সুনামগঞ্জের আলোকিত নারী
ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ
——————— মো.মশিউর রহমান
বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে যে কজন নারী সুনামগঞ্জের সুনামকে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন জেলার ধর্মপাশা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সুখাইর জমিদার পরিবারে সুধাংশু শেখর রায় ও মা নীলিমা চৌধুরীর ঘরে ১৯৪৫ সালের ২৭ জুলাই জন্মগ্রহনকারী ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ। তিনি শিশু সাহিত্যে ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এ সুনাম আমাদের সুনামগঞ্জবাসীর। তাঁর বেড়ে উঠা ও কৈশোরে পড়াশুনা সুনামগঞ্জ শহরের হাসননগরে তাঁর পিতার বাসায়। বর্তমানে স্থায়ী ভাবে ঢাকায় বসবাস করছেন। তিনি স্থানীয় সতীশ চন্দ্র গার্লস হাই স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৫৯ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে রাজশাহী কলেজ হতে ১৯৬৪ সালে ¯œাতক ও ১৯৭৪ সালে জগন্নাথ বিশ্¦বিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ¯œাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই তাঁর সদর্পে বিচরণ রয়েছে। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক ও সংগীত রচয়িতা হিসেবে নিজের অবস্থানটাকে সুদৃঢ় করেছেন। বয়স সাত দশকের কোটা পেরিয়ে গেলেও এখনও সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। লিখছেন প্রতিনিয়তই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ও ম্যাগাজিনে। তাঁর পারিবারিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সাহিত্য সাধনার জন্যে সহায়ক ছিল। কিশোর বয়স থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। লিখেছেন প্রচুর যা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। গল্প দিয়েই তাঁর লেখালেখি শুরু। তাঁর প্রথম গল্প ‘বাদল দিনে’ দৈনিক সংবাদের খেলাঘর পাতায় ১৯৫৫ সালে ছাপা হয়। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত সংগীতকার। ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ফিচার ও শিশুতোষ সাহিত্য ছাড়াও সংগীত রচনায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সাহিত্য ও সামাজিক বিষয়ে সুবক্তা হিসেবেও তিনি সর্বজন নন্দিত। তাঁর অমায়িক ব্যবহার সবাইকে মুগ্ধ করে। শিশু বিষয়ক ভাবনা গুলোই সুন্দর করে নিজের লেখাতে ফুটিয়ে তুলেন। তিনি নিজের শৈশব ও কৈশোরে অনায়াসে ফিরে যেতে পারেন বলেই ছোটদের মনোজগতে দু’চোখ দিয়ে স্বচ্ছভাবে দেখতে পারেন। তাঁর মনের বর্ণালী রঙ দিয়ে রাঙানো শিশু সাহিত্য হয়ে ওঠে অনুপম। সাহিত্যের উপাদান গুলো তিনি সহজেই খুজেঁ নিতে পারেন তাঁ আশ পাশের পরিবেশ থেকেই। শৈশবের তাঁ গ্রামের পাশে হাওর, নদী-নালা, খাল বিল খোলা আকাশই তাঁকে মুগ্ধ করেছে এবং লিখতে সহায়তা করেছে। নিজের সাহিত্য সম্পর্কে অনেকটাই অকপট তিনি। তিনি লেখায় অতি সাধারণ ও বিপর্যস্ত মানুষের জীবনচিত্র স্পষ্টভাবে অঙ্কন করেছেন। লিখেছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে। পাকিস্থান আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ অঞ্চলে যে সমস্ত আন্দোলন হয়েছে কোনটিই এড়ায়নি তাঁর চোখ। এ সমস্ত আন্দোলনে যে সকল প্রতিবাদী মানুষ প্রাণ দিয়েছে তাদের নিয়ে তিনি গল্প লিখেছেন। মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্তের অসহায় মানুষের বঞ্চনা ও অপ্রাপ্তির বেদনাগাথাঁ তিনি তাঁর একাধিক ছোটগল্পে দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। নারীদের নিছের তিনি লিখেছেন অজস্্র। নারীর নানা রকম যন্ত্রণা ও কষ্টের কথা তাঁর ছোটগল্পে রুপায়িত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর একাধিক লেখা রয়েছে। সহজ সরল ভাষা দিয়ে লিখে চলেছেন। এক সাক্ষাতকারে নারীদের নিয়ে তিনি বলেন-“ আমাদের দেশে নারীরা অনেক এগিয়েছে, তবে এর জন্য নারীদেরকে সাংঘাতিক পরিমান লড়াই করতে হয়। সন্তান-সংসার, অফিস সবকিছু নারীদেরকে সামলাতে হয়। পরিবার থেকে নারীদেরকে সহযোগিতা করলে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতো”। তিনি শুধু লেখালেখির জগৎ নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত নন। সংসারেও তিনি একজন সফল নারী। একজন সফল স্ত্রী। ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের সংসার জীবনে রয়েছে উজ্জল ভূমিকা। স্বামী শৈলেন্দু শেখর দাশ পুরকায়স্থ একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। চার সন্তান নিজ নিজ পেমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন সংস্কৃতিমনা মানুষ। বাবা-মা, চাচা, পিসিসহ পরিবারের প্রতিটি সদস্য গান, তবলা সেতারসহ অন্যান্য সংস্কৃতির চর্চা করতেন। পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের গানের ভুবনে থাকার কথা থাকলেও লেখালেখির জগতে এলন কিভাবে জানতে চাইলে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন-“ আমার বাবা শিলং কনভেন্টে পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তীতে সেখানে চাকুরী করতেন। তখন সেকানে নতুন বই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের পড়ার জন্র বই পার্সেল করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। আমাদের বাড়িতে বিশাল লাইব্রেরি ছিল। ছোটবেলায় সেবব ই্ পড়তাম আর ভাবতাম কিভাবে লেখকেরা লেখে, পরে পড়তে পড়তে লেখালেখির জগতে চলে আসি।” লেখালেখির জন্র ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ নন্দনী সাহিত্য পদক, অনন্যা সাহিত্য পদক, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, কমর মুশতারী স্মৃতি পুরস্কার, সাজিদুন্নেসা খাতুন চৌধুরী সাহিত্যপদক, বাংলাদেশ জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সাহিত্য ও সমাজসেবা স্বর্ণপদক ও সম্মান স্মারক, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন দেশ বিদেশ থেকে। তাঁর রয়েছে ১৯টি গল্পগ্রন্থ, ১০টি উপন্যাস, ৩৭টি শিশুতোষ গ্রন্থ। রচনা করেছেন জ্যোৎ¯œায় মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি স্মৃতিকথা। সুনামগঞ্জের আলোকিত নারী ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।