই ∣∣ =
৪+৪+৪+১ মাত্রার ৪টি পর্ব।
~~ বাঁ – মা – চাঁ – ও ___ প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষরটি উচ্চারনের
সময় শ্বাসঘাত পরে।
৪। অমিত্রাক্ষর ছন্দ
বাংলা ভাষায় কালজয়ী অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাবের প্রবহমানতা অর্থাৎ, এই ছন্দে ভাব চরণ-অনুসারী নয়, কবিকে একটি চরণে একটি নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করতেই হবে- তা নয়, বরং ভাব এক চরণ থেকে আরেক চরণে প্রবহমান এবং চরণের মাঝেও বাক্য শেষ হতে পারে
বিরামচিহ্নের স্বাধীনতা বা যেখানে যেই বিরামচিহ্ন প্রয়োজন, তা ব্যবহার করা এই ছন্দের একটি বৈশিষ্ট্য
অমিত্রাক্ষর ছন্দে অন্ত্যমিল থাকে না, বা চরণের শেষে কোন মিত্রাক্ষর বা মিল থাকে না
মিল না থাকলেও এই ছন্দে প্রতি চরণে মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ১৪) এবং পর্বেও মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ৮++৬)
উদাহরণ-
জাগে, রথ, রথী, গজ, ∣ অশ্ব, পদাতিক ∣∣ (৮+৬)
অগণ্য। দেখিলা রাজা ∣ নগর বাহিরে, ∣∣ (৮+৬)
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ ∣ সিন্ধুতীরে যথা, ∣∣ (৮+৬)
নক্ষত্র-মণ্ডল কিংবা ∣ আকাশ-মণ্ডলে। ∣∣ (৮+৬)
(মেঘনাদবধকাব্য; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
প্রিয় পাঠক বাংলা কবিতার ছন্দ বিষয়ক আলোচনাটি এখানেই শেষ হলো।আশা করি মনযোগ সহ কয়েকবার পড়লে কবিতা লিখতে আর সমস্যা হবেনা।লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করবেন।
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল,উইকিপিডিয়া।
অসাধারণ। ধন্যবাদ।